প্রকাশিত: ২০১৯-০৯-০৮ ১৯:৫২:০৩
মোনাজ হক:
শুধুমাত্র যারা দৃঢ়ভাবে ভালোবাসতে সক্ষম, তারাই চরম দুঃখ ভোগও করতে পারে- লিও টলস্তয়
৯ সেপ্টেম্বর এই বিশ্ববরেণ্য লেখক, লিও টলস্তয় ১৮২৮ সালে রুশ দেশে জন্মগ্রহণ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বড় মাপের ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর পরিচয়। আমরা কম লোকই জানি, তিনি ছিলেন সে সময়ের বড় ধরনের এক প্রগতিবাদী, বৈপ্লবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ।
১৮৬৯ সালে তাঁর উপন্যাস 'যুদ্ধ ও শান্তি' প্রকাশিত হবার ৩০ বছর পর ১৮৯৯ সালে এক মার্কিন অনুবাদক নাথান হাজেল ডেলের ইংরেজি ভাষায় যুদ্ধ ও শান্তি প্রথম অনুবাদ করেন। সে বছরই আলফ্রেড নোবেল ফাউন্ডেশন প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করলে, লোক মুখে ছড়িয়ে পরে যে, লিও টলস্তয় ই হবেন প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী।
তবে এই নোবেল পুরস্কার সম্পর্কে বিস্ময়কর ঘটনাই হলো ১৯০০ সালের প্রথম নোবেল পুরষ্কার নিয়ে। সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারের প্রথম যে নামটি ঘোষণা করা হয় সেটি লিও টলস্তয় ছিলোনা, ফরাসি এক অপরিচিত কবি সুলি প্রধুম্মে ১৯০১ সালে এই পুরস্কারটি প্রদান করা হয়। কে স্মরণ করতে পারে এই নামটি? শুধু লিও টলস্তয়ই নয় মার্ক টোয়েন, চেখভ, অস্কার ওয়াইল্ড এবং অন্যান্য মহান লেখক সেই সময়কালে জীবন্ত ছিলেন ও অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের নাম নোবেল কমিটিতে ছিলোনা ।
লিও টলস্তয়কে নোবেল পুরষ্কার দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়নি কেন? এব্যাপারে রাশিয়ার প্রাভদা সংবাদ সংস্থা একবার লিখেছিলো "সেসময়ের রাজনীতি স্মরণ করার চেষ্টা করুন, মহান রাশিয়ার লেখক কাদেরকে নোবেল পুরস্কার সম্মান প্রদান করা হয়েছে? মিখাইল শোলখোভ, ইভান বুনিন, বরিস পাসারনাক, এবং তারপর আইসিফ ব্রোদস্কি ও ছিল কিন্তু টলস্তয় এর নাম ছিলোনা।"
প্রথম নোবেল পুরস্কার দেবার পরে একটি চিঠিটি পৃথিবীর ৪০ জন নামকরা সাহিত্যিক ও শিল্পীদের স্বাক্ষরিত, সুইডিশ একাডেমিকে পাঠায়, যেখানে তাঁরা উল্লেখ করেন যে, সবাই এই পৃথিবীতে জানত শুধুমাত্র একজন লেখক ছিল যিনি বিশ্বের এই সর্বোচ্চ পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিলেন তিনি, লেখক লিও টলস্তয়।
"নোবেল পুরস্কারের প্রথম পুরস্কারের সাথে আমরা আপনার কাছে আমাদের প্রশংসা প্রকাশ করতে চাই। আমরা আপনাকে কেবলমাত্র আধুনিক সাহিত্যের একজন সম্মানিত কুলপতি হিসাবে দেখি। আমরা আপনাকে সেইসব শক্তিশালী কবিদের একজন হিসেবেও দেখেছি যারা প্রথম এবং সর্বাগ্রে প্রত্যাবর্তন করার যোগ্য। আমরা এই স্বাগতমূলক চিঠি দিয়ে আপনাকে মোকাবেলা করার প্রয়োজন বোধ করি, কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে প্রতিষ্ঠানটি যে পুরস্কারের দায়িত্বে ছিল, তা জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করে না বা লেখকদের মতামত প্রকাশ করে না। সবাই জানেন যে সত্য শিল্প হল শিল্প যা চিন্তা ও সৃজনশীলতার স্বাধীনতা ভিত্তিক।"
এবার টলস্তয় এর 'যুদ্ধ ও শান্তি' উপন্যাসটির পটভূমি ও বিশেষ কিছু অংশ ইংরেজি ও জার্মান পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখার অনুবাদ এখানে সংযোজন করলাম।
আসল নাম লেভ নিকোলাইয়েভিচ (কাউন্ট) টলস্তয় একজন রাশিয়ান লেখক, যিনি তাঁর সাহিত্যিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদের কাছে তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস "ওয়ার অ্যান্ড পিস" এবং "আনা কেরিনিনা" রচনা করে প্রশংসিত হয়েছেন। লিও টলস্তয় এবং তাঁর ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ উপন্যাসটি বিশ্বসাহিত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে পরিগণিত।
‘যুদ্ধ ও শান্তি’ একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। ফরাসি বিপ্লবের নায়ক নেপোলিয়নের অভ্যুত্থান এবং এর ফলে পৃথিবীর এক বিরাট অংশের মধ্যে ইউরোপ ও রাশিয়ায় প্রায় এক যুগ ধরে ধ্বংসের যে বিরাট আয়োজন এবং লাখ লাখ নর-নারীর ভাগ্য নিয়ে যে তাণ্ডবলীলা চলে এরই পটভূমিকায় রুশদেশের কয়েকটি অভিজাত পরিবারের বল্কনস্কি, কুরাঙ্গীন, বেজুখভ এ উপন্যাসের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
ইতিহাসের এক বিশাল বিপ্লবের সূত্রপাত হয় নেপোলিয়নের অভ্যুত্থানে। অতি নীচ বংশজাত বোনাপার্টের সম্রাট উপাধি ধারণে জার প্রথম আলেকজান্ডার অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং ইতালি অধিকারের ফলে অস্ট্রিয়া অত্যন্ত ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠে। কারণ ইতালিতে এককালে অস্ট্রিয়ার একাধিপত্য ছিল। ইংল্যান্ড রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার সাথে হাত মিলায় নেপোলিয়নকে প্রতিহত করতে। নেপোলিয়ন ত্বরিত গতিতে অস্ট্রিয়া আক্রমণ করেন। রাশিয়া অস্ট্রিয়াকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। অস্ট্রিয়ার সেনাপতি উলমে বন্দি হন। নেপোলিয়ন আরও এগিয়ে যান এবং অস্ট্রারলিজের যুদ্ধে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার সম্মিলিত শক্তিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। অস্ট্রিয়া অত্যন্ত হীন শর্তে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। প্রুশিয়া জার্মানি থেকে ফরাসিদের বিতাড়িত করতে রাশিয়ার সাথে যোগ দেয়। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ ঘোষিত হয়। কিন্তু জেনাতে প্রুশিয়ার শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং নেপোলিয়ন বার্লিন দখল করেন। এরপর নেপোলিয়ন প্রুশিয়ার মিত্র রাশিয়াকে তার ঔদ্ধত্যের জন্য সমুচিত শিক্ষা দেবার মানসে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ফ্রিডল্যান্ডের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে আলেকজান্ডার সন্ধি করতে বাধ্য হলেন। তিলসিতের সন্ধিতে রাশিয়ার কোনও ক্ষতি হলো না বটে, কিন্তু প্রুশিয়াকে রাজত্বের অর্ধেক অংশ ছাড়তে হলো।
এই সন্ধির পরিণামে আলেকজান্ডার ও নেপোলিয়নের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে উঠলো এবং তাঁদের মধ্যে এই অলিখিত চুক্তি হলো যে, ইউরোপে শুধু তাঁদেরই আধিপত্য থাকবে। কিন্তু তাদের এই বন্ধুত্ব বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কারণগুলো মোটামুটি এই অস্ট্রিয়ার সম্রাট-তনয়া মেরিয়া লুইসাকে নেপোলিয়ন বিয়ে করায় আলেকজান্ডার রুষ্ট হলেন। তারপর ওল্ডেনবার্গের ডাচি- যার অধিপতি আলেকজান্ডারের আত্মীয় নেপোলিয়ন অধিকার করেন। সর্বশেষে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার ‘মহাদেশীয় প্রথা’ লঙ্ঘন করাতে দুই দেশের সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে এবং নেপোলিয়ন বিশাল বাহিনী নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন। রাশিয়া প্রথম থেকেই শত্রুর মোকাবিলা না করে দ্রুত পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। রাশিয়ার প্রধান সেনাপতি কুতুজভের উদ্দেশ্য হলো অহেতুক যুদ্ধে শক্তি ক্ষয় না করে শত্রুকে দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া। নেপোলিয়ন দ্রুতবেগে এগিয়ে যান। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে মস্কো অধিকার করেন। কিন্তু পরিত্যক্ত মস্কোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো। ভীত ও সন্ত্রস্ত নেপোলিয়ন পশ্চাদপসরণ করতে শুরু করেন। ফরাসি বাহিনী ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে, কসাকদের অতর্কিত আক্রমণে, অবসাদ ও আত্মগ্লানিতে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়Ñ যেমন আহত পশুর রক্তক্ষয় হতে হতে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
১৮০৫ থেকে ১৮১২ এই সময়কার যুদ্ধের পটভূমিতে ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ উপন্যাসের কাহিনী বিন্যস্ত হয়েছে। ইতিহাসের এই গতির সাথে লক্ষ লক্ষ নর-নারীর ভাগ্য গ্রথিত হয়েছে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়। এই যুদ্ধ শুধু ইউরোপীয় জাতিসমূহের ভাগ্য নির্ধারণ করেনি, ব্যক্তির জীবনকেও পরিবর্তিত ও পরিঘটিত করেছে।
এন্ড্রু, নিকোলাস, বোরিস, বার্জ, পিটিয়া এবং আরও অসংখ্য মানুষ এই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এন্ড্রু সুন্দরী স্ত্রী লিসাকে ত্যাগ করে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে নিতান্ত কর্মোদ্যমের জন্যেই। ফলে সন্তানসম্ভবা লিসা তার সঙ্গ ও সান্ত¦না থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রেই সে মৃত্যুর ভীষণতা উপলব্ধি করে, গুরুতররূপে আহত হয় এবং ফলে তার মৃত্যু ঘটে। রুস্তভদের বড় ছেলে নিকোলাস শিক্ষানবিস রূপে যুদ্ধে যোগ দেয়। রুস্তভরা অভিজাত হলেও আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল নয়। এজন্যই কাউন্টেস রুস্তভের মত সাধারণ লিকোলাসের সাথে যেন কোনও এক ধনী-কন্যার বিয়ে হয়। কিন্তু তার এই সংকল্পের প্রধান অন্তরায় নিকোলাসের সাথে নিঃস্ব সোনিয়ার প্রণয়। সোনিয়া ব্যতীত অন্য কাউকে নিকোলাস বিয়ে করতো কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু এই যুদ্ধের প্রচণ্ড তাণ্ডবলীলা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেল প্রিন্স বল্কনস্কির কন্যা মেরির সাথে। বিদ্রোহী চাষিদের হাত থেকে নিকোলাস তাকে উদ্ধার করলো। ফলে তাদের ঘটলো প্রণয় ও পরিণয়। রুস্তভদের ছোট ছেলে পিটিয়া। সে কিশোর, অথচ এই সর্বনাশা যুদ্ধে তাকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে।
পিয়ারি ভাবুক। সুতরাং যুদ্ধে তার সক্রিয়ভাবে অংশ নেবার কথা নয়। তবু সে খ্রিস্টবিরোধী বোনাপার্টের কার্যকলাপ দেখে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, তাঁকে হত্যা করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে রাশিয়া এবং সমস্ত দুনিয়ার কল্যাণ। তাই সে হত্যার সংকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু তা কার্যকরী হবার আগেই একটি মেয়েকে শত্রুর নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে গিয়ে অহেতুক বন্দি হলো।
বন্দিজীবনে প্লেটোন: কারাতায়িভের সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটে এবং প্লেটোন কারাতিয়েভের গভীর আধ্যাত্মমূলক বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার আত্মিক পরিবর্তনটি সম্পূর্ণ হয়। পিয়ারির মতোই কত লক্ষ নর-নারী এই যুদ্ধের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই।
সুতরাং ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ উপন্যাসে দুটি স্বতন্ত্র অংশ বিদ্যমান- একটি ঐতিহাসিক ও অপরটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক। টলস্তয় মানুষের ব্যক্তিগত প্রবণতা দিয়ে ইতিহাসের গতি নির্ধারণ করতে চেয়েছেন। ব্যক্তিকে ইতিহাস এবং ইতিহাসের সাথে ব্যক্তির এক নিবিড় বন্ধন সাধন করেছেন। ব্যক্তির সাথে ইতিহাসের এই নিবিড় সম্পর্ক সাধনের ফলে ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে সার্থকতা লাভ করেছে।
এ উপন্যাসের উপজীব্য একমাত্র জীবন-অন্বেষা। সমগ্র জীবনের রূপায়ণ ঘটেছে এ উপন্যাসে এবং টলস্তয় জীবনের সামগ্রিক রূপ রূপায়ণে সবিশেষ পারঙ্গমতার পরিচয় দিতে পেরেছেন। এ উপন্যাসে প্রচলিত কোনও নায়ক নেই। এন্ড্রু বা পিয়ারি কাউকে এককভাবে নায়কের স্থান দেয়া যায় না। এর কারণ প্রকৃতির দৃষ্টিতে নায়ক বলে কিছু নেই, আছে সংগ্রামমুখর মানুষ। এই নায়কহীনতার ফলে উপন্যাসের আকর্ষণ স্তিমিত হয়নি; বরং আরও প্রবল হয়ে উঠেছে। কেননা এখানে আমরা কোনও ব্যক্তিবিশেষ নয়, রাশিয়াকে তার উত্থান ও পতন, সংগ্রাম ও শান্তি সব কিছু নিয়ে নায়করূপে পাচ্ছি। ফলে উপন্যাসটি প্রকৃতির মতোই স্বাভাবিক ও জীবনধর্মী রূপ লাভ করেছে।
টলস্তয় তার সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতা এই উপন্যাসে রূপায়িত করেছেন। অভিজাত সমাজের ভোগবিলাস, পারিবারিক জীবনের সুনিবিড় মাধুর্য, চাষির হঠকারিতা ও মূঢ়তা, মৃত্যুভীতি ও কাতরতা, নৈতিক সংকট ও দীক্ষা লাভ, মাতালের কা-কারখানা, জুয়ার আড্ডা, নষ্টা মেয়ে মানুষের হাব-ভাব, মাতৃহৃদয়ের বাৎসল্য, যুদ্ধক্ষেত্রে মারণাস্ত্র নিক্ষেপ, সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণ, বিজয়ীর উল্লাস ও বিজেতার অবসাদ, বন্দিজীবনের গ্লানি ও অবসাদ এবং দুর্দশা, অগ্নিকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা, প্রথম প্রেমভীরু পদক্ষেপ, প্রেমের সুনিবিড় উপলব্ধি, সামাজিক মিলনোৎসব, নাচের আসর, বসন্তে প্রকৃতির উন্মত্তা, অনন্ত আকাশের মহিমাÑ এইরূপ বিচিত্র দৃশ্যের সমাবেশ ঘটেছে ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ উপন্যাসে।
জীবনের বিচিত্র ঘটনাবলি যেন টলস্তয়ের নখদর্পণে। ঘটনা যতই বাড়তে থাকে, চরিত্রের যতই ভিড় জমে, ততই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যভাবে এঁকে যান তার ছবি। একেকটি ঘটনা, একেকটি চরিত্র যেন জীবনের প্রতিরূপ।
কেবল সুদূরপ্রসারী অভিজ্ঞতা ও তীক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি নয়, প্রগাঢ় অনুভূতিশীলতার ফলেই তিনি মহৎ সাহিত্যিকের মর্যাদা লাভ করেছেন। অত্র উপন্যাসের মূলমন্ত্র হলো প্রেম। তার হৃদয় প্রেমে ভরপুর। সে কারণে জীবনের কোনও ঘটনা বা বস্তু- তা যত ঘৃণ্য বা কুৎসিত হোক না কেন, তিনি ঘৃণা বা অবজ্ঞার চোখে দেখেননি। প্রগাঢ় প্রেম ও অনুকম্পার দৃষ্টি নিয়ে তিনি জগৎ ও জীবনকে অবলোকন করেছেন। এ কারণে হেলেনের মতো পাপীয়সী আনাতোলের মতো ইন্দ্রিয়াচারী ও দোলোখভের মতো পাষণ্ডকেও তার পক্ষে উদার দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব হয়েছে।
টলস্তয় জীবনের তুচ্ছতম কোনও কিছুকেই অস্বীকার করেননি; বরং তাকে আঁকড়ে ধরেছেন, গ্রন্থিত করেছেন তার সৃষ্টিতে। জীবনে যা স্বাভাবিক, তা যত সাধারণ, তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর হোক না কেন, তাকে ঘিরেই জীবন। তাই তিনি এগুলো বর্জন করেননি; বরং তুলে এনেছেন আপন মহিমায়। এজন্যই তিনি ‘যুদ্ধ ও শান্তি’তে জীবনকে যথার্থরূপে রূপায়ণের প্রয়াস পেয়েছেন নিপুণভাবে। দু-একটি রেখার টানে অতি স্বল্প পরিসরে টলস্তয় একেকটি চরিত্রকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ও সুন্দর করে রূপ দিয়েছেন। আনা মিখাইলভ্না বিগত যৌবনা; অথচ একমাত্র সন্তান বোরিসের চাকরির জন্য প্রিন্স ভেসিলের কাছে সুপারিশ করতে গিয়ে তার চেহারায় যৌবনের বিশেষ আবেদনটি ফুটে উঠেছে। মিখাইলভ্না দ্রবেৎস্কোয় একবার জরাজীর্ণ বলিরেখা বহুল মুখের যৌবনের আকুলতাকে ফিরে পাবার ব্যর্থ প্রয়াস পেলেনÑ ভেসিলের অন্তরে যাতে তার মুখচ্ছবি বারেকের জন্যও বিন্দুমাত্র করুণার সঞ্চার করতে পারে, এই আশা। মেরিয়াকে আমরা বরাবরই হিমশীতল বলে জানতাম। অথচ তারই বাঞ্ছিত নিকোলাস যখন ভরোনিজে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো, তখন তার মধ্যে চিরকালীন নারীরূপটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠল, যা দেখে লাস্যময়ী এমিলি পর্যন্ত অবাক হয়ে গেল। বোরিস জুলিকে প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে যে কথাগুলো বলল অথবা জুলি তাকে দিয়ে যে কথাগুলো বলিয়ে নিল, ধনীর একমাত্র উত্তরাধিকারিণী রূপে এ তার অবশ্য প্রাপ্য। এভাবে চরিত্রগুলো বাস্তবতার নিরিখে রূপায়িত হয়েছে লেখকের তুলির আঁচড়ে।
এ উপন্যাসে এমন কতক দৃশ্য আছে, যা গভীর কোনও আবেগ বা সমুন্নত কোনও ভাব থেকে উদ্ভূত নয়। নিছক আনন্দ-বিলাস বা খেয়াল-খুশি যার সাথে প্রয়োজনের কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ যা জীবনে অপরিহার্য- এ ধরনের কতকগুলো দৃশ্য উপন্যাসে রূপায়িত হয়েছে; যেমন রুস্তভদের শিকারে বা কাকার বাড়ি যাওয়া। এই ধরনের লঘু চরিত্র; যার মধ্যে জীবনের আনন্দ বিধৃত- এগুলো টলস্তয়ের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। এগুলো উপন্যাসের উপাদানকে জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলেছে।
জীবনের বাস্তবমুখিতার চরমোৎকর্ষ প্রকাশ পেয়েছে নিম্নোক্ত দৃশ্যে। কাউন্টেস রুস্তভা বান্ধবী আনা মিখাইলভ্নার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘না, না, তুমি আমার এই সামান্য উপহারটুকু নাও ভাই। বোরিসের জামা-কাপড় যা লাগে করিয়ে দাও। এ তোমার নিতেই হবে, কোনও আপত্তি শুনব না আমি।’ মিখাইলভ্না বান্ধবীকে বুকের মধ্যে টেনে এনে সহসা তার দু’চোখ বেয়ে ঝর ঝর করে অশ্রু ঝরতে থাকে। কাউন্টেস রুস্তভও কেঁদে ফেললেন। কেন যে তারা দুজনেই কাঁদলেন; শেষ পর্যন্ত তাদের বন্ধুত্বের মধ্যে আর্থিক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বলে অথবা তাদের বিগত দিনের সেই বাল্যের, কৈশোরের ও প্রথম যৌবনের মধুর দিনগুলো যখন দুই সখীর মধ্যে প্রথম প্রণয়ের উন্মেষ হয়, সেই সব দিনের কথা স্মরণ করে।
‘যুদ্ধ ও শান্তি’ উপন্যাসটি রচিত হয়েছে এক শতাব্দীকাল পূর্বে (১৮৬৫-৬৮)। কিন্তু আজও এর আবেদন রয়েছে শুধু রাশিয়ায় নয়, সমগ্র বিশ্বে।
আপনার মন্তব্য