মোনাজ হক

০৩ মে, ২০১৬ ১১:৫৫

ইতিহাসের খোঁজে নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে একদিন

আমার ছোট্ট মেয়ে নীলিমা এখন সতের, কলেজ শেষ করে প্যারিস ইউনিভার্সিটিতে ভাষা সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করবে তারই প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনমাস পরেই কলেজ ফাইনাল, তাই টানা পড়াশোনার ফাঁকে মাঝে মধ্যে অবসর বিনোদনে বা প্রমোদভ্রমণ ও বাদ থাকে না।

সম্প্রতি ওর সাথে বিশ্বের চলমান ঘটনা ও মানবাধিকার নিয়ে তুখোড় আলোচনা চলছিল আমার, এরকম আলোচনা আমাদের প্রায়ই হয় ইদানিং। এক পর্যায়ে নীলিমা জিজ্ঞেস করলো - আচ্ছা পাপা, কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার কত দিন পরে ইতিহাস হয়, একবছর, দশবছর, একশবছর পরে? আমি তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর দিতে পারিনি ওকে। তাই পাল্টা আমন্ত্রণ জানালাম - যাবি, ইতিহাস দেখতে, যাবি আমার সাথে? ও বল্লো কোথায়? আমি প্রস্তাব দিলাম চল নাৎসিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প "জ্যাক্সেনহাউজেন" দেখতে যাই, সেখানেই পাবি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাসের বিভৎস নরহত্যার সন্ধান। নীলিমা রাজি হয়ে গেল, পরদিনই আমরা কিছু খাবার আর পানীয় গাড়ির ট্রাঙ্ক-এ ভোরে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম বার্লিন থেকে ৫০ কিলোমিটার দুরে সেই বিভৎস নাৎসি জার্মান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।

পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে বড় কোন সত্য নাই, সেই সত্য কে যেখানে বর্বরভাবে হত্যা করা হয়েছিল আজ থেকে ঠিক ৮০ বছর আগে সেই ইতিহাসকে সচক্ষে দেখবার ও অনুধাবন করার জন্যে চলেছি আমরা বাবা আর মেয়ে একসাথে। জ্যাক্সেনহাউজেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ১৯৩৬ সনের জুলাই মাসে তৈরি বার্লিনের উত্তরে অরানিয়েনবার্গ শহরে, নাৎসি পুলিশ প্রধান হাইনরিশ হিমলার এর নিজস্ব উদ্যোগে, হিমলারই এই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পটি পরিচালনা করে প্রথম দিকে। বার্লিন থেকে দূরত্ব বেশি না হওয়ায় নাৎসি বাহিনীর সর্বোচ্চ নজরদারিতে ছিল এই ক্যাম্পটি, আর মানুষ কে নিয়ে সব ধরনের বিভৎস পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চলত এই ক্যাম্পটিতে।

১৯৩৬ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ৯ বছরে শুধু এই জ্যাক্সেনহাউজেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে দুই লক্ষ্য মানুষকে হত্যা করে নাৎসি বাহিনী। যাদেরকে হত্যা করে তাদের মাঝে ইহুদি ছাড়াও রোমা, সিন্টি, জিপসি, সমকামী এমনকি কম্যুনিস্ট জার্মানরা ও ছিল। এছাড়াও ১৯৪১ এ একটা বিরাট অংশের, ১৩ হাজার যুদ্ধবন্দি সোভিয়েত সৈন্যরাও ছিল। সেই যুদ্ধবন্দি ১৩ হাজার সোভিয়েত সৈন্যদেরকেও গ্যাস-চেম্বারে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা হয়।

বিশাল ৪০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে এই জ্যাক্সেনহাউজেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পটি পৃথিবীর সকল মানুষের জন্যে এখন উন্মুক্ত এক বিশাল জাদুঘর, যেখানে বিনামূল্যে সকলের প্রবেশাধিকার রয়েছে। ঢোকার গেটে বিভিন্ন ভাষায় অডিও গাইড ও বুকলেট তৈরি আছে, আইডি-কার্ড জমা দিয়ে অডিও গাইড সংগ্রহ করে যখন ইচ্ছে ইতিহাসকে অনুসন্ধান করার এক অভিনব ব্যবস্থা রয়েছে।

আমরা প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পটি পরিদর্শন করেও পুরো শেষ করতে পারিনি। একসময় নীলিমা বলছিল, "পাপা এতদিন যা ইতিহাসের পাতায় পড়েছি তা আজ চাক্ষুষ দেখছি কি অমানবিক গণহত্যা এখানে হয়েছে" গণহারে গ্যাস-চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করায় এটি ছিল এক অনন্য নির্মম উদাহরণ, যা ইতিহাসে এর আগে কখনো ঘটেনি। শতাধিক কাঠের নির্মিত ছোট ছোট ব্যারাকে বন্দিরা থাকত যার উচ্চতা ২,৫ মিটার 8 মিটার চওড়া এবং ৫৪ মিটার দীর্ঘ ছিল এবং এক একটি ব্যারাকে ৪০ জন বন্দি শুধু রাতে ঘুমত, সারাদিন ব্যারাকে বাইরে বন্দীশিবিরে কাজ করতে হত তাদেরকে, তাইত ক্যাম্পটির মূল ফটকে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল "Arbeit Macht Frei" (work sets you free) অর্থাৎ "কাজই তোমাদের মুক্ত করে"।

অপেক্ষাকৃত কর্মঠ বন্দিদের প্রধান কাজ ছিল প্রতিদিনের হাজার হাজার গ্যাস চেম্বার এ মেরে ফেলা মানুষ গুলোর লাশ মরা পোড়াবার চুল্লিতে (ক্রেমাতরিউম) নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলা - অবিশ্বাস হলেও সত্যি যে এই বিশাল বন্দিদের জন্যে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না তবে অনেক ডাক্তার ছিল তারা বন্দিদেরকে নিয়ে বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাত। পাশাপাশি দুটি ব্যারাকে চলত এই বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ। এক ফলকে লেখা "এখানে এক ব্যাভেরিয়ান ডাক্তার ১০৫ টি বন্দী শিশুর উপর পরীক্ষা চালায়" তাদেরকে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ইনজেকশন এর মাধ্যমে ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের মৃত্যুর পৈশাচিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করে রাখে।

প্রতিটি ব্যারাক দর্শকদের জন্যে পুনর্নির্মাণ না করলেও বর্তমান গণতান্ত্রিক জার্মান সরকার নাৎসিদের নিগ্রহের কাহিনী ও তার দলিল তথ্যসমৃদ্ধভাবে উপস্থাপনা করেছে, তাইত হাজার হাজার মানুষ এই গণহত্যার কাহিনী অনুধাবন করবার জন্যে এই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আসেন। উল্লেখযোগ্য যে স্কুল -কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাই বেশি চোখে পড়ল আমার, আমাদের সামনেই একদল স্কুল ছাত্র-ছাত্রী নরওয়ে থেকে একদিনের সফরে এসেছে এই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইতিহাস খুঁজতে। এই যুবসমাজ অত্যন্ত আগ্রহী ইউরোপের ইতিহাসকে জানতে আর উপলব্ধি করতে।

মনে মনে শুধু ভাবলাম আমরা কবে পারব আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যুবসমাজের জন্যে তথ্যসমৃদ্ধ ভাবে জাদুঘর সাজাতে!

ফেরার পথে নীলিমা গাড়িতে বেশ মৌন ভারাক্রান্ত মনে বসে ছিল তাই ওকে প্রসঙ্গ বদলাবার কথা বলায় একসময় বল্লো "পাপা ৯ বছরে ২ লক্ষ মানুষকে গ্যাস-চেম্বারে হত্যা করেছে ওরা এখানে" প্রতিউত্তরে আমি শুধু বললাম "সত্যি কি নির্মম, কিন্তু মা তুমি তো জানো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৯ বছরে নয়, ৯ মাসে ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে" - দেখলাম নীলিমা আবার নিশ্চুপ - বাসায় ফিরে ওর সাথে অনেক কথা হলো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীও শুনতে চায় সে। এব্যাপারে পরে আবার লিখব।

আমাদের সকলেরই উচিত ছেলে-মেয়েদের সাথে আমাদের কষ্টার্জিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা, তাতে আমাদের উত্তরসূরি সভ্যতার পথে এগিয়ে যাওয়ার সাধনায় অনেক সমৃদ্ধ ও আলোকিত হবে।

মোনাজ হক : সম্পাদক, আজকের সময়, বার্লিন, জার্মানি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত