সিলেটটুডে ডেস্ক

২২ মার্চ, ২০১৭ ০২:১৬

শ্রীজাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ: যা বললেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও জয় গোস্বামী

পশ্চিমবঙ্গের কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কবিতাকে কেন্দ্র করে ভারতের শিলিগুড়িতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা দায়ের পর কবি শ্রীজাতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও জয় গোস্বামী।

পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় শীর্ষেন্দু লিখেছেন, কবিতার ঘায়ে ধর্ম মূর্ছা যাবে! আর জয় গোস্বামী লিখেন, যিনি কুৎসিত উক্তি করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ হোক।

গত ১৯ মার্চ সন্ধ্যায় ফেসবুকে ‘অভিশাপ’ নামে একটি কবিতা পোস্ট করেন শ্রীজাত। কবি শ্রীজাতের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মাবেগে আঘাত করার অভিযোগ তুলে শিলিগুড়ির সাইবার ক্রাইম পুলিশ স্টেশনে সোমবার রাতে অভিযোগ দায়ের করেন অর্ণব নামের ‘হিন্দু সংহতি’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য।

যে কবিতা নিয়ে বিতর্ক, সেটি মূলত উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোটের ফল এবং তার পর যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রীর তখতে বসা প্রসঙ্গে লেখা। অর্ণব শ্রীজাতকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। কবিতাটির শেষ দুটি লাইন নিয়েই তার মূল আপত্তি। সেখানে শ্রীজাত লিখেছেন, ‘আমাকে ধর্ষণ করবে যদ্দিন কবর থেকে তুলে/ কন্ডোম পরানো থাকবে তোমার ওই ধর্মের ত্রিশূলে’।

আনন্দবাজার পত্রিকায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেন,

খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। তার কারণ, কবি-সাহিত্যিকদের বাক-স্বাধীনতা দিতে হবে। প্রতিটি মানুষের বাক-স্বাধীনতা দিতে হবে। কবিতাটি ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দিয়েছে বলে এফআইআর হয়েছে শুনেছি। কিন্তু ধর্ম তো ভাবাবেগের বিষয় নয়! এটা চর্চা থেকে আসে। এর জন্য পরমতসহিষ্ণুতার প্রয়োজন। ধৈর্যের দরকার। আমি এর কিছুটা চর্চা করি বলে বুঝতে পারি। ধর্ম এমন নয় যে কবিতার ঘায়ে মূর্ছা যাবে!

যাঁরা ধর্ম করেন, রাজনীতি করেন, তাঁদের ধৈর্য ধরতে হবে। যদি কবিতার প্রতিবাদ করতেই হয় তা হলে তাঁরা কবিতা বা প্রবন্ধ লিখে তার প্রতিবাদ করুন। এতে পুলিশ বা আদালত কী করবে? এটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না।

একই পত্রিকায় জয় গোস্বামী লিখেছেন,

শ্রীজাতর ‘অভিশাপ’ কবিতাটি আমার খুব ভাল লাগল। শ্রীজাত শুধু যে আমারই প্রিয় কবি তা নয়, তিনি অনেকেরই প্রিয় কবি। শ্রীজাতর কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য হল যে তিনি খুব স্পষ্ট করে তাঁর মনের কথা কবিতায় বলেন। সাহিত্যের মূল লক্ষ্য হল লেখায় মনের কথা বলা। কবিতায় মনের কথা বলেছেন বলে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যদি তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করে, তা হলে আমি তার তীব্র প্রতিবাদ করছি।

আমার মনে হয় না এই কবিতায় ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা হয়েছে। বরং এই কবিতায় একটি কুৎসিত উক্তির বিরোধিতা করা হয়েছে। আমিও এই ধরনের কুৎসিত উক্তির বিরোধী। যে উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে এই কবিতা, সেই কবিতার বিরোধিতা করার আগে তো যিনি এই ধরনের উক্তি করেছেন তাঁর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ জানাতে হবে। যিনি আগে এই ধরনের উক্তি করেছেন তিনি আসলে তাঁর নিজের ধর্মকেই কলুষিত করেছেন।

শ্রীজাত সমাজসচেতন কবি। তাঁর ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’-এ এই প্রমাণ আছে। বিশেষ একটি ধর্মের দ্বারা সমাজ তৈরি হয় না, সমাজের একটি নিজস্ব ধর্ম আছে। অনেক ধর্মের মানুষ মিলে এই সমাজ। তাই সকলকে সম্মান করতে হবে। আমি বুঝতে পারছি না যে এই কবিতার বিরুদ্ধে আক্রমণ হচ্ছে কেন! এই উক্তির বিরুদ্ধেই তো আক্রমণ হওয়া উচিত!

এদিকে, আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রীজাত তাঁর কবিতা ও জনৈক অর্ণবের প্রতিক্রিয়ার পর সে সম্পর্কে লিখেছেন,

‘অভিশাপ’ কেবল আমার একার নয়। আমার মনে হয় যে একটা গণতান্ত্রিক দেশে বাক-স্বাধীনতার যে স্বাভাবিক আবহ থাকার কথা তার উপরেই নেমে আসছে অভিশাপ। ব্যক্তিগতভাবে ঘটনাটিকে বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও সামাজিক গুরুত্বকে এড়িয়ে যেতে পারছি না। আমার মনে হয় ঘটনাটি আগামী দিনে ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের দিকেই নির্দেশ করছে।

আমি আমার মতো করে আমার কথা কবিতায় বলতে ভালবাসি। কারও কোনও ব্যবহার বা উক্তি বিরোধযোগ্য মনে হলে কবিতাতেই তার বিরোধ করি। কোনও ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানা আমার অভিপ্রায় নয়। তবে মৌলবাদকে বার বার আঘাত করতে হবে বইকি।

পৃথিবীতে মৌলবাদীরা চিরকালই এই ধরনের কাজ করে এসেছেন আর শিল্পীরাও তাঁদের কাজ করে গেছেন। আমার কাজ লেখা। লেখার মাধ্যমেই আমি আমার কাজ চালিয়ে যেতে চাই। মৌলবাদী হুমকি বা ফতোয়ায় থেমে যাওয়ার কোনও কারণ দেখছি না।

অনেকেই জানতে চাইছেন যে আমি কি শুধু হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধেই কলম ধরলাম? তা  হলে তাঁরা আমার সাম্প্রতিক লেখা অনুসরণ করেননি। করলে বুঝতেন, একই ভাবে ইসলামীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে কবিতাই হয়ে উঠেছিল আমার অস্ত্র। লিখেছিলাম ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’।

বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার খুনের প্রতিবাদই ফুটে উঠেছিল ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’-এ।

আসলে মুক্তমনাদের অবাধ বিচরণই প্রকৃত গণতন্ত্রের পরিচায়ক। আমি চিরকাল এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী। ব্লগার হত্যা হয়তো ছিল সীমান্তের ও পারের ঘটনা। কিন্তু তা আঘাত করেছিল এ পারেরও অসংখ্য মানুষকে।

আমার মনে হয় যে আমার দেশেও বোধহয় সেই রকমই পরিস্থিতি ঘনিয়ে আসছে!

আপনার মন্তব্য

আলোচিত