অসীম চক্রবর্তী

১৯ জানুয়ারি, ২০১৬ ০২:১৭

নিওলিথিক এবং ব্রোঞ্জ যুগের স্টোনহেঞ্জ এবং রোমান নগরী বাথ পরিক্রমা

ব্রিটেনে ডিসেম্বরে কনকনে ঠাণ্ডা পড়বে এ তো স্বাভাবিক।কিন্তু মাসের ৩১ দিনের মধ্যে যে দিন ৩মাস আগে থেকে বুকিং করা, সেই দিনেই বিনামেঘে রৌদ্রপাত হবে সেটা ভয়ংকর রকমের সৌভাগ্যের বিষয় নয়কি ? গত ২৮শে ডিসেম্বরে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল স্টোনহেঞ্জ এবং বাথ ভ্রমণের সময়। সারা ডিসেম্বর ধরে বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ার প্রকোপে শীত মামা ঝাঁকিয়ে বসলেও ২৮সে ডিসেম্বর ছিলো রৌদ্রজ্জ্বল সুন্দর একটি দিন। সম্ভবত ডিসেম্বরের গত হওয়া ২৮দিনের মধ্যে আমরা সবাই ওইদিন প্রথম সূর্য দর্শন করলাম।

ভোর ছয়টায় আমরা চারজন পিএইচডি স্টুডেন্ট, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং আমার সহধর্মিণী মৌনী মুক্তা  সহ ছয়জনের বিশাল টিম যাত্রা শুরু করলাম। গন্তব্য লন্ডন থেকে ১৩৬ কিলোমিটার দূরত্বে'র প্রায় তিনহাজার খ্রিস্ট পূর্ব স্থাপত্য স্টোনহেঞ্জ এবং রোমান নগরী বাথ।

সকাল ৬.৩০ বাজে। প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে সবাই পূর্ব-লন্ডনের স্ট্রাটফোর্ড শপিং সেন্টারের সামনে জড়ো হলাম। ইতিমধ্যে আমাদের পূর্ব নির্ধারিত সেভেন সিটার ফোর্ড গাড়িটিও এসে উপস্থিত। সকালের হালকা নাস্তা শেষ করেই সবাই হুড়মুড়িয়ে উঠে গেলাম গাড়িতে। ভয়ংকর ভাবে মনের মধ্যে উথলে উঠলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বনভোজনের স্মৃতি। ১৯৯৯ সাল গণিত বিভাগের বনভোজন। স্থান মাধব কুণ্ড। সাথে ছিলো কল্যাণ, সঞ্জয়, হ্যাপি, জলি সহ অনেক বন্ধুরা। সেবারই নাকি সবাই প্রথম এবং শেষবারের মতো প্রচণ্ড গম্ভীর বিভাগীয় প্রধান হৃষিকেশ স্যারের মুখে হাসি দেখেছিলো।

একটু পরেই সকালের সোনা রোদ ঝলমলিয়ে উঠল। অনেকদিন বাদে দেখলাম ভোরের সূর্যোদয় । ইতিমধ্যে আমাদের বাহন লন্ডনের ইট পাথরের জঙ্গল ভেদ করে মোটরওয়েতে উঠে পড়েছে। যান্ত্রিক শহর লন্ডন থেকে বেরিয়েই চোখে পড়ল জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো দিগন্তজোড়া মাঠ, ফসলের ক্ষেত আর সবুজ বনানী।

প্রায় তিন ঘণ্টা ড্রাইভিং শেষে আমাদের বাহন পৌছালো যুক্তরাজ্যের ওয়াল্টশায়ার কাউন্টিতে বিশাল সমতল ভূমিতে খাড়া পাথরের তৈরি এক বিস্ময়কর স্থাপনার কাছাকাছি। যে স্থাপনা আমরা সারা জীবন উইন্ডোজ এক্সপি তে ওয়াল পেপার হিসাবে দেখে এসেছি। যার নাম স্টোনহেঞ্জ।

গাড়ি পার্ক করে প্রথমেই সবাই দৌড়ালো প্রকৃতির ডাকে। শৌচ কর্ম সেরে লাইন দিলাম টিকেট কাউন্টারে। জন প্রতি পনের পাউন্ড প্রবেশ মূল্য থাকলেও ছাত্র হিসাবে প্রায় ২০% ছাড়ে টিকেট কেনা হলো। কেনা হলো ধূমায়িত কফি আর হাঁটা শুরু হলো প্রায় মাইল খানেক হাঁটার রাস্তা দূরত্বে মানব ইতিহাসের সাক্ষী স্টোনহেঞ্জ দর্শনে। চারদিকে অবারিত সবুজ মাঠ। সেই মাঠের বুক চিরে চলে গেছে আঁকাবাঁকা রাস্তা। যে রাস্তা শেষ হয়েছে সবুজ মাঠের মাঝখানে গোলাকার পাথরের তৈরি মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন স্টোনহেঞ্জ’র সামনে ।

স্টোনহেঞ্জ মূলত: নিওলিথিক এবং ব্রোঞ্জ যুগের একটি স্তম্ভ। ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে এটি মানমন্দির হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আবার কারও কারও মতে, এটি আসলে একটি বিশেষ স্মৃতিস্তম্ভ। আবার কতক গবেষক মনে করেন প্রাচীন যুগের একটি কবরস্থান এটি। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানীরা জায়গাটি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য কোনো তত্ত্ব বা প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৮ মাইল উত্তরে অবস্থিত স্টোনহেঞ্জ। কতগুলো বড় দণ্ডায়মান পাথর বৃত্তাকারে দাঁড় করানো। ১৩ ফুট লম্বা ধূসর বেলে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে স্টোনহেঞ্জে। এটিকে মানুষের নিজের হাতে তৈরি প্রাগৈতিহাসিক যুগের একমাত্র নিদর্শন মানা হয়। ১৩ ফুট লম্বা বেলে পাথরগুলোকে প্রায় বৃত্তাকারে মাটিতে পুঁতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। সব পাথরের উচ্চতা মোটামুটি সমান। সেগুলোর মাথায় লিনটেল বা আড়া ব্যবহার করে একটির সঙ্গে অন্য পাথরটিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। লিনটেল হিসেবে ব্যবহৃত পাথরগুলোও বিশাল আকৃতির। এসব তো বটেই পুরো স্টোনহেঞ্জের গঠনকে বেশ জটিলই বলা যায়।

এর বাইরের দিকে একটি বৃত্তাকার পরিখা রয়েছে। প্রবেশপথটির কিছুটা দূরেই রয়েছে মাটির বাঁধ। এ বাঁধের ভেতর চতুর্দিকে বেষ্টন করে আছে ৫৬টি মাটির গহ্বর। পাথরগুলোর মধ্যে আরও দুই সারি গর্ত বেষ্টন করে আছে। পাথরগুলোর গঠনের মধ্যে আছে দুটি বৃত্তাকার এবং দুটি ঘোড়ার খুরের নলের আকারবিশিষ্ট পাথরের সারি। এ ছাড়াও কতগুলো পৃথক পাথর রয়েছে এখানে। তার মধ্যে রয়েছে অলটার স্টোন বা পূজা বেদির পাথর ও শ্লটার স্টোন বা বধ্যভূমির পাথর। এই স্তম্ভটি যারাই নির্মাণ করুক না কেন এর নির্মাণে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মানা হয়েছে সেটি পরিষ্কার। ১৩ ফুট উচ্চতার পাথরগুলো সাজানোর রূপটিতে জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। ভালো করে লক্ষ করলে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার স্থাপত্যের সঙ্গে এটির বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্থাপত্যের চারপাশজুড়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় বেশ কিছু প্রাচীন কবর রয়েছে। গবেষকদের ধারণা, সব মিলিয়ে এখানে প্রায় কয়েকশ কবর রয়েছে। নির্মাণশৈলীর এমন রহস্যময়তা ও বৈচিত্র্যের কারণে মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্য তালিকায় স্টোনহেঞ্জের নাম রয়েছে। ৪০০০ বছর ধরে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, তুষারপাত সব উপেক্ষা করে এখনো সেই স্মারকটি তার নির্মাণের সব যন্ত্রপাতির চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

স্টোনহেঞ্জের নির্মাতা, নির্মাণের উপকরণ এবং নির্মাণকাল নিয়ে যেমন বিতর্কের শেষ নেই, তেমনি রহস্যের শেষ নেই এর কার্যকারণ নিয়েও। বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন ঠিক কী কারণে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বিখ্যাত ব্রিটিশ পণ্ডিত উইলিয়াম স্টাকলে তার বিখ্যাত এক বইয়ে স্টোনহেঞ্জকে গ্রীষ্মকালীন সূর্যোদয়ের মানমন্দির বলেছেন।

প্রায় এ মতকেই সমর্থন করেছেন বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ডিউক। তার মতে, সেলিসব্যারিতে নির্মিত স্তম্ভগুলো একত্রে একটি সৌরমণ্ডলের রূপ পরিগ্রহ করে। দক্ষিণ ইংল্যান্ডের অনেক জায়গায়ই এ ধরনের রহস্যময় পাথরখণ্ড রয়েছে। এর অধিকাংশ পাথরকেই আকাশমুখো করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আর এগুলোকেই একসঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ সৌরমণ্ডল বলেছেন বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড। তার মতে, এখানে একেকটি স্থাপত্য একেকটি গ্রহের অবস্থান নির্দেশ করছে। এর মধ্যে আমাদের আলোচিত স্থাপত্য স্টোনহেঞ্জ শনি গ্রহের স্থান নির্দেশ করছে।

মজার ব্যাপার হলো, ১৯৬৩ সালে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ জেরাল এস হকিন্স ও স্যার নর্মান লকিয়ার স্টোনহেঞ্জকে বিশেষ এক ধরনের কম্পিউটার হিসেবে অভিহিত করেন। তাদের মতে, বিশেষ কম্পিউটার স্টোনহেঞ্জ দিয়ে সূর্যের অবস্থান, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ ইত্যাদি নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হতো।

বহু বিশেষজ্ঞ স্টোনহেঞ্জকে প্রাচীন জাদুর কেন্দ্রস্থল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ২০০৮ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকরা এটিকে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সমাধিস্থল বলে দাবি করেন। তাদের মতে, খ্রিস্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগে এর প্রথম খননকাজ শুরু হয়। এর পর থেকে ৫০০ বছর ধরে এখানে    ও সমাধিকরণ প্রক্রিয়া চলে আসছে। স্টোনহেঞ্জ যেখানে তৈরি করা হয়েছে, তার থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে স্টেডিয়ামের মতো আকৃতির আরও দুটি স্থাপনা পাওয়া গেছে। এ দুটো কাঠের তৈরি। এগুলো কোন কাজে ব্যবহৃত হতো কিংবা এর সঙ্গে স্টোনহেঞ্জের কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা এ সম্পর্কেও কোনো তথ্য বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত দিতে পারেননি। স্টোনহেঞ্জ নিয়ে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের এই যে মতভেদ ও বিতর্ক সেটিই একে অনন্য করে তুলেছে। করে তুলেছে আরও বেশি রহস্যমণ্ডিত। তবে যারাই যে উদ্দেশ্যে এটিকে বানিয়ে থাকুন না কেন, কোনো না কোনো উদ্দেশ্য হয়তো ছিল। সে উদ্দেশ্য সফল হোক বা না হোক অনন্য ও রহস্যময় একটি স্থাপত্য হিসেবে ইতিহাসের পাতায় এটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আর স্থাপত্য হিসেবে অনন্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৬ সালে ইউনেস্কো একে 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট' হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

স্টোনহেঞ্জের প্রাচীন নিদর্শন দর্শন শেষে অজস্র ছবি আর সেলফি তুলে ক্লান্ত শরীরে আবার হাঁটা শুরু করলাম কার পার্ক অভিমুখে । ততক্ষণে সূর্য মধ্য গগনে। ক্ষিদায় নাড়িভুঁড়ি হজমের উপক্রম। শুরু হলো গুগোল ম্যাপে স্থানীয় খাবারের দোকানের খোঁজ। শম্বুক গতির অন্তর্জালে আবদ্ধ হয়ে অবশেষে পাওয়া গেলো ফাস্ট ফুড শপ ম্যাকডোনাল্ডের দেখা। চিকেন বার্গার, পটেটো চিপস আর চিজ দিয়ে পাকোড়ার মতো একটা বস্তু যার নাম চিজ বাইটস। এই দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন শেষে আবার যাত্রা শুরু হলো। গন্তব্য রোমান নগরী বাথ।

ব্রিটেনে শীতের দিন খুবই সংকীর্ণ। বিকেল তিনটা থেকেই ঠাণ্ডা জুজু বুড়ির মতো জেঁকে বসে। সূর্যকে প্রায় জোর করে অস্তগামী করে ব্রিটেনের বুকে নেমে আসে অন্ধকার। প্রায় দুঘণ্টা ড্রাইভ শেষে আমাদের ফোর্ড গাড়িটি এসে পৌছালো ঐতিহাসিক রোমান নগরী বাথে।

‘বাথ’ – কি অদ্ভুত নাম শহরের। স্নানাগার বা স্নান – এমন নাম কি আমরা কোনো শহরের রাখতাম কস্মিনকালেও। অথচ ব্রিটেনের বাথ শহরটিকে UNESCO স্বীকৃতি দিয়েছে ‘World Heritage Site’ হিসেবে কারণ এই শহর প্রায় ২০০০ বছরের প্রাচীন, এর শরীরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে রোমান সময় থেকে ভিক্টোরিয়ান সময়ের ইতিহাস।

ধীরে ধীরে অন্ধকারের আস্তরণে ঢেকে যাচ্ছিলো  চারদিক। কিন্তু আমরা কি ডরাই কভু শীতল বরফে! ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বাথ – ব্রিটেনের একমাত্র উষ্ণ প্রস্রবণকে ঘিরে গড়ে ওঠা শহর। এটি Aqual Sulis বা Aqual Caldiac নামে পরিচিত ছিল যার আক্ষরিক অর্থ গরম জল।   প্রথম শতকে ব্রিটেনের দক্ষিণভাগ রোমানরা অধিকার করে নেয়। এ অঞ্চলে তখন ‘দোবুন্নি’ আদিবাসীদের বাস, তারা উষ্ণ প্রস্রবণকে দেবতাঞ্জানে পূজো করত। ‘দবুন্নি’দের পরাক্রান্ত করলেও রোমানরা ‘সুলিস‘ দেবীর আক্রোশে পড়তে চায়নি। দেবীর প্রসন্নতার আশায় রোমান কারিগরি বিদ্যার সহায়তায় প্রায় ১৫ বছরের চেষ্টায় উষ্ণপ্রস্রবণকে কেন্দ্র করে খ্রিস্ট্রীয় ৭৫ সালে সুলিস মিনার্ভা দেবীর মন্দির তৈরি করে। পরবর্তীকালে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ লুপ্ত হলেও মন্দির সংলগ্ন স্নানাগার এখনো বর্তমান তার ২০০০ বছরের স্মৃতি নিয়ে।

এগারো বর্গমাইলের এই শহরের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত ‘এভন’ নদী। এভন নদী পেরিয়ে একটু এগোতেই ক্যাথিড্রালের চুড়া দেখা গেল।সেই চূড়া বরাবর শহরের একেবারে কেন্দ্রে এই ‘রোমান বাথ’ অবস্থিত। বস্তুত ‘রোমান বাথ‘কে কেন্দ্র করে এই শহর গড়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের আনাগোনায় সারাবছরই ব্যস্ত থাকে বাথ। রোমান সময়েও বহু দূর-দূরান্ত থেকে ১৮ মাস বয়স থেকে শুরু করে ৮৬ বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আসত সুলিস মিনার্ভা দেবীর পীঠস্থানে রোগমুক্তির আশায়।

রোমানদের প্রযুক্তিবিদ্যার পারদর্শিতা এই স্নানাগারের প্রতিটা কোণে স্পষ্ট। উষ্ণপ্রস্রবণের চারদিক দস্তাপাত দিয়ে ঘিরে সেই জল সুচারু ভাবে ছোট ছোট নালা দিয়ে স্নানাগারের বিভিন্ন ঘরে পাঠানো হত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। রোমানদের সামাজিক জীবনে এই স্নানাগারের একটা বড় ভূমিকা থাকত। কারণ সে সময়ে স্নান করা ছিল রীতিমত বিলাসিতা। এই বাথটিতে একটা ঘর ছিল স্টিম নেবার জন্য, এখনকার সাওনা বাথ এর আদলে- যেখানে দাস-দাসী থাকত গায়ে সুগন্ধি তেল মাখিয়ে দেবার জন্যে। এর পাশে ছোট ঘর বেশ কয়েকটি যাতে কম তাপের জল রাখা থাকত – এখানে কিছু সময় কাটিয়ে তারপর প্রধান স্নানাগারে যাওয়া যেত যার উষ্ণতা ৪৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড।

এই গ্রেট বাথটিতে গরম জল আসত সরাসরি প্রস্রবণ থেকে। হাজার বছর আগে গ্রেট বাথটি ছিল শহরের সামাজিক খবর আদান প্রদানের মুখ্য কেন্দ্র। এখানেই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থেকে শুরু করে দিন মজুর অবধি সবাই জমা হত এবং কোথায় কি ঘটছে, নতুন কি আইন তৈরী হচ্ছে, জিনিষের দাম কতটা ওঠানাম করছে – সব কিছু বিস্তারিত আলোচনা হত গ্রেট বাথে স্নান করতে এসে। এর পরের ঘরে থাকত ঠান্ডা জল যেখানে স্নান করার পর সম্পূর্ণ হত স্নান পর্ব।

বিস্ময়ের ঘোরকে সঙ্গী করে সুলিস মিনার্ভা দেবীর উদ্দ্যেশ্যে প্রণাম সেরে বেরোবার ঠিক মুখেই দেখি একটা কল থেকে অবিরত উষ্ণপ্রস্রবণের পানযোগ্য জল বেরোচ্ছে। এই জল খেয়ে আমার ছোটবেলার গোলাপগঞ্জের  বাড়ির সামনের টিউবওয়েলের জলের স্বাদ মনে পড়ে গেল। অনেকটা সেই রকম কষ্ স্বাদের যদিও এতে বারুদের গন্ধ অত্যন্ত বেশী কারণ ৪২ রকম ধাতু সমৃদ্ধ এই জলে সালফেটের পরিমাণ অত্যন্ত বেশী। ভৌগোলিকভাবে এটি একটি জিওথার্মাল প্রস্রবণ। প্রায় ১০,০০০ বছর আগে বাথ অঞ্চলের দক্ষিণে অবস্থিত ‘মেন্ডিপ’ নামক চুনাপাথরের পাহাড়ে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে প্রায় ১৪,০০০ ফুট নীচে জমা হয় যেখানে তাপমাত্রা ৬৯ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। সেই তাপের সংস্পর্শে এসে এবং পরবর্তিকালে ভূ-ত্বকের ফাঁক ফোকর খুঁজে এই জমা জল বেবিয়ে আসতে শুরু করে উষ্ণ প্রস্রবণ হিসেবে।

এখান থেকে বেড়িয়ে কয়েক পা এগোলেই বাথ আ্যবি চার্চ। এর মধ্যে শুরু হলো টিপ টিপ বৃষ্টি। বৃষ্টিতে  সেই কয়েক পা এগোতেই মানুষজনকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এক মহিলা আমাদের সামনেই সপাটে আছাড় খেলেন, আমিও বেশ কয়েকবার হড়কেও যে কি করে শেষ অবধি সামলালাম জানিনা। এই বাথ আ্যবিও প্রায় হাজার বছরের পুরোনো।

ব্রিটেনের গথিক আর্কিটেকচারের সুন্দর উদাহরণ স্বরূপ এই চার্চটি বহুবার আগুন ও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অতীতে। ধর্মীয় প্রভাব ছাড়াও সামারসেট অঞ্চলের সামাজিক জীবেনেও এই চার্চের অবদান অনস্বীকার্য। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে বাথ স্ব-মহিমায় মহিম। এলিজাবেথের সময়ে বাথ প্রথম শহরের মর্যাদা পায়। ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে গৃহযুদ্ধের সময় প্রথম চার্লসের প্রধান ঘাঁটি ছিল বাথ। জর্জিয়ান যুগে বাথ শহরের সম্পূর্ণ নবীকরণ করেন স্থপতি জন উড ও তার পুত্র জুনিয়ার জন উড। রাস্তার নক্সা বদলে বেশ কয়েকটি গোলাকৃতির প্রাসাদতুল্য বাড়ি নির্মাণ করেন যা ‘সার্কাস’ ও ‘রয়্যাল ক্রেসেন্ট’ নামে পরিচিত।

পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বহুবার পিছ্লে, কোনোমতে সামলে শহরটা সম্পূর্ণ ঘুরে যখন ফিরছি তখন দূর থেকে গিটারের সুর ভেসে আসছে। পরদিন ততক্ষণে গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করে চলেছে রোমান বাথ নগরীকে।  সব প্রাগৈতিহাসিক প্রাচীন ভবনগুলোতে জ্বলে উঠেছে নানা রঙের আলোর বাহার।  যে আলোর ছটায় অদ্ভুত বাথ নগরী জানান দিচ্ছিলো প্রাচীন রোমান সম্রাটের জৌলস, আভিজাত্য আর রুচির বাহার। 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত