আব্দুল হাই আল-হাদী

০৯ মার্চ, ২০১৭ ১৯:০৫

জাফলং ‘বল্লাপুঞ্জী রাজবাড়ী’

চারিদিকে চলছে প্রকৃতি ধ্বংসের মহোৎসব। নদীর বুক চিরে অনবরত চলছে সারি সারি ট্রাক, চলছে গর্ত খোরার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। চারপাশে মানবের দানবীয় হাতের ক্ষত-বিক্ষত চিত্র। দেখে মনে হবেনা এখানে একদা স্বচ্ছ নির্মল পানির এক নদী ছিল! বর্তমানে প্রকৃতি এখানে আহত, নিসর্গ এখানে পরাজিত। প্রকৃতির নির্মল পরিবেশ ও নিসর্গ ধ্বংসের এক জ্বলন্ত উদাহরণ এ যেন।

এ তাণ্ডবলীলার মাঝেই সবুজে আচ্ছাদিত গাছ-গাছালীতে পূর্ণ একটি জায়গা টিকে আছে কোন রকমে। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘মন্দিরের জুম’ নামেই পরিচিত। চারদিকের বাস্তবতায় এ যেন এক মরূদ্যান! সে ’মন্দিরের জুম’ নামে পরিচিত স্থানটি প্রকৃতপক্ষে ৭ শতাধিক বছর পুরনো এক রাজবাড়ী। খাসিয়াদের গৌরবজনক প্রাচীন মালনিয়াং রাজ্যের রাজবাড়ী এটি। প্রাচীন আমলের অনেক ধ্বংসাবশেষ এখনও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে এখানে।
 
সিলেটের জাফলং দেশ-বিদেশের পর্যটকদের একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। প্রকৃতি অকৃপণ হাতে স্থানটিকে সাজিয়েছে নিজের মতো করে। পাথর কোয়ারীর জন্যও জাফলং সমধিক পরিচিত। কিন্তু জাফলং কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিংবা খনিজ সম্পদের জন্যেই পরিচিত নয়। ঐতিহাসিকভাবেও জায়গাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাজার বছরের পুরনো খাসিয়াদের ঐতিহাসিক ‘মালনিয়াং রাজ্য’ এর রাজধানী ছিল জাফলংয়ের বল্লাপুঞ্জি এবং এখানকার রাজবাড়ী থেকেই প্রভাবশালী মালনিয়াং রাজারা বিশাল রাজ্য শাসন করেছেন।

জাফলংয়ের বল্লাপুঞ্জিতে অবস্থিত ‘মন্দিরের জুম’ নামে পরিচিত স্থানে প্রাচীন মালনিয়াং রাজ্যের রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ আজও আলোকিত গৌরবময় অতীতের স্মৃতি ধারণ করে আছে। ঐতিহাসিক এ রাজবাড়ীটি দীর্ঘদিন থেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। স্থানীয় লোকজনও প্রাচীন এ রাজবাড়ীর কথা পুরোপুরি ভুলে গেছে। যে দু’একজন এ বাড়ীটিকে চেনে, তাদের মধ্যেও এটা নিয়ে রয়েছে ভুল ধারণা।

খাসিয়া সম্প্রদায়ের প্রাচীন ইতিহাস ও জৈন্তিয়া রাজ্য সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে গিয়ে প্রাচীন মালনিয়াং রাজ্য এবং সে রাজ্যের রাজধানী জাফলংযের বল্লাপুঞ্জিতে অবস্থিত রাজবাড়ীর তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু কোথাও এ বাড়ীর সুনির্দিষ্ট অবস্থানের উল্লেখ বা  বিবরণ পাওয়া যায় না। ব্যক্তিগত উৎসাহ এবং গবেষণার প্রয়োজনে দীর্ঘদিন অনুসন্ধানের পর এ রাজবাড়ীর অবস্থান এবং ধংসাবশেষের সন্ধান পাওয়া গেছে। জাফলং এ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বসবাসরত খাসিয়া প্রবীণদের সহযোগিতা ও এ  রাজবাড়ীর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করতে অনেক সাহায্য করেছে। একই সাথে প্রাচীন সেই ’মালনিয়াং রাজ্য’ এবং তাঁর রাজাদের সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে।

জাফলং এর প্রাচীন খাসিয়া বসতি ’বল্লাপুঞ্জি’র বন-বাদাড় ও পান-সুপারী’ জুমের মধ্যে বাড়িটির সন্ধান পাওয়া গেছে। স্থানীয়দের কাছে জায়গাটি ’মন্দিরের জুম’ নামে পরিচিত। সে জুমটি পান-সুপারিসহ নানা রকম বৃক্ষে আচ্ছাদিত এবং কাটা তারের বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত। পাথর খেকোদের লোলুপ দৃষ্টি ও লোভাতুর হাত থেকে রক্ষার জন্যই সম্ভবত: জায়গার মালিকরা এমন ব্যবস্থা নিয়ে থাকতে পারেন। সে জুমের মধ্যে ঢুকে দেখা গেছে, হাজার বছরের পুরনো সে রাজবাড়ীর ধংসাবশেষ আজও নিজের অতীতের গৌরবগাঁথা ধারণ করে আছে। বাড়ীটির পূর্ব ও দক্ষিণ দিকের বিশাল দেয়ালটি এখনো অবিকৃতভাবে দাঁড়ানো আছে । দু’দিকে রয়েছে প্রাচীন আমলের দু’টি রাজকীয় গেইট যা প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর পরিচয় বহন করছে। দেয়ালের মধ্যে রয়েছে রাজবাড়ীর মূল ঘরটি; যদিও পুরো ঘরটি সম্পূর্ণভাবে দাঁড়ানো নেই। শুধুমাত্র দেয়ালের ভূমিসংলগ্ন অংশ প্রায় ৪/৫ ফুটের মতো উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের দেয়ালের নীচের পাকা অংশ দেখে সহজেই সে ঘরের আয়তন সম্পর্কে জানা যায়। ঘরটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০ গজ এবং প্রস্থে প্রায় ১৫ ফুটের মতো হবে। উচ্চতা কেমন ছিল-তা বর্তমান সময়ে অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে স্থপতিদের দ্বারা সেটা সম্ভব হতে পারে বলে আমরা মনে করি।

প্রবীণদের প্রদত্ত তথ্যমতে, বর্তমানে রক্ষিত বাড়িটিতে আগে পাকা নির্মিত একটি বৈঠকের জায়গা ছিল যা ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় হারিয়ে গেছে। তাছাড়া আগে বর্তমান বাড়িটির উত্তর দিকে একটি পুকুর ছিল যা জাফলং নদীর সাথে সংযুক্ত ছিল। বর্তমানে তা ভরাট করে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় ইউ/পি সদস্য সাদ মেম্বার বর্তমানে সে জায়গাটির মালিক। রাস্তার কারণে সেখানে আর সাবেক কালের মূল রাজবাড়ীটির কোন নিদর্শন দেখা যায় না। মূল ঘরের ধংসাবশেষের কাছে প্রচুর ইট-সুরকি ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে যা বাড়িটির প্রাচীনত্বের ইঙ্গিত প্রদান করে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজের মাধ্যমে এ রাজবাড়ীর প্রাচীনত্বের পাশাপাশি আরও অনেক অজানা দিক উদঘাটিত হতে পারে।

মূল রাজবাড়ীটি বর্তমানে এক সুরক্ষিত পান-সুপারির জুমের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় এখানে যে দেয়ালসহ রাজবাড়ীর অবস্থান আছে, তা যে কারও দেখা তো দূরের কথা, অনুমান করতেও কষ্ট হবে। তাছাড়া বাড়ীর ধংসাবশেষ ও চতুর্দিকে পান-সুপারির গাছ রোপণ এবং আগাছার কারণে বাড়িটিতে এক ভুতুড়ে পরিবেশ রয়েছে। এতে ভেতরে ঢুকেও জায়গাটিকে চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য কাজ। খাসিয়া প্রবীণদের মধ্যে যারা এ বাড়ী সম্পর্কে জানেন, তাদের মধ্যেও এক ধরণের অস্পষ্ট বা ভুল ধারনা রয়েছে। তাদের অনেকেই মনে করেন যে, এটা একটা মন্দির। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর পর্যন্তও এখানে পূজা অনুষ্ঠিত হতে দেখেছেন বলে মন্তব্য করেন। তবে আশার কথা হচ্ছে-ঐতিহ্যবাহী বল্লাপুঞ্জির এ রাজবাড়ীটি এখনো  সরকারি রেকর্ডে মন্দিরের ভূমি হিসেবে চিহ্নিত এবং সরকারী মালিকানায় রয়েছে। বাড়িটি বর্তমানে গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং ইউনিয়নের অন্তর্গত ছৈলাখাল ২য় খণ্ড মৌজায় অবস্থিত। বাড়িটি ১০৩ জে.এল. নম্বরের ২৭ নম্বর দাগে অবস্থিত। মৌজা মানচিত্রে জায়গাটিকে মন্দির হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে মোট ভূমির পরিমাণ হচ্ছে ৮ ডিসিমেল।  অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকলেও বাড়িটিকে সংস্কার ও দখলমুক্ত করে এখনো দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব।

রাজবাড়ীসহ আশেপাশের সুরক্ষিত এ জুমবাগানটিতে মোট দশ বিঘা জায়গা রয়েছে। বর্তমান বাড়ী সংলগ্ন জুমের মালিক বল্লাপুঞ্জির বরেন লামিন এর তথ্যমতে, বল্লাপুঞ্জির রাজবাড়ীসহ পার্শ্ববর্তী মোট জমির পরিমাণ ছিল ১০ বিঘা । পুরো এ জায়গার মালিক ছিলেন তার মা কানেং লামিন। তার বোন পাহেলা লামিন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির ৬ বিঘা বিয়ানীবাজারের এক প্রবাসী বাঙালীর কাছে বিক্রি করে দেন যা এখন তাঁর দখলে আছে। তার মা কানেং লামিন তাঁর বাড়িতে আশ্রিত এক ধর্মীয় ভাইকে বাকি অংশ দিয়ে দেন। এ অংশ আবার সে লোকটির কন্যা শিরিং তংপের বরেন লামিনের কাছে বিক্রি করে দিয়ে ভারতে চলে যান। সর্বশেষ জরিপে জায়গাটি বরেন লামিনের নামে রেকর্ড হয়েছে। তাঁর জায়গার দাগ হচ্ছে ২৮। ২৯ দাগের পূর্বে ২৬ নং দাগ উপাই খংলার নামে রেকর্ড হয়। মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ (১৯২৭) এবং সৈয়দ মূর্তাজা আলী ১৯৫৪ সালে তাদের প্রকাশিত বইয়ে এ রাজবাড়ীর জাফলংয়ে অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন।

জাফলংয়ের সোনারটিলা, বল্লাপুঞ্জি, প্রতাপপুর , সেংগ্রেইন, নকশিয়ার ও লামাপুঞ্জি ইত্যাদির নামকরণ ও বসতিস্থাপনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা নিশ্চিত যে, জাফলং এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সুপ্রাচীনকাল থেকেই খাসিয়াদের বিচরণভূমি ছিল।
 
খাসিয়াদের এ রাজবাড়ী সম্পর্কে আলোচনায় তাঁদের সে ঐতিহাসিক রাজ্য ‘মালনিয়াং’ নিয়ে আলোচনা করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। খাসিয়ারা ভারতে বিশেষ করে খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড় এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপনকারী জাতিসমূহের মধ্যে যে অন্যতম, সে ব্যাপারে পণ্ডিতদের কোন মতানৈক্য নেই। সুসংহত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ‘রাষ্ট্র’ এর আবির্ভাবের আগে তা অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে এসেছে। রাষ্ট্রের ঠিক আগের অবস্থাটিকে রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানীরা ‘চীফডোম’ বা ‘মুখিয়াতন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রাগৈতিহাসিককালের যে সময়ই খাসিয়া জাতি উপমহাদেশে বসতি স্থাপন করুক না কেন তারা সে সময় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জন করেছিল।

জৈন্তিয়া পাহাড়, সিলেট এবং প্রাগজ্যোতিষপুরে (আসামের আদি নাম) পার্বত্য ও সমতলভূমির বিভিন্ন এলাকায় খাসিয়াদের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ অনেকগুলি ‘মুখিয়াতন্ত্র’ (রাজ্য বলতে যা বুঝায় প্রায় সেরুপ) গঠিত হয়েছিল। খাসিয়াদের এসব ‘মুখিয়াতন্ত্র’ তাদের ভাষায় ‘সিয়েম’ নামে পরিচিত। খাসিয়া প্রবাদে এসব সিয়েমকে একত্রে ‘kari lai phew syiem khaddar doloi’ যার বাংলা অর্থ হলো ‘ত্রিশ রাজা বার দলইর দেশ’ বলা হয়। দলই মানে এলাকা পতি বা অঞ্চল পতি। খাসিয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দলইগণের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। তাদের আরেক প্রবাদে আছে ‘Ri hynniew trop’ অর্থাৎ সপ্ত কুটিরের দেশ। এটি তাদের উৎপত্তি ও বিকাশের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে।

লোককাহিনী ও প্রবাদ মতে, প্রাচীন আমলের খাসিয়া সিয়েম বা রাজ্যগুলো  হচ্ছে জৈন্তা, মাহারাম, নংখোলাও, চেরা মাওইয়াং, খাইরেম, ভুওয়াল, শেল্লা, রামব্রাই, নংষ্টোইন, হাদেম মুকাশিয়ার, মেরওয়েট, নংখাম, মালনিয়াং প্রভৃতি। এদের মধ্যে ‘মালনিয়াং’ রাজ্যটি সবচেয়ে প্রাচীন, ক্ষমতাশালী এবং সর্ববৃহৎ ছিল বলে গবেষকগণ সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছেন।

খাসিয়া গবেষক ড. এইচ.বারেহ, ড. এইচ.লিংডহ, জে.এন. চৌধুরী, রুশ পতাম প্রমুখ প্রাচীন মালনিয়াং রাজ্য সম্পর্কে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন। খাসিয়াদের ইতিহাসের আলোচনায় যে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়, সেটি হচ্ছে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব। ১৭ শতকের আগে খাসিয়াদের কোন তথ্যভিত্তিক লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় না। কারণ ব্রিটিশদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত তাদের ভাষার কোন লিখিত রূপ ছিলনা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে লিখিত ইতিহাসের পূর্বে তাদের কী কোন ইতিহাস নেই, নেই কোন রাজত্ব বা রাজবংশের ইতিহাস? মিথ, কিংবদন্তী বা লোককাহিনী এ ব্যাপারে অনেক তথ্যভিত্তিক উপাদান সরবরাহ করেছে যার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে খাসিয়াদের গৌরবময় ও প্রাচীন ‘মালনিয়াং রাজ্য’ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকভাবে আলোকপাতের প্রয়াস পেয়েছেন।

গবেষকদের মতে, মালনিয়াং রাজ্যের রাজাগণ জায়ন্তিয়া বা সিন্টেং বংশোদ্ভূত লোক ছিলেন। সিলেটের অধিকাংশ এলাকা প্রাচীনকালে এ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মধ্যযুগ পর্যন্ত দু’টি স্থানে এ রাজাদের রাজধানী ছিল। একটি হলো খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের মাধুর-মাস্কুট নামক স্থানে এবং অন্যটি হচ্ছে সিলেট জেলার জাফলং এর ‘বল্লাপুঞ্জি’ নামক স্থানে। তবে বেশিরভাগ গবেষকই মাধুর-মাস্কুট মালনিয়াং রাজ্যের অপর নাম বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের আলোচ্য রাজবাড়ীটি সে রাজ্যেরই রাজবাড়ী। এ রাজ্যের সীইমদের সীম না ডেকে রাজা বলেই ডাকা হতো এবং তাদের রাজ্যকে ‘মধুর মাস্কুট’ নামে ডাকা হতো। কিংবদন্তী মতে, এ রাজ্যের পূর্বদিকে মণিপুর রাজ্য, উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদী, পশ্চিমে ময়মনসিংহ এবং দক্ষিণে ঢাকা-ত্রিপুরা অবস্থিত ছিল। জৈন্তিয়াসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য বা সীয়েমসমূহ এ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।
 
রুশ পতামের মতে, ’এ রাজ্যটি এককালে সিলেট সদর ও শহর এলাকা , কোম্পানীগঞ্জ ,সুনামগঞ্জ জেলার কিয়দংশ, জাইন্তিয়া পাহাড়ের কিয়দংশ এবং আসামের সমতলভূমি নিয়ে গঠিত ছিল। সিলেটের মালাগুল, মালনিছড়া, দলহরগঞ্জ,  গোয়াইনঘাট, ইয়াওফ্লাং (জাফলং), চিকনাগুল, শীলত (সিলেট) ইত্যাদি নামক স্থানগুলোর নাম এ রাজাদের সময়ে বা রাজাদের কর্তৃক নামকরণ করা হয়েছে বলে রুশ পতাম অনুমান করেছন। খাসিয়াদের আরেক প্রভাবশালী রাজ্য জৈন্তিয়া’র অনেক পূর্বেই এটার অস্তিত্ব ছিল।

সিলেট অঞ্চলে সম্ভবত: সিলেট শহরে অথবা শহরের অদূরে রাজাগণ বসবাস করতেন। পরবর্তীতে জয়ন্তিয়া ও গৌড় রাজাদের আধিপত্যের কারণে তাদের রাজধানী বালা (জাফলং এর ’বল্লাঘাট’) নামক স্থানে স্থানান্তরিত হয় এবং জাফলং নামক স্থানে ‘ফ্লুং’ বা রাজাদের প্রস্তর ফলক রাখা হতো। সিলেট সদর থানা , কোম্পানীগঞ্জ থানা এবং ছাতক থানা মিলে এই সব অঞ্চলকে ‘মাস্কুট লিটাং সমতল ভূমি’ নামে অভিহিত করা হতো’ (রুশ পতাম ২০০৫:৫৭-৫৮)।

তিনি লোককাহিনীর বরাত দিয়ে মন্তব্য করেন, এ রাজ্যের রাজাগণ হচ্ছেন নিয়াং রাজা, কল্লং রাজা, কন্দুর রাজা  এবং মাইলং রাজা। মাইলং রাজাই এ রাজবংশের শেষ রাজা। এ রাজার রাজবাড়ী ছিল জাফলং। তার অনুমান হচ্ছে,  তের শতাব্দীর পূর্বেই এই রাজ্যটি বিলুপ্ত হয়েছিল।

Dr. Homiwell Lyngdoh  তাঁর বিখ্যাত ‘Ki Syiem Khasi Bad Synteng’ গ্রন্থে প্রাচীন মালনিয়াং রাজ্য সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করেছেন। বইটি খাসিয়া ভাষায় লিখিত হলেও অন্যান্য গবেষকদের বরাতে আমরা সেই বইয়ে প্রদত্ত তথ্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। খাসিয়া গবেষক জে এন চৌধুরী তার The Khasi People বইতে প্রাসঙ্গিক অংশটুক ইংরেজীতে তুলে ধরেছেন।

Dr. Homiwell Lyngdoh  মালনিয়াং রাজ্য সম্পর্কে বলেন,
‘The Malyangiang Syiems or Madur Maskut Syiems were great and powerful Syiems of these hills. The people used to call them ‘God Kings’ ; and their kingdom tradition holds , touched Damer (Dimarua) in Nowgong in Assam to the north, running along the Khasi and Jaintia Hills upto Kuwain (Sylhet) in the south. Tradition affirms that at one time the kingdom included the whole of Jaintia Hills. After Kyllong Raja was killed, the Synteng (Jaintia) succeeded in conquering and annexing the Kingdom of Madur Maskut. From that time, the Malyngiang people were scattered throughout Khasi and Jaintia Hills. According to tradition, from the time that disappearance of the Malyngiang Kingdom till the advent of the British, seven generations have passed by. If you allow 25 years for a generation  and if you take 1826 as the year when the East India Company first came to these Hills, the Kingdom of Maskut came to an end in 1651 i.e. at the time of Jasamanta Roy, the Syiem of the Synteng people and Jaintapur.’ (Quoted by J.N. Chowdhury 1996:)।

অর্থাৎ মালনিয়াং রাজ্যটি উত্তর দিকে আসামের নওগা জেলার দিমারুয়া থেকে খাসি-জৈন্তিয়া পার্বত্য অঞ্চল হয়ে দক্ষিণ দিকে সিলেটের গোয়াইঘাট পর্যন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজ্যটি ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে জৈন্তিয়া রাজা যশোমন্ত রায়ের হাতে সমাপ্তি ঘটে।

Dr. Bareh (1967) এর তথ্যমতে, মালনিয়াং রাজত্বের সমসাময়িক খাসিয়া চিফডমগুলো হচ্ছে পূর্বদিকে জৈন্তিয়া, মধ্য অঞ্চলে Mawroh Marpri এবং পশ্চিমদিকে Inog Syiem। তিনি একমত যে, মালনিয়াং রাজারা তাদের রাজ্যকে কামরুপের বেলতলা, মালাগুল (মুলাগুল যা বর্তমানে সিলেটের কানাইঘাটে অবস্থিত) এবং সুরমা উপত্যকার সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। Dr. Bareh (1967) এ রাজ্যের সর্বশেষ ৩ জন রাজার নাম উল্ল্যেখ করেছেন। তারা হচ্ছেন- নিয়াং রাজা, কল্লং রাজা এবং মাইলং রাজা। মাইলং রাজা ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চল শাসন করেছেন বলে তিনি মতপ্রকাশ করেছেন। মালনিয়াং রাজারা অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

P.R.T. Gurdon (1914) তাঁর বিখ্যাত ‘The Khasi’ বইতে মালনিয়াং রাজ্য সম্পর্কে মন্তব্য করেন এভাবে ‘The weird tale about the Siem of Malyniang (Malyngiang) is the pride of the Maskut people, for in older day their king, i.e. the Siem of Malyniang, is supposed to have been a very powerful monarch amongst the Khasis’।

অন্যদিকে, সিলেট ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারে (১৯৭৫) বর্ণিত তথ্যমতে, জৈন্তার রাজা বিজয় মানিকের আমলে এটি জৈন্তারাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

আমরা এবার দৃষ্টিপাত করবো ‘জৈন্তিয়ার ইতিহাস’ রচিয়াতের দিকে যারা সিন্টেং বা জৈন্তা জাতির পাশাপাশি ভৌগলিক অঞ্চল হিসেবে প্রাচীন জৈন্তিয়ার ইতিহাস রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। আমরা জৈন্তার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই সরাসরি এ রাজ্যের সাথে প্রাচীন মালনিয়াং কিংবা জাফলং রাজ্যের সম্পৃক্ত অংশটুকুর দিকেই নজর দেব।

মোহাম্মদ আবদুল আজিজ রচিত ‘জৈন্তা রাজ্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে জাফলং পরগণা বা রাজ্যের ইতিহাস তুলে ধরেছেন এভাবে,

’...... রাজা জয়ন্ত রায়ের তিন পুত্র ও এক পোষ্য কন্যা ছিলেন। কন্যার নাম ছিল জৈন্তি; উহাকে একটি বৃহৎ মাছের পেটে পাওয়া গিয়াছিল বলিয়া মাছের পেটের রাণীও বলা হইত। ইনি শৈশবে পর্বতের ’হুতুঙ্গা’ পুঞ্জিতে প্রতিপালিত হইয়াছিলেন বলিয়া রাজা তাহাকে সেই পুঞ্জিরই খাসিয়া সর্দারের পুত্র লন্ডবরের সহিত বিবাহ দিয়াছিলেন। খাসিয়াগণ বিবাহের পর শ্বশুরালয়ে চলিয়া যায় এবং কন্যা পিতৃগৃহেই থাকে। ইহা তাহাদের চিরন্তন প্রথা । সুতরাং এই নিমিত্ত রাজা নিজপাট নগরীসহ জৈন্তাপুরীরাজ পরগণা ঐ কন্যাকে, জাফলং পরগণা ১ম পুত্রকে; চারিকাটা পরগনা ২য় পুত্রকে ও ফালজুর পরগনা ৩য় পুত্রকে বন্টন করিয়া দিয়া পরলোক গমন করেন।

এই রাজ্য বিভাগকালে রাজা জয়ন্ত রায় সমতা রক্ষার জন্য প্রত্যেক একই নামবিশিষ্ট গ্রামসমূহের নামকরণ করিয়াছিলেন। যথ: বাউরভাগ, ভিত্তিখেল, চৈলাখেল, পাঁচসেউতিখেল, নয়াখেল, লক্ষীপ্রসাদখেল ও হুরুখেল। এই জন্য উক্ত চারিরাজকে ’খেলুরাজ’ বলা হয় এবং ঐ খেলুরাজ চতুষ্টয়ে আজও সেই গ্রামসমূহ বিদ্যমান আছে।

কালক্রমে ঐ কন্যা স্বীয় বুদ্ধি ও ক্ষমতাবলে অতিশয় পরক্রান্ত হইয়া উঠেন এবং প্রথমত: চারিকাটার অধিশ্বরকে নিহত করিয়া তাহাদের রাজ্য ও নিজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিয়া লন। এবং স্বীয় নামানুসারে বা পালক পিতার নামানুসারে ‘জয়ন্তা বা জৈন্তিয়া’ বলিয়া রাজ্যের নাম রাখেন। এখনও চারিকাটা, ফালজুর ও জাফলং এ রাজবাড়ীত্রয় বিদ্যমান থাকিয়া সেই প্রাচীন কীর্তির পরিচয় দিতেছে। চারিকাটার রাজবাড়ীকে ’দুধরাজার বাড়ী’ এবং জাফলং এর রাজবাড়ীকে ‘মাইলং রাজার বাড়ী’ বলা হইয়া থাকে। জাফলং এর রাজবাড়ীতে বর্তমানে কমলার বাগান অবস্থিত, কিন্তু অপর রাজবাড়ীদ্বয় ঘোর অরণ্যে আচ্ছাদিত’ (মোহাম্মদ আবদুল আজিজ ১৯২৭:২-৩)।

Syed Murtaza Ali , তার The History of Jaintia বইতে উল্ল্যেখ করেছেন,

‘---------We have already said that Kingdom of Jaintia consisted of Jaintapuriraj pergana only before the advent of Bijoy Manik. Charikata, Faljur and Jaflong were three separate principalities at that time. It was Bijoy Manik who consolidated the kingdom. After the death of the princes of Jaflong and Charikata, he seized their territory. Then he treacherously got Long Raja, prince of Faljur, murdered and included his territory also in his domain. Long Raja is said to have been a powerful monarch among the Synteng. Long Raja is referred to as a Raja of Jaintia by Col. Gurdon. The traces of the places of the prices of Charikata, Faljur and Jaflong are still to be seen in these perganas.’ (Syed Murtaza Ali 1954:8)।

রাজা বিজয় মানিকের রাজত্বকাল উল্ল্যেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, Bijoy Manik was the contemporary of  Bejoy Manikya, King of Tipperah (1528-79) and Koch King Narrayana(1540-87)। তাঁর মতে, রাজা যশোমন্ত রায়ের শাসনকাল হচ্ছে ১৬৪৮-১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দ।

মালনিয়াং রাজ্য এবং প্রভাবশালী রাজা কল্লং সম্পর্কে জাফলং এ বসবাসরত প্রবীণ খাসিয়াদের মধ্যে অনেক কিংবদন্তী চালু আছে। বল্লাপুঞ্জির বরেন লামিন সে কিংবদন্তী সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়েছে। Bijoya Sawian তাঁর ‘Khasi Myths, Legends and Folklore’  বইতেও এ কিংবদন্তী বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন। জেএন চৌধুরী তাঁর The Khasi People ‘বইতেও এ কিংবদন্তী’র আলোচনা করে তাঁর সত্যাসত্য বিচারের চেষ্টা করেছেন।

কিংবদন্তী মতে, রাজা কল্লং ঐশ্বরিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন। ঐশ্বরিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কল্লং রাজা মাধুর মাস্কুট গ্রামে বসবাস করতেন। গ্রামটি বর্তমানে মাস্কুটের দলইশীপের অধীনে অবস্থিত। কল্লং রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, পুরো সিন্টেং রাজ্য এবং পার্শ্ববর্তী খিনরিয়াম (উপরদিকের খাসি) রাজ্যগুলোও তাঁর রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসবেন। রাজার স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষমতাও তাঁর নিজের ছিল। কারণ রাজার কোন শক্তিশালী বাহিনীর প্রয়োজন ছিল না এবং তিনি কখনো কোথাও পরাজিত হন নি। যদি তিনি কখনো মারাও যান তবে ঐশ্বরিক জাদুমন্ত্রে তিনি জীবন ফিরে পান। একদা এরকম এক ঘটনা ঘটেছিল। সিন্টেং সিয়েমের লোকের একদা তাকে হত্যা করে দেহকে সবদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পরের দিন তিনি আগের রুপে আবির্ভূত হলেন। সিন্টেং রাজা তা দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন এবং কল্লং রাজার ক্ষমতার গোপন রহস্য জানার জন্য অনুসন্ধান শুরু করলেন। অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে সিন্টেং বা জৈন্তিয়া রাজা এর রহস্য উদঘাটনের জন্য ভিন্ন এক কৌশল গ্রহণ করলেন।সমস্ত রাজ্য জুড়ে তালাশ করে এক সুন্দরী তরুণীকে বের করা হলো । তাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে বর্ণনা করে দামি মিহি পোশাক-পরিচ্ছেদ এবং মূল্যবান অলংকার দান করা হলো। সে যদি কল্লং রাজার গোপন ক্ষমতার রহস্য বের করে আনতে পারে, তবে তাকে আরও মূল্যবান অনেক সম্পদ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলো। সে প্রাপ্ত উপহার পেয়ে রাজার প্রস্তাবে অর্পিত কাজ করতে রাজি হয়ে গেল। এবার তাকে নির্দেশনা দেওয়া হলো কিভাবে সে কাজ করবে। তাকে বলা হলো সে যেন সেজে-গুজে ঘন ঘন বাজারে যাতায়াত করে যে বাজারে কল্লং রাজা যাতায়াত করেন। নিজের সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব দ্বারা যেন সে রাজাকে প্ররোচিত করে। সিন্টেং সিয়েম হিসাব করলো যে, এতে রাজা তাঁর সৌন্দর্য্যে আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিয়ে করবে। রাজা তরুণীকে বললেন যে, যদি তার হিসাব মিলে যায় তবে সে যেন চরম ভালোবাসার ছলনা করে এবং রাজার আত্ববিশ্বাসকে জয় করে গোপন ক্ষমতার রহস্য উদঘাটন করে। সিন্টেং রাজার হিসেব পুরোপুরি মিলে গেল। কল্লং রাজা তরুণীর সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিয়ে করলেন।

দিন দিন কল্লং রাজা তার প্রতি সুন্দরীর চরম ছলনাময় ভালবাসায় একেবারে প্রেমে অন্ধ হয়ে পড়লেন এবং তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। স্ত্রীর উপর রাজার এত আত্মবিশ্বাস জন্মালো যে তিনি তাঁর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার গোপন রহস্য তাঁর কাছে প্রকাশ করলেন। তিনি তাকে বললেন যে, তাঁর সব ক্ষমতা তার নাড়িভুঁড়ির মধ্যে অবস্থান করে। কল্লং স্ত্রীকে বললেন যে, প্রতিদিন সকালে তিনি যখন গোসল করেন তখন সব নাড়িভুড়ি বের করে পানি দিয়ে যথাযথভাবে ধৌত করেন এবং এরপরই প্রথম খাবার গ্রহণ করেন। কেউ যদি খুব শক্তিশালী হয় এবং গোসলের সময় তার নাড়িভুড়ি কেঁড়ে নিতে পারে, তবেই তার ইতি ঘটবে। অন্যথায় পৃথিবীর কেউই তাকে পরাজিত করতে পারবে না কিংবা তার মৃত্যু ঘটাতে পারবে না। নিজের স্বামী কল্লংয়ের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে সে সব গোপন কথা তাকে যে সিন্টেং রাজা পাঠিয়েছিল, তাঁর চরের সাথে গোপনে সব কথা প্রকাশ করে রাজার কাছে পৌঁছে দেওয়ার দেয়ার জন্য পাঠিয়ে দিল।

কল্লং রাজার ক্ষমতার গোপন রহস্য সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর সিন্টেং রাজা ‘রেলিয়েং’ থেকে একজন বিশ্বস্ত ও শক্তিশালী লোককে ডেকে পাঠালো। তাঁকে সব খুলে বলার পর অত্যন্ত বিশ্বাস করে কল্লং রাজাকে হত্যার মিশনে পাঠানো হলো। সে ও রাজাকে হত্যার জন্য সম্ভাব্য সব কৌশল ও শক্তি প্রয়োগ করবে বলে সিন্টেং রাজাকে আশ্বস্ত করলো। যেমন কথা তেমন কাজ। সে গোপনে রাজাকে অনুসরণ করে সুযোগ খুঁজতে লাগলো। একদিন সে সুযোগ আসলো।

অভ্যাসবশত: রাজা একদিন নদীতে গোসল করতে নামলেন, নাড়িভুঁড়ি বের করার পর সেগুলো যথারীতি ধৌত করে নদীর তীরে রাখলেন। এসময় ‘রেলেয়িং’ থেকে আগত লোকটি যে কিনা গোপনে তাকে অনুসরণ করছিলো সে রাজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তাকে হত্যা করলো। এরপর থেকে তিনি তিনি চিরদিনের মতো ক্ষমতাহীন হয়ে পড়লেন। কল্লং রাজার মৃত্যুর পর তার সকল ক্ষমতার উৎস ‘নাড়িভুড়ি’ কে ছোট ছোট টুকরো করে কুকুরকে খাওয়ানো হলো। সিন্টেং রাজা তার রাজ্য ও রাজত্ব দখল করলেন এবং কল্লং রাজার পরিবারের সব সদস্যকে নির্বাসিত করা হলো । এভাবে কল্লং রাজত্বের দু:খজনক ইতি ঘটলো।

দেখা যাচ্ছে যে, প্রাচীন মালনিয়াং রাজ্যকে ’মাধুর মাস্কুট’ রাজ্য নামেও ডাকা হতো এবং এর রাজধানী ছিল জাফলংয়ের বল্লাপুঞ্জিতে। রাজার মৃত্যুর পর সম্ভবত: পাহাড়ের দুর্গম কোন স্থানে চলে গিয়েছিলেন। নিয়াং রাজা, কল্লং রাজা, কন্দুর রাজা এবং মাইলং রাজা এ রাজ্যের শাসনকর্তা ছিলেন। মাইলং রাজাই এ রাজ্যের শেষ রাজা। তবে এ রাজ্যের অস্তিত্বকালের সময় নিয়ে আমরা পণ্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য দেখতে পাই। Dr. Homiwell Lyngdoh জৈন্তিয়ার রাজা যশোমন্ত রায়ের সময় ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ রাজ্য অস্তিত্বমান ছিল বলে মত প্রকাশ করেছেন।

ফজলুর রহমানের মতে, যশোমন্ত রায় ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তাঁর শাসনকাল ১৬৪৭-১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দ। আমরা এ দু’জনের সময়কালের মধ্যে এক ধরণের ঐক্যমত্য দেখতে পাই । Dr. Bareh (1967) মাইলং রাজা ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ রাজ্য শাসন করেছেন বলে মতপ্রকাশ করেছেন। রুশ পতামও একই মত পোষণ করেছেন।

অন্যদিকে, সিলেট ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ার, মোহাম্মদ আবদুল আজিজ এবং সৈয়দ মুর্তাজা আলী একমত যে, জৈন্তিয়ার রাজা বিজয় মানিকের সময় দ্বিতীয়বারের মতো হয়তোবা জাফলং তাঁর স্বাধীনতা হারায় এবং এটি তখন জৈন্তিয়া রাজার অধীনস্থ আধা-স্বাধীন কোন রাজ্য হিসেবে ছিল। রাজা বিজয় ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তাঁর শাসনকাল হচ্ছে ১৫৬৪-১৫৮০ পর্যন্ত। আমরা দেখতে পাই যে, বেশিরভাগ গবেষকই ১৫ শতক বা ১৬ শতকের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তবে আমাদের অনুমান হচ্ছে, বিজয় মানিকের সময় হয়তোবা সম্পূর্ণভাবে রাজ্যটি তাঁর স্বকীয়তা হারিয়ে বিলুপ্ত হয়ে জৈন্তিয়া রাজ্যের সাথে একীভূত হয়ে যায়।

মোহাম্মদ আবদুল আজিজ রচিত ‘জৈন্তা রাজ্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে জাফলং পরগণা বা রাজ্যে সৃষ্টির যে ইতিহাস তুলে ধরেছেন, তা হয়তো পরবর্তীকালের ঘটনা। রাজা জয়ন্ত রায়ের বহু আগেই রাজ্যটি তাঁর নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেছিল এবং তিনি তাঁর অধীন রাজ্যকে বিভাজিত করেছিলেন মাত্র। এর পূর্বেই মালনিয়াং রাজ্যটি হয়তো প্রথমবারের মতো তার গৌরবময় স্বাধীনতা হারিয়ে জৈন্তিয়া রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে তা যশোমন্ত রায় বা বিজয় মানিকের সময় জৈন্তিয়া রাজ্যের মধ্যে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এর পূর্বে রাজ্যটি হয়তো জৈন্তিয়া রাজার অধীনতা স্বীকার করে কোন রকম নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল। আমাদেরও অনুমান হচ্ছে, তের শতকের পূর্বেই মালনিয়াং বা মাধুর মাস্কুট রাজ্যটির গৌরবজনক ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।

কিংবদন্তী, মিথ বা লোককাহিনী ইতিহাস না হলেও এর মধ্যে ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়। প্রাচীন ‘মালনিয়াং রাজ্য’ সম্পর্কে যে সব কিংবদন্তী ও লোককথা প্রচলিত আছে, নিশ্চয়ই তার মধ্যে অনেক সত্য আছে। আর এজন্য খাসিয়া গবেষকরা বারবারই এ রাজ্য সম্পর্কে আলোকপাতের প্রয়াস পেয়েছেন। সে রাজ্যের রাজাদের ধারাবাহিকতা, রাজ্যের বিস্তৃতি, সে রাজ্যের বস্তুগত উপাদানসমূহের ধবংসাবশেষ ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে সে রাজ্য ও রাজাদের সম্পর্কে তারা নিশ্চিত তথ্য প্রদান করেছেন। জাফলংয়ের বল্লাপুঞ্জির রাজবাড়ীর ধংসাবশেষ এখনও সে সত্যেরই সাক্ষ্য বহণ করেছে। প্রাচীন মালনিয়াং বা মাধুর-মাস্কুট রাজ্যের ইতিহাসের ব্যাপক অধ্যয়ন শুধু খাসিয়াদের গৌরবময় অতীত নয়, পুরো সিলেটের ইতিহাসের ইতিহাসের সত্য উদঘাটনে সহায়তা করবে। জাফলংয়ের বল্লাপুঞ্জির রাজবাড়ীর সংস্কার ও সংরক্ষণে প্রশাসনের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যক্তি ও সংগঠনকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন যা পর্যটনকেন্দ্র জাফলংকে আরোও মহিমান্বিত করে তুলবে বলে আমরা মনে করি।


আবদুল হাই আল হাদী, প্রধান সমন্বয়কারী, সেভ দ্য হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট

আপনার মন্তব্য

আলোচিত