সাজু মারছিয়াং, শ্রীমঙ্গল

১৪ জানুয়ারি, ২০২৪ ২৩:২০

কুশিয়ারা পাড়ের ঐতিহ্যবাহী পৌষ সংক্রান্তির মাছের মেলা

পৌষসংক্রান্তি মৌলভীবাজারের শেরপুরের মাছের মেলা’ একই সুতোয় গাঁথা হয়ে গেছে। মৌলভীবাজারের মানুষের কাছে শতবর্ষী এই মাছের মেলা এখন ঐতিহ্যের অংশ, একটি উৎসব। অন্য সব হাটবাজার যেমন সারা বছর ধরে চলতে থাকে, শেরপুরের মাছের মেলা বছরে এই একবার শুধু পৌষসংক্রান্তিতে হয়ে আসছে।

কনকনে ঠান্ডা আর হিমেল হাওয়া শীত উপেক্ষা করে বাঙালির ঐতিহ্য পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মৌলভীবাজারের কুশিয়ারা নদীর পাড়ে বসেছে দুই দিনের মাছের মেলা। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন রকমের মাছ নিয়ে মেলায় আসছেন বিক্রেতারা। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত চলে মানুষের আনাগোনা। বেচাকেনায় হই-হুল্লোড় দিয়ে বিক্রি করছেন বিক্রেতা ও আনন্দের সাথে মাছ কিনে নিচ্ছেন ক্রেতারা। শনিবার থেকে দুদিনের এ মেলা বেশ জমে ওঠেছে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে। সোমবার (১৫ জানুয়ারি) শেষ হবে এ মেলার আনুষ্ঠানিকতা। এ বছর এ মেলায় ১০-১৫ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হবে বলে ধারণা আয়োজক কমিটির।

সরেজমিনে দেখা যায়, মাছের মেলা উপলক্ষে বিশেষ করে সনাতনধর্মীরা উৎসবে মেতেছেন তাদের পাশাপাশি সকল শ্রেণিপেশার মানুষ মেলার উৎসবে মেতেছেন। ব্যবসায়ীরা বড়বড় মাছ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে সাজিয়ে রেখেছেন বাজারগুলোতে। মেলায় উঠেছে বাঘাইড়, বোয়াল, কাতল, চিতল, রুই, কাতলাসহ সব ধরনের মাছ। মেলায় বেশ চড়া দাম হাঁকাচ্ছেন মাছ-বিক্রেতারা।

শনিবার (১৩ জানুয়ারি) রাতে মৌলভীবাজারের কুশিয়ারার পাড়ে শুরু হওয়া এ মেলায় জড়ো হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন হাওড় ছাড়াও দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিশাল বিশাল আকৃতির মাছ আসে এ মেলায়। রাত ও দিনব্যাপী বড় বাঘাইড়, বোয়াল, রুই, কাতলা ও চিতলসহ নানা প্রজাতির রকমারি মাছ বেচা-কেনা হয় এ মেলায়। মাছের গন্ধে মৌ মৌ করে ওঠে পুরো এলাকা। মেলায় ছোট আকারের মাছের দাম হাঁকানো হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা, মাঝারি সাইজের মাছের দাম হাঁকানো হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং বড় সাইজের মাছের দাম ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকাও হাঁকানো হয়।

ক্রেতারা জানান, মেলায় নানা জাতের বড় আকারের মাছ উঠলেও দাম বেশ চড়া। বিক্রেতাদের সঙ্গে দরাদরি করে মাছ কিনে নিতে হয়। তার পরে-ও সবাই সাধ্য মতো মাছ ক্রয় করছেন। মাছ বিক্রেতা বকুল পাল, অধন পাল বলেন, আমরা সব ধরনের মাছ নিয়ে এসেছি। মাছের মেলা উপলক্ষে সবাই বড় মাছটাই বেশি কিনেন। মাছের দাম একটু বেশি থাকায় আমরাও কিছুটা দাম বেশি চাচ্ছি।

মাছেরই কদর বেশি। বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারের হাকালুকি, কাউয়াদীঘি, হাইল হাওরসহ কুশিয়ারা নদীর মাছের জোগান থাকে এই মেলায়। এবারও স্থানীয় মুক্ত জলাশয়ের মাছ মেলায় উঠেছে। আড়তগুলোতে সেই মাছ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তবে স্থানীয় মাছের পরিমাণ কম। দামও বেশি।

খুচরা মাছ বিক্রেতারা আসছেন, দরদাম করছেন। দামে পোষালে সেই মাছ নিয়ে যাচ্ছেন। এবার স্থানীয় হাওর-নদীর মাছের মধ্যে বড় আকারের মাছ খুব বেশি নেই। মহসিন মিয়াসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী বড় আকারের বেশ কিছু বাঘাড়, বোয়াল, আইড়জাতীয় মাছ মেলায় নিয়ে এসেছেন। প্রায় ৪৪ কেজি ওজনের একটি বাঘাড়ের দাম চাওয়া হয়েছে ১ লাখ টাকা। ১০ থেকে ১৮ কেজি ওজনের বোয়ালের কেজিপ্রতি দাম চাওয়া হয়েছে ১ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা। ১১ থেকে ১২ কেজি ওজনের আইড় মাছের কেজি চাওয়া হয়েছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা। এ ছাড়া রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, কালবাউশসহ বিভিন্ন জাতের ছোট-বড় মাছ উঠেছে মেলায়। এসব মাছ সারা বছর ধরে শেরপুরের মাছের মেলার জন্য সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। মেলার কিছুদিন আগে থেকে এই মাছ ধরা, সংগ্রহ করা শুরু হয়।

বাজারে মাছ কিনতে আসা নিমাই মালাকার বলেন, পৌষ-সংক্রান্তি উৎসব উপলক্ষে প্রতি বছর মাছের মেলা বসে পুরো জেলা জুড়ে। মেলা উপলক্ষে বছরে একদিন বড়বড় বিভিন্ন জাতের মাছ দেখা যায়। যে যার মতো করে এক বাজার থেকে অন্য বাজার ঘুরে দাম দেখা মাছ ক্রয় করছেন। আমরাও মাছ কিনেছি।তবে এবার বাজার থেকে নয় শেরপুরের মেলা থেকে কিনলাম। প্রায় ২৫ হাজার টাকা দিয়ে একটা চিতল মাছ কিনেছি। বাজারে মাছ দেখতে পরিবারের বাচ্চারাও এসেছে।

মেলা এলাকার খলিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু মিয়া চৌধুরী বলেন, বাঙালীর ঐতিহ্য পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে এ মেলা প্রায় দুইশত বছরের পুরানো ঐতিহ্য। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাছ আসে এখানে। উৎসবমুখুর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মানুষ তাদের সাধ্যমতো মাছ কিনে নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছে। এক সময় মুনুর মুখে এ মেলা বসতো। প্রায় দেড়শ বছর আগে এটি চলে আসে কুশিয়ারা নদীর তীরে।

মেলা পরিষদের সদস্য মো. আরিফ আলী জানান, গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর মেলা জমে উঠেছে। ব্যবসায়ীরাও ভালো ব্যবসা করছেন। ক্রেতা-বিক্রেতাদের আনাগোনা এবার অনেক বেশি। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মেলায় এসেছে। তিনি আরও বলেন এ বছর এ মেলায় ১০-১৫ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মৌলভীবাজার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ কে এম নজরুল বলেন, শেরপুর মাছের মেলাকে কেন্দ্র করে উক্ত স্থান সহ আশেপাশে এলাকায় কোন প্রকার অসামাজিক কার্যকলাপ, হাউজি, ওয়ানটেন, গুটি, পুতুল নাচ, অশ্লীল নৃত্য সহ যাত্রাপালা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এই ধরনের কোন তথ্য থাকলে দয়া করে অফিসার ইনচার্জ, সদর মডেল থানা মৌলভীবাজারকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ জানান।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত