ফরিদ আহমেদ

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০১

ম্যারাথন অব হোপ: টেরি ফক্স রান

১৯৮০ সালের ১২ এপ্রিল।

ক্যানাডার একেবারে পূর্ব প্রান্তের নিরিবিলি প্রদেশ নিউফাউন্ডল্যান্ড। নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের সবচেয়ে পূবের   শহর সেইন্ট জন। সেখানে সিটি হলের সামনে জড়ো হয়েছে কিছু লোক। এপ্রিলেও ঠাণ্ডার পরশ রয়েছে বাতাসে। ছোট্ট একটা আয়োজনের প্রত্যক্ষদর্শী তারা। কিন্তু, জানে না, এই ঘটনাই একদিন ইতিহাসে বিশাল এক ঘটনায় পরিণত হবে।

যাকে ঘিরে এই সব আয়োজন, সে মাত্র একুশ বছর বয়সের এক তরুণ। আর দশটা ক্যানাডিয়ান সাধারণ তরুণের মতোই সে। সুঠাম শরীর, ঝাঁকড়া চুল আর স্বপ্নিল দুটো চোখ। দুর পাল্লার দৌড় আর বাস্কেটবল প্রিয় খেলা তার। ব্যতিক্রম শুধু অন্য জায়গায়। ডান পা নেই ছেলেটার। কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে তার চৌদ্দ মাস আগে। চৌদ্দ মাস ধরে এই কৃত্রিম পায়ের সাথে অভ্যস্ত হয়ে এক অসম্ভব কাজ করতে ক্যানাডার সবচেয়ে পূবের বিন্দুতে হাজির হয়েছে সে। শুধু যে পা নেই তার তা নয়, পা না থাকার পিছনের মূল কারণ হচ্ছে ক্যান্সার। ক্যান্সারে আক্রান্ত এই তরুণ। ক্যান্সার থেকে বাঁচাতেই কেটে ফেলা হয়েছে তার পা। তারপরেও রেহাই মিলছে না। দ্রুত ছড়াচ্ছে ক্যান্সার সারা দেহে।

এই ক্যান্সার আক্রান্ত, এক পা বিহীন তরুণটির নাম টেরি ফক্স।

সাদা গেঞ্জি পরে রয়েছে টেরি, সাথে শর্টস। সাদা গেঞ্জির বুক বরাবর লেখা ম্যারাথন অব হোপ। মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অলিম্পিকে ম্যারাথনের যে দূরত্ব, সেই বিয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরত্ব প্রতিদিন দৌড়ানোর  সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে তার এই এক পায়ে। সকালে শুরু হবে দৌড়।বিশ কিলোমিটার দৌড়ানোর পর বিশ্রাম নেবে সে। তারপর বিকালে দৌড়বে বাকি বাইশ কিলোমিটার। এটাই ছিল পরিকল্পনা। এই দৌড় শেষ হবে গিয়ে ক্যানাডার একেবারে পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে। মূল উদ্দেশ্য ক্যান্সার রিসার্চের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা।

ছোট্ট জনসমাবেশে সংক্ষিপ্ত একটা বক্তব্য রেখে টেরি শুরু করে তার দৌড়। সিটি হল থেকে নিউ গোয়ার স্ট্রিটে চলে যায় সে। সেখানে থেকে ছুটে চলে পিটস মেমোরিয়াল ড্রাইভের দিকে। এটাই হাইওয়ে। শুরু হয় মানুষের জন্য আশা বয়ে আনার সংকল্প নিয়ে এক মৃত্যুপথযাত্রী  তরুণের অনাগত দিনের মৃত্যুর বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব লড়াই, দ্য ম্যারাথন অব হোপ।

টেরি ফক্সের জন্ম ম্যানিটোবার উইনিপেগ শহরে। টেরির জন্মের কয়েক বছর পরই তার পরিবার পাড়ি জমায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভ্যাংকুভারের সন্নিবর্তী পোট ককুইটলামে। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি অদম্য আগ্রহ টেরির। যদিও গ্রেড এইটের বাস্কেটবল টিমের সবচেয়ে খারাপ খেলোয়াড় ছিল সে। পোর্ট ককুইটলাম সেকেন্ডারি স্কুলের শেষ বর্ষে টেরি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডাগ অ্যালওয়ার্ডের সাথে যৌথভাবে বর্ষসেরা অ্যাথলেটের সম্মান অর্জন করে। পরবর্তীতে টেরি সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা বিভাগে পড়াশোনা শুরু করে।

১৯৭৭ সালে টেরির হাঁটুতে অসহ্য ব্যথা শুরু হয়। দাড়িয়ে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে দাড়ায় তার জন্য। এরকম অবস্থায় তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা জানায় টেরি ওসটেওজেনিক সারকোমা, যা হচ্ছে এক ধরনের হাড়ের ক্যান্সার, সেই রোগে আক্রান্ত হয়েছে।  টেরিকে বাঁচাতে হাঁটুর ছয় ইঞ্চি উপর থেকে  তার ডান পা কেটে ফেলা হয়।

কৃত্রিম পা দিয়ে নতুন করে আবার হাটা শিখতে হয় টেরিকে। দৃঢ় সংকল্পের কারণে অপারেশনের মাত্র ছয় সপ্তাহ পরই গলফ খেলতে সক্ষম হয় সে। এমনকি বাস্কেটবলও ফিরে আসে তার জীবনে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিক হ্যানসেনের ( এই ছেলে স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত। স্পাইনাল কর্ড রিসার্চের জন্য সচেতনতা ও অর্থ সংগ্রহের জন্য হুইল চেয়ারে দুই বছরে বিশ্ব প্রদক্ষিণ করেছে।) আমন্ত্রণে হুইল চেয়ার বাস্কেটবল খেলায় অংশগ্রহণ করে টেরি।

হসপিটালের সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা টেরি কখনোই ভোলেনি। ক্যান্সার চিকিৎসায় ক্যানাডার অপ্রতুল ব্যয় দেখে টেরির চিত্ত ক্রোধে বিক্ষুব্ধ হয়ে হঠে। টেরি তার এই ক্রোধকে রূপান্তরিত করে কিছু করার এক সংকল্পে। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য টাকা সংগ্রহ করতে হবে। প্রচুর টাকা। সেই সাথে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে। আর এর জন্য   সে দৌড়বে। সুবিশাল ক্যানাডার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। টেরির ধারনা ছিল যদি সারা দেশের লোক মাত্র এক ডলার করেও দেয় তাহলেও ক্যান্সার গবেষণার জন্য সংগৃহীত হবে দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ ডলার (সেই সময় ক্যানাডার জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ)।

এই দৌড়ের জন্য শুরু হয় নিরলস প্রশিক্ষণ পর্ব। প্রশিক্ষণের শুরুতে টেরি তার পরিকল্পনা গোপন রাখে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে। তাদেরকে জানায় ভ্যাংকুভার ম্যারাথনে অংশ নেয়ার জন্য সে অনুশীলন করছে। অনুশীলনের প্রারম্ভিক সময়টা ছিল অমানুষিক ও কঠোর। প্রথমদিকে বেশিরভাগ সময় তাকে ব্যয় করতে হতো শুধু মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়া ও নিজেকে কষ্ট করে খাড়া করার পিছনে। তবু এগিয়ে চলে প্রস্তুতি। এক বছরে চার হাজার আটশত কিলোমিটারেরও বেশি দৌড়ানোর পর টেরি  পরিবারের সদস্যদের কাছে তার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। প্রথমে গাইগুই করেও শেষ পর্যন্ত তার জেদের কাছে হার মানে তার  পরিবার।

এতো শুধু দৌড় নয়, এ যে এক অসামান্য অভিযান। মানুষের কল্যাণের জন্য নিশ্চিত মৃত্যু পথযাত্রী মৃত্যুঞ্জয়ী এক তরুণের মৃত্যুর সাথে পাল্লা দেয়ার দৌড়। ক্যানাডিয়ানরা এই অনন্যসাধারণ অভূতপূর্ব দৌড়ের কথা কখনোই ভুলবে না।

দৌড়ের প্রথম দিকে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করা কঠিন হলেও, আস্তে আস্তে মিডিয়ায় আসতে লাগলো টেরির এই দৌড়ের খবর। মানুষের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হলো টেরির উপর, উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি পেতে লাগলো দ্রুতগতিতে। সেই সাথে বাড়তে লাগলো সংগৃহীত টাকার পরিমাণ। বরফশীতল বৃষ্টি, প্রচণ্ড বাতাস এমনকি তুষারপাতকে অগ্রাহ্য করে টেরি প্রতিদিন প্রায় বিয়াল্লিশ কিলোমিটার দৌড়তো। সন্দেহবাদীদের ধারনাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করে  দিনের পর দিন দৌড়ে টেরি অতিক্রম করে যায় একে একে ডার্টমাউথ, শার্লট টাউন, মন্ট্রিয়ল, টরন্টো। এরই মাঝে চলতে থাকে বিভিন্ন স্থানে আবেগপ্রবণ বক্তব্য প্রদান। টেরির সেই সব বক্তব্য স্পর্শ করে যায় অসংখ্য জনগণের হৃদয় এবং মনকে। সবার ভালবাসায় সিক্ত হতে থাকে এই দুঃসাহসী তরুণ।

একশ তেতাল্লিশ দিনে পাঁচ হাজার তিনশ তিয়াত্তর কিলোমিটার দৌড়ানোর পর বুকে প্রচণ্ড ব্যথার কারণে অন্টারিওর থান্ডার বের কাছে থামতে বাধ্য হয় টেরি। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হসপিটালে । জানা যায় তার ফুসফুসও আক্রান্ত হয়েছে ক্যান্সারে। এই সংবাদে ক্যানাডিয়ানরা হতভম্ব হয়ে পড়ে, হয়ে পড়ে গভীর বেদনাকাতর।

টেরিকে ছাড়াই এগিয়ে চলে ম্যারাথন অব হোপ। সংগৃহীত হয় দুই কোটি একচল্লিশ লক্ষ সত্তর হাজার ডলার যা টেরির প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি।

হসপিটালে থাকা অবস্থায়ই টেরি জানতে পারে অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রতি বছরই এই ম্যারাথন অনুষ্ঠিত হবে। যার নাম হবে টেরি ফক্স রান। টেরি নিজেই এই ম্যারাথনের জন্য বেশ কিছু নির্দেশিকা তৈরি করে দিয়ে যায়। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে -এই আয়োজনটি হবে সম্পূর্ণ অপ্রতিযোগিতামূলকভাবে। কোনো বিজয়ী থাকবে না এই দৌড়ে। থাকবে না কোন পুরস্কার। উদ্দেশ্য হবে শুধুমাত্র ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহ।

১৯৮১ সালের জুন মাসের আটাশ তারিখে মাত্র বাইশ বছর বয়সে টেরি ফক্স মৃত্যুবরণ করে। মারা যাওয়ার আগে ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসাবে টেরি ফক্স অর্জন করে ক্যানাডার সর্বশ্রেষ্ঠ পদক অর্ডার অব ক্যানাডা। থান্ডার বেতে টেরির স্মরণে গড়া হয়েছে তার এক বিশাল ভাস্কর্য। ক্যানাডিয়ান রকির একটি চূড়ার নামকরণও করা হয়েছে তার নামে।

টেরির মা তার ছেলেকে বর্ণনা করতেন অতি সাধারণ এক ছেলে বলে। এই অতি সাধারণ ছেলেটিই আজ পরিণত হয়েছে ক্যানাডার জাতীয় বীরে। কোটি কোটি ক্যানাডিয়ানদের কাছে যা কিছু সুন্দর ও ভাল, যা কিছু মহৎ ও নিঃস্বার্থ, যা কিছু অনুপ্রেরণাদায়ী ও আশাদাত্রী তার সবকিছুরই প্রতিভূ হচ্ছে টেরি।

শুধু ক্যানাডিয়ানদের কাছেই নয়, বিশ্বের সকল মানবতাবাদী মানুষদের কাছেও টেরি তাই। মানবতাই বিশ্বাসে মানুষদের কোনো আলাদা দেশ থাকে না, পৃথিবীর সব দেশই তার দেশ, সব মানুষই তার আপনজন।

ফরিদ আহমেদ : কানাডা প্রবাসী লেখক।

ভিডিও : সৌজন্য : Dan Arruda-এর ইউটিউব চ্যানেল

আপনার মন্তব্য

আলোচিত