
০২ এপ্রিল, ২০২৪ ০৩:০৩
অটিজম কী?
অটিজম কোন সাধারণ রোগ নয়। এটি শিশুদের একটি মনোবিকাশগত জটিলতা যার ফলে সাধারণত ৩টি সমস্যা দেখা দেয়-
১. মৌখিক কিংবা অন্য কোনো প্রকার যোগাযোগ সমস্যা
২. সামাজিক বিকাশগত সমস্যা
৩. খুব সীমাবদ্ধ ও গণ্ডিবদ্ধ জীবন-যাপন ও চিন্তা-ভাবনা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ। এছাড়া অতি চাঞ্চল্য (hyperactivity), জেদি ও আক্রমণাত্মক আচরণ (Aggressiveness), অহেতুক ভয়ভীতি, খিঁচুনি ইত্যাদিও থাকতে পারে।
অটিজমের প্রকোপ:
বিশ্ব স্বাস্থ্য ও কমিউনিকবল ডিডিজ কন্ট্রোলের বরাত দিয়ে আমেরিকায় কর্মরত শিশু মনোবিজ্ঞানী ড. এম হক জানান, বিশ্বে ১ শতাংশ অটিজমে আক্রান্ত শিশু। প্রতি ৬৮ জন শিশুর ১ জন অটিজমে আক্রান্ত।
ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে অটিজম হবার সম্ভাবনা মেয়ে শিশুদের চেয়ে ৪-৫ গুণ বেশি।
দেশের সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্যমতে, দেশে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী।
আন্তর্জাতিকভাবে কোনো দেশের মোট প্রতিবন্ধীর ১ শতাংশকে অটিজমের শিকার বলে ধরে নেওয়া হয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধী সনাক্তকরণ জরিপ অনুযায়ী (২০১৮) দেশে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৪২ হাজার ৪৫০।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর হার ৩ শতাংশ আর ঢাকার বাইরে দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে তা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।
অটিজম কেন হয়?
অটিজমের কারণ সম্পর্কে এখনও কোন নির্দিষ্ট বিষয় চিহ্নিত করা যায়নি।
মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক জৈব রাসায়নিক কার্যকলাপ (সেরোটোনিন), মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক গঠন, বংশগতির অস্বাভাবিকতা, এমনকি বিভিন্ন টিকা প্রয়োগ থেকে এই রোগ হতে পারে বলা হলেও নির্দিষ্ট করে কিছু এখনো জানা সম্ভব হয়নি।
বাবা-মায়ের বয়স অবশ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
গর্ভকালীন ভাইরাল (জিকা, রুবেলা ইত্যাদি) ইনফেকশন
গর্ভকালীন জটিলতা এবং
বায়ু দূষণকারী উপাদানসমূহ স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার হওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
বিভিন্ন জীনের কারণে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার হতে পারে।
আবার কোন কোন শিশুর ক্ষেত্রে জেনেটিক ডিজঅর্ডার যেমন- রেট সিন্ড্রোম বা ফ্র্যাজাইল এক্স সিন্ড্রোমের সাথে এই রোগটি হতে পারে।
কিছু জীন মস্তিষ্কের কোষসমূহের পরিবহন ব্যবস্থায় বাধা প্রদান করে এবং রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি করে।
জেনেটিক বা জীনগত সমস্যা বংশগতও হতে পারে আবার নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই এই রোগটি হতে পারে।
ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধকের দেয়া বা না দেয়ার সাথে অটিজমের কোনও সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
অটিজম কথা বলে; কান পেতে রই
নিচের লক্ষণগুলি দেখা দিলে অবশ্যই শিশুকে নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুর বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. এদের ভাষার বিকাশ হতে বিলম্ব হয়। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারে না (স্বল্প কথা জানে, ইশারায় কথা বলতে পছন্দ করে,অযথা গুনগুন করে)
২. এরা সমবয়সী কিংবা অন্যান্যদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না।
৩. এরা নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেয় না এবং আপন মনে থাকতে পছন্দ করে।
৪. এরা অন্যদের চোখের দিকে তাকায় না। অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসে না কিংবা আদর করলেও ততটা সাড়া দেয় না।
৫. একই কথা পুনরাবৃত্তি করে এবং একই কাজ বার বার করতে পছন্দ করে। দৈনিক কাজের রুটিন বদল হলে খুবই উত্তেজিত হয়।
৬. এদের কাজ- কর্ম এবং সক্রিয়তা সীমিত ও গণ্ডিবদ্ধ। পরিবেশ এবং আশেপাশের কোন পরিবর্তন খুব অপছন্দ করে।
৭. এরা কখনো অতি সক্রিয় আবার কখনো খুব কম সক্রিয় হয়। অতি-সক্রিয়তা থেকে কখনো খিঁচুনি হতে পারে।
৮. সাধারণত খেলনা দিয়ে কোন গঠনমূলক খেলা বা কল্পনাপ্রসূত খেলা খেলতে পারে না অথবা কোন বিশেষ খেলনার প্রতি অত্যধিক মোহ দেখা যায় এবং সেটি সব সময় সাথে রাখে।
৯. কখনো মনে হতে পারে যে এরা কানে শুনতে পায় না। এরা মাকে বা অন্য কোন প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরে না এবং তাদের কেউ ধরলেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় না অথবা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
১০. কোন বিশেষ সংবেদন-এর প্রতি অস্বাভাবিক আচরণ করে যেমন আলোতে চোখ বন্ধ করা, শব্দ শুনলে কানে হাত দেওয়া, দুর্গন্ধে কোন প্রতিক্রিয়া না করা, স্বাদ ও স্পর্শে তেমন কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ না করা।
১১. জড় বস্তুকে মানুষের মত মনে করে, জিনিসপত্র চাটতে ভালোবাসে।
অটিজম সনাক্তকরণের জন্য কোথায় যাবেন?
এই সেবা দিয়ে আসছে হাতে গোনা কয়েকটি সেন্টার যেমন- বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বহিঃবিভাগ; সেন্টার ফর নিউরোডেভালাপমেন্ট ও অটিজম ইন চিলড্রেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা; শিশু বিকাশ কেন্দ্র, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অটিজম সনাক্তকরণে যথাযথ ব্যবস্থা আছে; এছাড়াও সিআরপি (মিরপুর, ঢাকা) ও সিআরপি (সাভার, ঢাকা)-তে এই কার্যক্রম চালু আছে।
অটিজমের কোন চিকিৎসা আছে কি?
এখন পর্যন্ত অটিজমের কোন চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি। তবে নিজেদের সম্পূর্ণ অসহায় মনে করাও সঠিক নয়। বিশেষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, পিতা-মাতা ও আপনজনদের শ্রম ও যত্ন এবং এই রোগের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সহায়ক দলের একত্রে কার্যক্রমে শিশুর বিকাশ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হলেও একটি শিশুকে স্বাধীন জীবন-যাপন করার মত পর্যায় আনা সম্ভব হয়। (প্রায় ৮০ ভাগ স্বাভাবিক)
এপ্লায়েড বিহেভিয়ার এনালিসিস বা একজনের তত্ত্বাবধানে একজন অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে স্বাভাবিক ব্যবহার শেখানো হয়।
কিছু ঔষধপত্র প্রয়োগ যা তার অন্যান্য শারীরিক অসুবিধা দূরীকরণে সহায়তা করে।
ধারনা করা হয় গ্লুটেইন মুক্ত খাবার অটিজমের শিশুকে ভাল রাখে।
Omega-3, Omega-6, Vit-B-6, Vit-B-12 ও Vit-D সাপ্লিমেন্ট ভালো কাজ দিতে পারে
অটিজমের চিকিৎসা বহুমাত্রিক অভিগমন। সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। যেমন- মনোচিকিৎসক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবিদ, স্পিচ থেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, শিক্ষক, সমাজকর্মী, জনপ্রতিনিধি প্রমুখ। এবং পুরোটা সমন্বয় ও মূল ভূমিকা পালন করবে বাচ্চার অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যবৃন্দ।
একজন মনোচিকিৎসকের ভূমিকা
অটিজম স্কুল কোথায় পাবেন?
এ ধরনের শিশুর বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুটিকে সার্বক্ষণিক সহায়তা প্রদান। দ্রুততার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া যা শিশুটির ভাষা বিকাশ, সামাজিক বিকাশ, স্বাবলম্বীতার বিকাশ, বিশেষ দক্ষতার বিকাশ এবং অন্যান্য স্বকীয়তা অর্জনে সহায়তা করবে।
ঢাকার মিরপুর-১৪ এ জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্রের অধীন ‘স্পেশাল স্কুল ফর অটিস্টিক চিলড্রেন’ জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্রের বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রমে একটি নব সংযোজন। ২০টির মত অটিস্টিক স্কুল আছে ঢাকায়। কিছু বেসরকারি স্কুল আছে। যেমন, অটিজম স্কুল ঢাকা, কেরানীগঞ্জে ইন্টারন্যাশনাল অটিজম স্কুল প্রভৃতি। অটিস্টিক শিশুদের কল্যাণ ফাউন্ডেশন স্কুল, প্রয়াস, চট্টগ্রাম। সিলেটে অটিজম ম্যানেজমেন্ট সেন্টার, স্কুল অফ জয়, সিলেট আর্ট এন্ড অটিস্টিক স্কুল।
৬৪টি জেলায় অটিজম স্কুল খোলার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর সুপারিশ করেছে।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুর অভিভাবকের করণীয়:
ছন্দে ছন্দে অটিজম
অটিজম বোঝা নয়। সম্ভাবনার নতুন সম্ভার
অটিজমে শিশুরা কখনো কখনো বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শী হয়। এই ধরনের শিশুদের তাই বিশেষ প্রয়োজন সম্পন্ন শিশু বা বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদাসম্পন্ন বলা হয়।
যথাযথভাবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে বিধায় এদের প্রতিবন্ধী আখ্যায়িত করা সঠিক নয়।
তারা আর্ট, মিউজিক, নাচ, গণিত, ফিজিক্স বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শী হয়। নিউটন, আইনস্টাইন, ডারউইনের মত বিজ্ঞানীদের অটিজম ছিল বলে ধারণা করা হয়।
অটিজম বিষয়ে সচেতনতা:
অটিজম বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালিত হচ্ছে। এপ্রিল মাসকে অটিজম বিষয়ক সচেতনতার মাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। নীল রংকে অটিজম সচেতনতার রং হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, স্থান এদিন নীল রং এ সজ্জিত হয়ে একাত্মতা প্রকাশ করে। এবছরের প্রতিপাদ্য বিষয়: "সচেতনতা-স্বীকৃতি-মূল্যায়ন: শুধু বেঁচে থাকা থেকে সমৃদ্ধির পথে যাত্রা"।
২ এপ্রিল ২০২২ তারিখ ১৫তম 'বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস'এ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা 'বলতে চাই' এবং 'স্মার্ট অটিজম বার্তা' নামক দু'টি অ্যাপ্লিকেশন এর শুভ উদ্বোধন করেন। এবছর এপস দুটি নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টকে ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর করা হবে।
আপনার মন্তব্য