কলকাতা থেকে একুশ তাপাদার

০৮ মে, ২০১৬ ২১:০০

জোটে জোশ নেই, পশ্চিমবঙ্গে ফের মমতাই!

বিধানসভা নির্বাচন ২০১৬

প্রথম দুই দফায় শাসক দল তৃণমূলের জোরজবরদস্তি, অনিয়ম। শেষের দিকে নির্বাচন কমিশনের কঠোর অবস্থান। একের পর এক পুলিশ কর্তার বদলি। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে মমতার তেড়েফুঁড়ে আসা, অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে ৫ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ছয় পর্বের ভোটগ্রহণ শেষ হয়।

নির্বাচনের ফল ঘোষণা হবে আগামী ১৯ মে। ক্ষমতায় মমতাই থাকছেন নাকি কোন পালাবদল? রাজ্যের রাজধানী কলকাতা শহর ঘুরে পাওয়া গেল বিভিন্ন মত।

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে আসন সংখ্যা ২৯৪টি। ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৫৫ লাখ ৪৬ হাজার ১০১। এই নির্বাচনে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস জোড়া ফুল প্রতীকে, বিজেপি পদ্মফুল মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। জাতীয় কংগ্রেস ও সিপিআই (এম) জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করায় একেক আসনে তাদের প্রতীক একরকম।   মোট ৭৭ হাজার ২৪৭টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হয়েছে।


ছবি: এনডিটিভি

৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে বিপুল বিক্রমে ক্ষমতায় এসেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সাদাসিধে জীবন যাপন, যেকোনো ব্যাপারে স্পষ্ট কথা বলার দৃঢ়তায় আকৃষ্ট মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল বিপুল পরিবর্তনের। কতটা পরিবর্তন করতে পারলেন মমতা এমন প্রশ্নে বারাসাতের সায়ন্ত বলেন, ‘বেশ কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে তবে শিল্পায়ন বন্ধ, চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হয়নি’।



“যে গরু দুধ দেয় সে দুচারটা লাথি দিলে কিছু যায় আসে না”।  কলকাতা শহর ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে কথা বলে এই প্রবাদ বাক্যের অনুরণন পাওয়া গেল সবচেয়ে বেশি । সারদা,নারদা কেলেঙ্কারি, ফ্লাইওভার ধ্বস, বেসামাল কথাবার্তা, ধর্মীয় মৌলবাদকে আশ্রয় প্রশ্রয়, প্রতিপক্ষকে নিপীড়ন এতকিছুর পরও ফের মামতাই জিতবেন? এমন প্রশ্নে ট্যাক্সি ড্রাইভার বিশ্বরূপ বলেন, ওসব দুর্নীতি ফুর্নিতি সবাই করে দাদা, দিদি কাজটা কিন্তু করছে”।

লোকাল ট্রেনে করে যাওয়ার সময় কথা হয় মধ্যবয়স্ক নিখিল দাসের সাথে, কতটা কি করেছেন মমতা এমন প্রশ্নে বলেন, ‘বামেদের থেকে এরা দৃশ্যমান অনেক কাজ করেছে’। পাশ থেকেই ঋত্বিক নামের এক তরুণ বলে উঠেন – ‘চাকরি দিবে বলেছিল, উল্টো শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে ত লোকেদের চাকরি গেল’। কিন্তু বাম-কংগ্রেস জোট কি এসবের সমাধান দিতে পারবে? এমন প্রশ্নে জোর আশাবাদও পাওয়া গেল না কারও কাছ থেকে।

প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মী অরিন্দম মুন্সির সাথে কলকাতা শহরে নানান প্রান্তে ঘুরতে বের হয়ে দেখা মিলল মমতার আমলে হওয়া বেশ কিছু ইতিবাচক উন্নয়নের চিত্র। নিম্ন আয়ের মানুষদের বসবাস করা একটি বস্তি দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায় সেখানে বস্তির লোকেদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বেশ ভালো মানের একটি গণশৌচাগার করে দেয়া হয়েছে। জানা গেল প্রায় সব বস্তিতেই আছে এমন ব্যবস্থা। অদূরেই একটি বিশুদ্ধ শীতল পানীয় জলের একটি পয়েন্ট দেখা গেল। গরমে হাঁপিয়ে উঠা মানুষকে স্বস্তি দিতে এমন ‘ওয়াটার পয়েন্ট’ শহরের নানান প্রান্তেই রয়েছে। যৌক্তিক দূরত্বে রয়েছে গণশৌচাগারের ব্যবস্থা। অর্থনৈতিকভাবে অতি দরিদ্র মানুষদের জন্য ২টাকায় চাল কেনার সুবিধাও আছে।


কেবল শহর কেন্দ্রিক নয় জীবন মান বাড়ানোর নানা উদ্যোগ পুরো রাজ্য জুড়েই নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। নবম-দশম শ্রেণী পড়ুয়া কয়েকলাখ শিক্ষার্থীদের হাতে তোলে দেয়া হয়েছে একটি করে বাইসাইকেল। দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা পরিবারের কন্যা সন্তানদের জন্য চালু করা হয়েছে ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প।



একই সাথে পাতালরেল, ট্রাম, উড়ালসড়কের শহর কলকাতায় গনেশ টকিজের সামনের ফ্লাইওভার (উড়ালসড়ক) ভেঙ্গে পড়লেও বেশ কয়েকটি উড়ালসড়কের ব্যবস্থাপনায় যানজট নেই বললেই চলে। শহর কলকাতার একটি রাস্তাও ভাঙা নেই। এমনিতে ঢাকার চেয়ে কয়েকগুণ বেশ পরিচ্ছন্ন শহর কলকাতায় আগে যেসব নিচু এলাকায় অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা তৈরি হত এখন উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার ফলে অতি বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতার হয়না। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে সক্ষমতা অর্জনও মানুষের জীবন যাপনে এনে দিয়েছে গতি।

তবে মমতার সরকার ৫ বছরের পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে সুশাসন দিতে পারেনি। তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের উগ্র ও স্বেচ্ছাচারী আচরণে আক্রান্ত হয়েছেন অনেক সাধারণ মানুষ। মমতা নিজে চটি পরে ঘুরে বেড়ালেও দলের দুর্নীতিবাজ নেতাদের আশ্রয় দিয়েছেন ঠিকই। ‘দিদির পায়ে সস্তা চটি, সঙ্গে সব কোটিপতি’। এই শ্লোগানটি এখন পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই কান পাতলে শোনা যায়।

তাঁর সরকারের পরিবহন মন্ত্রী মদন মিত্র সারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়ে কারান্তরিন থাকলেও ফের নির্বাচনে তাকেই মনোনয়ন দিয়েছেন মমতা। শোনা যাচ্ছে বিতর্কিত মদন মিত্র তৃণমূলের জোরজবরদস্তির রেশে জিতেও যেতে পারেন।


মমতার পরিচিতি আছে উন্মুক্ত মঞ্চে নানান চটকদার কথা বলার। এ প্রসঙ্গে অরিন্দম মুন্সি বলেন,  ‘উপমহাদেশে মমতার মত অভিনয়ে দক্ষ রাজনীতিবিদ দ্বিতীয় কেউ নেই’।

বাংলাদেশের মতই পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতির নানান খেলা চলে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেছে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারও।

প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মী অরিন্দম মুন্সি বলেন, ২০১৩ সালে শাহবাগের সমর্থনে তারা মিছিল নিয়ে বের হলে পুলিশ সেটা করতে দেয়নি।

তিনি জানান, পুলিশের সাথেই সেদিন উর্দুভাষী বিহারী মুসলিমরা আগ্রাসী ভূমিকায় ছিল। পরদিন এই উর্দুভাষীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষ নিয়ে মিছিল সমাবেশ করলে পুলিশ তাতে প্রটেকশন দিয়েছিল।

তিনি বলেন, এ সবই হয়েছে মমতার নির্দেশে। মুসলিম ভোটারদের ভোট টানতে তৃণমূলের কৌশল ছিল এটা।

তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতার সাথে জামায়াতে ইসলামির যোজসাজোশের খবর বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে।

তবে এতকিছুর পরও বিকল্প হিসেবে তেমন কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। ৩৪ বছরের বাম শাসনে তিতিবিরক্ত মানুষের সহসাই আবার বামেদের প্রতি সহানুভূতি ফিরে আসা কঠিন। কংগ্রেসের সাথে এবারের নির্বাচনে বামফ্রন্টের জোট হলেও এই জোট নিয়েও নানান মহলে সন্দেহ আছে। রাহুল গান্ধী ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কেবল মাত্র একবারই একটি জনসভায় ভাষণ দিয়ে নিজেদের পক্ষে ভোট চেয়েছেন।

মমতাকে হটাতে রাজনৈতিকভাবে বিপরীত মেরুর এই দুই দলের মেলবন্ধন মানুষকে আস্থা দিতে পারছেনা। বরং তাদের দোলল্যমনতা, ভিশন মিশনে অস্পষ্টতার চিত্র উঠে আসছে বারবার।


কোন কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, প্রথম তিন দফাতেই ক্ষমতায় আসার জন্য ১৪৮ সিটের ভিত পেয়ে গেছে তৃণমূল। এবার আগেরবারের চেয়ে আসন সংখ্যা কমলেও সহজেই ১৬০টির বেশি আসন তারা পেয়ে যাবে। তবে এই কথায় দ্বিমত করলেন চিকিৎসক হযরত আলী। সল্টলেক এলাকার বাসিন্দা হযরত আলী বলেন, “আমার মনে হয় কঠিন লড়াই হবে”। তিনি বলেন, “একজনের কারিশমা দিয়ে একটা গোটা রাজ্য চলে না, মমতাকে বাদ দিলে তৃণমূলে দল চালানোর মতই কেউ নাই”।

ভারতের সাথে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সীমান্ত এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাথেই। একসময় অবিভক্ত বাংলায় একই দেশ থাকায় দুই অঞ্চলের মানুষে মানুষে রয়েছে আত্মীয়তার সম্পর্ক। ভাষা, সংস্কৃতির মিল তো আছেই। তবে এত মিল থাকার পরও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বৈরিতাও প্রচণ্ড। বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণেই তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার পরে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ভারতের কেন্দ্রীয় দুই সরকার (কংগ্রেস ও বিজেপি) তিস্তা চুক্তি করতে রাজী হলেও মমতা রাজী না হওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষকে পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। মমতা যদি আবার ক্ষমতায় টিকে যান তবে আসছে পাঁচ বছরে এই চুক্তি হবার কোন সম্ভবনা অন্তত নেই বললেই চলে।


আপনার মন্তব্য

আলোচিত