রুমেল আহসান, ফেঞ্চুগঞ্জ

১৮ মে, ২০২৩ ১০:২৭

শিশিরের বাড়ি ইতিহাসের অন্যরকম সংগ্রহশালা

সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার লামা গঙ্গাপুর গ্রামে শিক্ষক শিশির কুমার নাথের বাড়ি যেন ইতিহাসের জীবন্ত সংগ্রহশালা। ইতিহাসের এই অনন্য সংগ্রহশালায় রয়েছে ১৮৮০ সালে চামড়ার কাগজে লেখা একটি চালানপত্র, জমির প্রাচীন দলিল এবং ১৯২৩, ১৯৩৯ ও ১৯৪২ সালের খাজনা আদায়ের রশিদসহ ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত বিলুপ্তপ্রায় সামগ্রী ও শিল্পকর্ম।

দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপকরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ব্যতিক্রমী এ সংগ্রহশালাটি নিজ বাড়িতে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন বন্দরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিশির কুমার নাথ।

সংগ্রহশালায় রয়েছে পিতলের তৈরি একটি ক্যালেন্ডার। ১৯৯৫ থেকে ২০৯৪ সাল পর্যন্ত এ ক্যালেন্ডারের সহায়তায় বার-তারিখ জানা যাবে।

হাতির দাঁতের তৈরি ঘোড়া, হাতির হাড় দিয়ে তৈরি গয়নার বাক্স, চিঠি পরিবহনের পাত্র, জমিদার বাড়িতে ব্যবহৃত বহু পুরনো পিতল দিয়ে তৈরি চুন রাখার কৌটা ও সিঁদুর রাখার কৌটা।

শিশিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির দুটি কক্ষে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা দুষ্প্রাপ্য অন্তত ৫ শতাধিক বই। তালপাতার পুঁথি, তুলট কাগজে লেখা পুঁথি, নাগরি পুঁথি, কাছাছুল আম্বিয়া, গাজীকালু চম্পাবতী, ভেলুয়া সুন্দরী, লাইলী মজনু, ইউসুফ জোলেখা, আমীর হামজা সহ বেশ কিছু দোভাষী পুঁথি, বিলুপ্ত সাহিত্য পত্রিকা ভারতী, ভারতবর্ষ, মাসিক মোহাম্মদী, প্রবাসী, লাঙল, সওগাত, লোকায়ত, চতুরঙ্গ, বেগম, বিচিত্রা পত্রিকার কপি, শতবর্ষী চিঠি, পোস্টকার্ড, জমিদারি খাজনা আদায়ের রশিদ, ব্রিটিশ আমলের জমিদারি দলিল-দস্তাবেজ, বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ডাকটিকিট, প্রাচীন ভারতের মুদ্রা থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুদ্রা,পাকিস্তান আমল ও স্বাধীন বাংলাদেশের সকল ধরনের ধাতব মুদ্রা, বিখ্যাত ব্যক্তিদের অটোগ্রাফ, কলের গান, রেডিও, টেপরেকর্ডার, ক্যাসেট, বিভিন্ন ধরনের রিলের ক্যামেরা, হুক্কা, গ্রামোফোন রেকর্ড, দোয়াত, বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত কুপি বাতি, কেরোসিন বাতি, হ্যাজাক, জাঁতা, কয়লা চালিত আয়রন, পানবাটা, কাজলদানী, সুরমাদানী, পাথরের বাসন, টেলিফোন, খড়ম, ঢেঁকি, সিন্দুক, ঢাল, ঐতিহ্যবাহী কাঠের ও কাগজের মুখোশ, ঝর্ণা কলম, সুলেখা কালি, তারজালি, মিনাকারি, বিদরি শিল্প,প্যাপিরাসে করা চিত্রকর্ম, পটচিত্র, সরাচিত্র, মাটি ও পাথরের ছাঁচ, কনসার্ট ফর বাংলাদেশের রেকর্ড, মুক্তিযুদ্ধের নাটিকা 'বিক্ষুব্ধ বাংলা', স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রেকর্ড, শোলাশিল্প, হারিয়ে যাওয়া লোকজ খেলনা, রিকশাচিত্র, মৃৎশিল্প, কাঁসাপিতল শিল্প সহ হারিয়ে যাওয়া লোকশিল্প, কাঠের শিল্পকর্ম, ডোকরার শিল্পকর্ম, টেপাপুতুল, লৌকিক পুতুল, শতবর্ষী সারিন্দা সহ বেশ কিছু লোকবাদ্যযন্ত্র, আদিবাসী নিদর্শন, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, মুক্তিযুদ্ধের পোস্টার। সব মিলিয়ে প্রায় হাজারের অধিক বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় সামগ্রী।

শিশির কুমার নাথ বলেন, ছোটবেলা থেকেই গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ অনুভব করি। বাড়ির পুরনো জিনিসপত্রগুলো আগলে রাখার চেষ্টা করতাম। একদিন দাদির কাছে ব্রিটিশ সময়ের কিছু কয়েন পাই। সেই থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত বিলুপ্তপ্রায় সামগ্রী ও শিল্পকর্ম সংগ্রহ করা শুরু করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় ঢাকার পুরোনো জিনিসপত্রের দোকানে প্রায়ই ঢুঁ মারতাম। টিউশনের টাকা বাঁচিয়ে সংগ্রহ করেছি ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত এই জিনিসপত্র। এভাবে সংগ্রহ করতে গিয়ে পরিচয় ঘটে বিভিন্ন সংগ্রাহক ও গবেষকদের সাথে। প্রায় ৮ বছর ধরে সংগ্রহ করছি। সংগ্রহের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে।

শিশির বলেন, সংগ্রহ করাটা আমার আমার ভালোলাগার জায়গা। বরাবরই চেয়েছি বৃত্তের বাহিরে থেকে কাজ করতে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি শিক্ষকতা। শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ে যা পড়ে তা আমার কাছে সরাসরি দেখার সুযোগ পায়। এতে তাদের শিখন স্থায়ী হয়। এসব কাজ আমাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়, আনন্দ দেয়। কালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলো হয়ত আর কখনও ফিরে আসবে না। সংগ্রহ করে না রাখলে তো এসবের ইতিহাসও জানতে পারবে না পরবর্তী প্রজন্ম।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে শিশির কুমার নাথ জানান, এসব নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করার ইচ্ছে আছে। দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণ সকলেরই দায়িত্ব। সেই বোধ থেকে কাজ করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে সংগ্রহের দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখা ও বই প্রকাশের আগ্রহ আছে। নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলতে চাই ইতিহাস ঐতিহ্য-সংস্কৃতি চর্চার উদ্যান। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের আবশ্যকীয় ক্ষেত্র হতে পারে আমার সংগ্রহশালা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত