সিলেটটুডে ডেস্ক

০২ মে, ২০১৬ ১৮:৫৬

বাংলাদেশি ব্লগারদের নরডিক দেশগুলোতে আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান

বাংলাদেশি ব্লগারদের নরডিক দেশগুলোতে আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে নরডিক ও এস্তোনিয়ান পেন সেন্টার। মুক্তমনা ব্লগারদের ওপর সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন এমন ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা প্রদানের জন্য বাংলাদেশের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে লেখকদের এ সংগঠন।

২৮ এপ্রিল পেন ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানায় নরডিক ও এস্তোনিয়ান পেন সেন্টার।

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আবারও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এক মাসের মধ্যে সেখানে চারজন মুক্তমনা ব্যক্তি বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আমরা বাংলাদেশের মুক্তমনা মানুষদের সুরক্ষার পথ খুঁজে বের করতে ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেনে আমাদের নিজ নিজ দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। যারা একটি সংকটপূর্ণ দেশে আছেন তাদের জন্য আমাদের দেশগুলোতে আরও ‘নিরাপদ আশ্রয়’-এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং ঢাকার সঙ্গে শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নরডিক দেশগুলোর প্রতি তাগিদ দিয়েছে লেখকদের এ সংগঠন।

সম্প্রতি নিহত জুলহাজ মান্নানকে (৩৫) সমকামী অধিকারকর্মী এবং এলজিবিটি ম্যাগাজিন রূপবান-এর সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করেছে নরডিক ও এস্তোনিয়ান পেন সেন্টার।

সংগঠনটি বলছে, গত ২৫ এপ্রিল মার্কিন সহায়তা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-ইউএসএআইডির কর্মী জুলহাজ মান্নান ঢাকায় তার নিজ বাসায় খুন হন। হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ওই সময়ে জুলহাজার বাসায় থাকা তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয় (২৬)।

চলতি বছরের ৭ এপ্রিল বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন নাজিমুদ্দিন সামাদ নামের আইনের এক শিক্ষার্থী। নিজের ফেসবুকে তিনি ইসলাম সম্পর্কে সমালোচনামূলক লেখালেখি করতেন।

২০১৫ সালে বাংলাদেশে পাঁচজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, লেখক ও প্রকাশক খুন হন। খুনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগ মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ও রয়েছেন।

এসব বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড একটা ভয়ানক বার্তা প্রদান করে। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের জন্য নীরবতা, ভয় ও চরম বিপদের আবহ বিরাজমান। মুক্তমনা, ধর্মনিরপেক্ষ, ধর্মীয় ও লৈঙ্গিক সংখ্যালঘু গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে ইসলামী মৌলবাদীদের সাম্প্রতিক প্রবণতা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছেছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ; যাদের একটি সমন্বিত জাতীয় পরিচয় রয়েছে এবং সহনশীলতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তাদের জন্য এটা অপ্রত্যাশিত।

১৯৭৫ সাল থেকে দুইজন সামরিক শাসকের মাধ্যমে বাংলাদেশে ধর্মীয় রূপান্তর ঘটতে থাকে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। কিন্তু গণতান্ত্রিক নেতারা ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও মৈত্রীতে আবদ্ধ হন। নির্বাচনি রাজনীতির অংশ হিসেবেই তারা এ যোগাযোগ রক্ষা করেন। এর ফলে ইসলামপন্থী লোকজন গণতান্ত্রিক নীতিকে বিচ্যুত করতে সক্ষম হয়েছেন।


নরডিক ও এস্তোনিয়ান পেন সেন্টার বলছে, ইসলামি মৌলবাদীদের সহিংস প্রচারণা থেকে আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মীদের সুরক্ষা কামনা করছি। এ ধরনের সংস্কৃতি থেকে রেহাই পেতে এসবের মূল হোতাদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন।

ভিন্নমতের মানুষের ওপর হামলার সর্বশেষ শিকার জুলহাজ মান্নান এবং মাহবুব রাব্বী তনয়। তাদেরকে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে খুন করা হয়। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল অ্যাসিসটেন্ট জুলহাজ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাতো ভাই।

এ হত্যাকান্ডের পর দেওয়া এক বিবৃতিতে এর নিন্দা জানান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। তিনি বলেন, ‘যে ‍বিষয়গুলো জুলহাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেগুলোর প্রতি আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বে সহনশীলতা ও মানবাধিকারের জন্য যারা কাজ করছেন তাদের সবাইকে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার রয়েছে আমাদের।’

ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জন কিরবি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, ‘যে কাপুরুষরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের বিচার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে আমাদের সহযোগিতার অঙ্গীকার করছি।’

জন কিরবি বলেন, ‘তিনি (জুলহাজ) ছিলেন সমকামী অধিকারের একজন সাহসী মুখপাত্র, যা মানবাধিকার এবং তার এ হত্যাকাণ্ড বর্ণনাতীত, অগ্রহণযোগ্য ও ক্ষমার অযোগ্য।’

২৬ এপ্রিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ‘আমরা ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। এসব ঘটনার সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করতে এর তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।’

বিবৃতিতে বলা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রত্যাশা বাংলাদেশ সরকার একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। সব নাগরিকের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য এর প্রয়োজন রয়েছে।

এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে পৃথক বিবৃতি দিয়েছে ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান দূতাবাস। ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত থমাস প্রিঞ্জ বলেন, ‘মাহবুব তনয় ও জুলহাজ মান্নানের লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডে আমি গভীরভাবে মনঃক্ষুণ্ণ ও মর্মাহত। এ দুই স্পষ্টভাষী উদারমনা অধিকারকর্মীর হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। এটা শুধু দুই সাহসী ব্যক্তির ওপরই হামলা নয়, বরং এটা এদেশে বাকস্বাধীনতার ওপর হামলা। এ ঘটনার দ্রুত ও যথাযথ তদন্তে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। বিগত মাসগুলোতেও আমরা এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটতে দেখেছি। এখন সময় এসেছে পুরো সমাজকে একসঙ্গে এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারকে রক্ষা করার।'

বাংলাদেশে ব্লগার-অ্যাকটিভিস্ট ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের সর্বশেষ শিকার জুলহাজ মান্নান। এখন পর্যন্ত কেউ তার হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার না করলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আইএসের নামে এ ধরনের অধিকাংশ ঘটনার দায় স্বীকারের বার্তা এসেছে। যদিও দাবি খারিজ করে বাংলাদেশ সরকার বলে আসছে, বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এই জঙ্গি গোষ্ঠীর কোনো অস্তিত্ব নেই। সূত্র: পেন ইন্টারন্যাশনাল।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত