নিজস্ব প্রতিবেদক

৩১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০২:০১

অন্যরকম এক মাদ্রাসা

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, স্বয়ংসম্পূর্ণ কম্পিউটার ল্যাবসহ রয়েছে আধুনিক শিক্ষার সব সুযোগ, ব্যক্তি উদ্যোগের এই প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয় বিনামূল্যে

হবিগঞ্জ জেলা শহরের হাতেগোনা দু’য়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম, নেই স্বয়ংসম্পূর্ণ কম্পিউটার ল্যাব। অথচ এই জেলার চুনারুঘাট উপজেলার একটি অজপাড়াগাঁয়ের এক মাদ্রাসায় রয়েছে এমন সুবিধা। রয়েছে ছেলে-মেয়ের সমন্বিত শিক্ষাসহ আধুনিক শিক্ষার সকল সুযোগ।

কেবল মাদ্রাসায়ই পড়ানোর মাধ্যমেই দায়িত্ব শেষ করেন না এখানকার শিক্ষকরা। প্রতিরাতে সকল শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে বাড়িতে পড়ালেখার খোঁজ নেওয়া হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়েও নজরদারি করেন শিক্ষককরা।

‘মফিজ উদদীন চৌধুরী দাখিল মাদ্রাসা’ নামের এই মাদ্রাসাটি গড়ে ওঠেছে ব্যক্তি উদ্যোগে। তবে এখানে পড়ার জন্য কোনো টাকা দিতে হয় না শিক্ষার্থীদের। উল্টো শিক্ষার্থীদের বইখাতা থেকে শুরু করে ইউনিফর্ম পর্যন্ত বিনামূল্যে সরবরাহ করে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।

দরিদ্রতায় ক্লিষ্ট শিক্ষার সুযোগহীন চুনারুঘাটের ময়নাবাদ গ্রামে এই মাদ্রাসা হয়ে ওঠেছে আলোর দিশারী। ২০১৪ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন এই গ্রামেরই বাসিন্দা বৃটেনের ব্যবসায়ী মামুন চৌধুরী। এলাকায় শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে নিজের দুই একর জমির উপর মাদ্রাসা নির্মাণ করেন তিনি।

মামুন বৃটেনের খ্যাতিমান ব্যবসায়ী। সে দেশের মর্যাদাপূর্ণ কুইন’স অ্যাওয়ার্ড জিতেছে তাঁর পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান লন্ডন ট্র্যাডিশন। ব্যবসায় সাফল্যের জন্য রাণীর অতিথি হয়ে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বাকিংহাম প্যালেসেও।

দেশে নিজের এলাকায় মাদ্রাসা স্থাপন প্রসঙ্গে মামুন চৌধুরী বলেন, এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষই গরীব ও কৃষিজীবী। ফলে একটু বড় হওয়ার পর ছেলেদের স্কুল/মাদ্রাসায় না দিয়ে কাজে দিয়ে দেওয়া হতো। এলাকার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় আগ্রহী করে তুলতেই আমি এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। যেহেতু এলাকার লোকজন একটু ধর্মপ্রাণ, তাই প্রথমে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করি, যাতে অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানদের এখানে দিতে আগ্রহী হন। মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা আসতে শুরু করায় একইস্থানে ২০১৫ সাল থেকে চালু করা হয়েছে জাহানারা চৌধুরী একাডেমি। এই একাডেমিতে সকল ধর্মের শিক্ষার্থীরাই পড়তে পারে।

এখানকার শিক্ষকরা জানান, এখানে প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। এছাড়া একাডেমিতে বাড়তি আছে নার্সারি শ্রেণী। দুই প্রতিষ্ঠানেই পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের কোনো টাকা দিতে হয় না। শিক্ষা উপতরণও শিক্ষার্থীদের ফ্রি দেওয়া হয়।

এই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, আমাদের এখানে প্রায় পৌনে তিনশ শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক রয়েছেন ১৫ জন। এখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হয় এবং আধুনিক শিক্ষা প্রদান করা হয়। এবছর থেকে মাদ্রাসায় কম্পিউটার ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ চালু করা হয়েছে। আমরা ইংরেজি ও প্রযুক্তি শিক্ষার উপর সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকি।

তিনি বলেন, কেবল নির্দিষ্ট সময়ে নয়, দুর্বল ছাত্রদের অতিরিক্ত সময়েও এখানে পড়ানো হয়। এছাড়া প্রতিরাতে সকল শিক্ষার্থীদের অভিভাববকদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করি, তাদের সন্তানরা বাসায় পড়ছে কী না  তা জানতে চাই। এছাড়া নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষকরা খোঁজ নিয়ে আসেন এবং প্রতি মাসে অভিভাবকদের সাথে উঠান বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মামুন চৌধুরী বলেন, আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এছাড়া ধর্মের নামেও নানা ভুল শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তাদের। ভুল শিক্ষায় তারা যাতে বিভ্রান্ত না হয় এবং আধুনিক শিক্ষা পেতে পারে তাই এই মাদ্রাসাটি গড়ে তুলেছি।

মাদ্রাসার ব্যয় নির্বাহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা ইংল্যান্ডে থাকি। দেশে গ্রামের বাড়িতে জায়গাজমিসহ আমাদের কিছু সম্পত্তি রয়েছে। এসব থেকে যা আয় হয় তা আমরা সে দেশে না নিয়ে এখানে এই মাদ্রাসা ও একাডেমির জন্য ব্যয় করি।

মাদ্রাসায় আধুনিক শিক্ষা শুরু করতে গিয়ে প্রথমে অনেক বিপত্তিতে পড়তে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমার নামে তো বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল থেকে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এলাকায় আমার বিরুদ্ধে মাইকিং হয়েছে। আমাদের পোস্টার ছিড়ে ফেলা হয়েছে। তবে এখন এলাকার সবাই সহযোগীতা করছে বলে জানান তিনি।

এই মাদ্রাসা সম্পর্কে স্থানীয় সংসদ সদস্য এডভোকেট মাহবুব আলী বলেন, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের অনেক ছেলেমেয়েদের আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ছাড়া তারা প্রতিযোগীতায় টিকতে পারবে না। সেইদিক থেকে মামুন চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটি একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগী। আমি শুরু থেকেই তাঁর সাথে আছি, সাধ্যমত সাহায্য-সহযোগীতা করে যাচ্ছি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত