মাসুদ পারভেজ রূপাই

১৪ মে, ২০২৩ ২১:১২

জুবিলী: যেখানে দেশ ভাগ হয়ে যায় আর স্বপ্ন খেই হারায়

ছবি: সংগৃহীত

একটা ভূখণ্ড ভাগ হয়ে যাচ্ছে। দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে মানুষগুলো। বিভাজনের দেয়াল টপকে এ-পার থেকে মানুষ পার হচ্ছে ও-পার। মাঝখানে দরিয়ার গভীরতায় কেউ কেউ হারিয়ে খুঁজছে নানা কিছু। বেহাত হয়ে যাচ্ছে দেশ, সেখানে স্টুডিও-ফিল্ম-সিনেমা হল তো তুচ্ছ কিছু! না। হয়তোবা না। কিন্তু তাই বলে স্বপ্নের কী হবে, বেহাত হয়ে যাবে বুঝি! স্বপ্নের তো দেশ নেই, আলাদা ভূখণ্ড নেই। আছে শুধু নিজের ভেতরে তাড়না আর স্বপ্নকে সত্যি করার কিছু প্রেরণা। কিন্তু সত্যিকারের স্বপ্নের তো কোন ভাগ নেই...আর যারা সত্যিকারের স্বাপ্নিক তারা হাল ছেড়ে দেয় না।

ডেড পোয়েট সোসাইটি মুভিতে দেখিয়েছে কেন কবিতা প্রয়োজন, সাহিত্য প্রয়োজন। কেন মানুষের নানা কাজের মধ্য দিয়ে কবিতার স্বপ্ন অঙ্কুরিত হয়, কেন গোলাপের সুরভীতে মানুষ দিশেহারা হয়। কারণ মানুষের যান্ত্রিক জীবনকে স্বস্তি দিতে সাহিত্য-সিনেমা-প্রেম এসবের দরকার আছে। যা মানুষকে কঠোরতার ভেতর থেকে বের করে কোমল অনুভূতি এনে দেয়। সিনেমাও তেমন কিছু। সিনেমার স্বপ্ন তার চাইতে আরও অধিক কিছু। আর সিনেমার সাথে সিনেমার চরিত্র এই দুইটার চাইতে ঢের বেশি কিছু!

গোবরে পদ্মফুল
রয় টকিজের কর্ণধার শ্রীকান্ত বাবু, সিনেমার জন্য স্টুডিওর জন্য নিজ প্রিয়তমাকে পর্যন্ত স্বাধীনতা দিয়েছে। রয় টকিজের প্রধান চরিত্র জামশেদ খান। যার সাথে সম্পর্ক সুমিত্রার। সুমিত্রা রূপে-গুণে এবং মানে ফিল্মের হিরোইন, বাস্তবের হিরোইন। আর জামশেদ খানের চোখে-বুকে-মুখে লেগে আছে নায়কোচিত স্বপ্ন। কিন্তু দেশভাগের উত্তাল সময়ে জামশেদ খান চলে যেতে চান বোম্বে ছেড়ে, সাথে সুমিত্রাও তাঁর নায়কের হাত ধরতে চান। কিন্তু শ্রীকান্ত দুর্দান্ত একজন। স্টুডিওর জন্য বউকে এড়িয়ে যাওয়া শ্রীকান্ত তা হতে দেবেন না। বিনোদকে পাঠালেন জামশেদ খানের পথ আগলাতে।

বিনোদ রয় টকিজের বিশ্বস্ত লোক। জান-প্রাণ দিয়ে বাবুর জন্য কাজ করে। কিন্তু বিনোদের মনে আনন্দের রেশ বয়ে নিচ্ছে মদন কুমার। যা সে নিজেই চিত্রিত হতে চায় সেলুলয়েডের ফিতায়। কিন্তু সুযোগ মিলছিল না। অবশেষে জামশেদ খানকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের মুখে ফেলে নিজের মদন কুমার হওয়াটা সে নিশ্চিত করে। আর অভিনয়...সে তো বিনোদের জন্মগত প্রতিভা আর আজন্ম সাধের ব্যাপার। কিন্তু বিনোদ! রয় টকিজের কর্মচারী বিনোদ...সে কিনা মদন কুমারের চরিত্র করবে?

একজন কর্মচারীর মুদন কুমার বনে যাওয়াটা স্টুডিওর লগ্নিকাররা মানতে পারছে না। মদন কুমারের হিরোইন সুমিত্রা কুমারীর তো প্রশ্নই আসে না। উপরন্তু সুমিত্রার সমস্ত শোক আর উৎকণ্ঠা জামশেদকে ঘিরে...শুরু হলো বিনোদের মদন কুমার হওয়ার সংগ্রাম। যে সংগ্রামে তাঁর পাশে শ্রীকান্ত ছাড়া আর কেউই নেই; ওহ হ্যাঁ। রত্না আছে, তাঁর প্রিয়তমা। কিন্তু এই লড়াই কীভাবে করবে বিনোদ !

বিনোদের লড়াই অবশ্য রয় টকিজের সাথে কাজ করতে করতে পোক্ত হয়েছে। সে শিল্পী হতে চায়। শুধুই অভিনয় করে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে চায়। সেখানে অর্থ-বিত্ত, স্বাধীনতা এসব মামুলি মাত্র। শিল্পী হওয়ার বাসনায় শ্রীকান্ত যা বলে তাই মেনে নেয়। সুমিত্রা অবহেলা মেনে নেয়, স্টুডিও এবং লগ্নিকারদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য মেনে নেয়। আর মেনে নেয় শিল্পী হওয়া ছাড়া তার অন্য কোন বাসনা নেই। কিন্তু রয় টকিজের শ্রীকান্ত তাঁর স্টুডিওর স্বার্থে যে কাউকে তুলে আনতে পারে, যে কাউকে ডুবাতে পারে। সবার আগে রয় টকিজ। সেখানে মদন কুমারই আসল কথা; হোক সে জামশেদ খান, হোক সে বিনোদ।

দ্য স্কাই হ্যাজ লিমিট বাট নট ড্রিমস
খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক পাওলো কোয়েলহো বলেছেন- যে সত্যিকার অর্থে কিছু চায় তাঁকে আশপাশের সবাই অর্থাৎ সারা পৃথিবী হেল্প করে। দেশভাগের মাঝামাঝিতে পড়ে খান্না স্টুডিও ছেড়ে রিফিউজি হয়ে যায় জয় খান্না। একটা স্বপ্নের সলিল সমাধি। কতশত স্ক্রিপ্ট, স্ক্রিপ্টের ভেতর কতশত স্বপ্নের জাল আর জাল চিরে বেরোতে চাওয়া কতশত সহিস...সব শেষ।ছেড়ে আসা দেশ ও ফেলে আসা সময়ের নায়ক দিনাতিপাত করছে এখানে ওখানে। ক্ষুধার দায় আর স্বপ্নের অপমৃত্যু একটু একটু করে ঘটছে। কিন্তু আঁকড়ে থাকার রসদ তবুও চায়। হয়তোবা সুদিন ফিরছে দ্রুত...

শরণার্থী হওয়ার দুঃখ আর পেটে অন্ন যোগানোর লড়াইয়ে কাবু জয় অবশেষে বিনোদের দেখা পায়। সেই বিনোদ,যার সাথে দাঙ্গার সময় ঘটনাক্রমে দেখা। দাঙ্গার আগুনে জামশেদ খানকে সঁপে দেওয়ার সময় বিনোদ তাকেও বগলদাবা করে নেয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে জয় বিনোদের করুণার পাত্র। কিন্তু তবুও তো সিনেমার কাছাকাছি থাকা যাচ্ছে, এটাই জয়ের জন্য আকাশ ছোঁয়া পাওয়া।

শ্রীকান্ত বাবু কমান্ডিং এবং ডমিনেটিং। কারও হস্তক্ষেপ পছন্দ করেন না। যেমন মানেন না, জয়ের শিল্পী হওয়ার খায়েশ কিংবা স্ক্রিপ্ট লেখার দুঃসাহস। পাছে আবার মদন কুমার হাত ফসকে যায়। এক জামশেদ গেছে, ভাগ্যিস বিনোদের ভেতরে মুদন কুমারের খায়েশ ছিলো। জয়ের ভাগ্য আবারও তাকে দূরে ঠেলে দেয়। কিন্তু হাল না ছাড়া জয় ঠিকই সিনেমা বানিয়ে হিট করে ফেলে... রঘু, যাকে চাকুতে ঘায়েল করে টাকার হিস্যা মিলাতে চেয়েছিলো সেই রঘু সিনেমা পাইরেসি হয়ে গেলেও বলে: না, জয়। বন্ধ করা যাবে না সিনেমা। দর্শক তোমাকে দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে। সিনেমায় তোমাকে পছন্দ করেছে। হোক ,একটু আধটু ক্ষতি...আবার সেই রঘুই জয়ের ফ্রি করে দেওয়া রোববারের শো’তে স্ন্যাকস বিলিয়ে দেয়...এভাবে জয়-রঘু করে নেয় সময়, শরণার্থী ক্যাম্পের রাজনীতি আর লগ্নিকারক আলিয়া সাবকে। যে কিবা মুদন কুমারের শুরুতে লগ্নি না করার আফসোস নিয়ে থাকে। বা ই ঞ্চু দ মদন কুমার...

হাল ছেড়ো না বন্ধু
সুমিত্রার জামশেদের প্রতি ভালোবাসা যেভাবে বাড়ছে তেমনি বিনোদের প্রতি ঘৃণা বেড়েই চলছিল। ইতোমধ্যে জামশেদকে সরিয়ে দিয়ে বিনোদ মদন কুমার বনেছে, এই ধারণা পোক্ত হয়েছে তার। এদিকে দেশভাগের পরে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সিনেমার মাধ্যমে সমাজতন্ত্র, আমেরিকানতন্ত্র প্রসারে তার সিনেমায় লগ্নি করতে চান। কিন্তু শ্রীকান্ত কারও তাঁবেদারি মেনে নিবে না। এদিকে রেডিওয়ালারা রাশিয়ার সাথে জোট করেছে। সিনেমার গান যদি রেডিওতে প্রমোট করা না হয় তাহলে সিনেমা ফ্লপ। শুরু হলো নিজেদের মধ্যে কলহ আর কোন্দল। সুমিত্রা ফাঁদ পাতে মদন কুমারকে আটকাতে। মদন কুমারের ইতোমধ্যে নিজের মধ্যে অপরাধবোধ জাগে আর জয় সুযোগ চায়, তার যে অভিনয়শিল্পী হওয়া ছাড়া উপায় নাই।

বিনোদের ভেতর থেকে মদন কুমারকে বের করে আনতে সুমিত্রা হাত মেলায় আর নিলুফারের প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে নিজেকে খোলাসা করে আসগরের কাছে। স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ কর আসগর সিনেমা বানাতে চায় আর শ্রীকান্তকে কনভিন্স করে বিনোদ। কিন্তু সিনেমা ফ্লপ হয় আর হাঁড়ির খবর ভেঙ্গে যায়। শুরু হয় ভেঙ্গে যাওয়া কলসি থেকে জল গড়িয়ে যাওয়া...সেই জলে ভেসে যায় রয় টকিজ, নিলুফারের স্বপ্ন, সুমিত্রার ভালোবাসা আর জয়ের হৃদয়ের সাড়া। চারিদিক নীরব, প্রস্থান করে গেছে সবাই...বেঁচে আছে গানের সুর, বৃষ্টিভেজা রোদ্দুর আর বুলেট ছাড়া পিস্তলের খোসা।

শেষ হইয়াও হইলো না শেষ
জামশেদের হাত ধরে দেশান্তরী হতে চেয়েছিল সুমিত্রা। নিলুফার চেয়েছিল একটা জীবন। জয় চেয়েছিল সিনেমার সাথে সংসার আর রয় টকিজের শ্রীকান্ত বাবু চেয়েছিল একটা বিশাল ক্যানভাস। যেখান থেকে কালজয়ী সিনেমাই হবে শুধু। মানুষ দেখবে মুগ্ধ হয়ে, আর শুনবে কান পেতে গান সুমধুর। আলিয়া সাবের বা ই ন ঞ্চু দ মদন কুমার থেকে শিক্ষা নিয়ে জয়কে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, লগ্নি করার খায়েশ তার শেষ। আর রঘু দিলওয়ালা ও স্বপ্নওয়ালা মালিক হতে চায়...কিন্তু জীবন আর সময় পাশাপাশি চলে। সবার সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। কেউ পায় না কেউ পেয়ে হারায়। এভাবে জীবন চলে যায়...আর মদন কুমার একটা খুনের প্লট তৈরি করার জন্য শত খুনের শাস্তি মাথা পেতে নেয়। বাকি থাকে কেবলই রত্না, যে কিনা জেনেশুনে পান করে যায় বিষের পেয়ালা।
এমন সব বাহারি আয়োজনে ‘জুবিলী’ মনে করিয়ে দেয় ভীষণ বিভীষণ। তৃষ্ণা, ক্ষোভ আর ৭৫ বছরের আস্ত একটা ক্যানভাস।

  • মাসুদ পারভেজ রূপাই: কবি ও সাহিত্যিক
  • ইমেইল: [email protected]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত