দেবাশীষ দেবু

১৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ১৫:৩০

মুক্তিযুদ্ধের চিঠি, মুক্তিযোদ্ধার চিঠি

রিতা,
তুমি বোধহয় ভালই আছ। আর থাকবে নাই বা কেন। তুমি এখন এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের নাগরিক হয়েছ। আমাদের দুঃখ-দুর্দশা হয়ত তোমার অজানা নেই। আমাদের অবস্থা যে কতদূর চরম তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।

একদিন আমাদের বাড়িতে একদল লোক এসে আমাদের কিছু জিনিসপত্র সমেত আমাকে একটি জিপে তুলে নিয়ে যায়। কোথায় যাচ্ছি তাও জানি না। কেবল শুনতে পাচ্ছি আমাদের পেছনেও কয়েকটি গাড়ি -আসছে। পথে গাড়ির মধ্যেই অমানসিক অত্যাচার শুরু হল। শিবিরে জীপ পৌঁছাল এবং আমায় শিবিরে ঠেলে নামিয়ে দেওয়া হল। সেখানে দেখলাম আমার মতই আরও কয়েকজন মেয়ে রয়েছে।

কিছুক্ষণ পর একদল ‘পশু’ শিবিরে এসে আমাদের উপর অত্যাচার শুরু করে দিল। দিনের পর দিন সন্ধ্যায় আমাদের নিয়ে যওয়া হয় এবং ভোর ৪টার সময় ছেড়ে দিয়ে যাওয়া হয়। কোন রকম বাঁধা দিলে যে অত্যাচার শুরু হতো তা অবর্ণনীয়। রবারের চাবুক দিয়ে তারা আমাদের নির্দয় ভাবে পেটায়। এই আতঙ্কে আমরা চরম অসম্মানজনক জীবনযাপন করতে বাধ্য হই।

আমার ভাইবোনদের আমি কোন খবরই জানি না। আমাদের চিঠি লেখার অধিকারও নেই। খাদ্য পাওয়াও কষ্টকর। রেডক্রস যদি কোন খাবার দেয় তাহলে ঐসব ‘পশুরা’ এসে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। দিনে একবার মাত্র আমাদের খাবার দেওয়া হয়। খাবার হলো দেড় পিচ রুটি আর একগ্লাস পানি। দিনে মাত্র তিনগ্লাস পানি দেওয়া হয়।

এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেক মেয়েই আত্মহত্যা করেছে। তাদের কবর অবধি দেওয়া হয় না। এসিড দিয়ে দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যারা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে তারা সাধারনতঃ সন্তান জন্মাবার আগেই মারা যায়। কয়েকজন আবার সন্তানের জন্ম দিয়েই মারা যায়। আমিও অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু আমরা কি করতে পারি? বাঙালী মেয়ে জন্মানই পাপ। এই অত্যাচার সহ্য করে আমিও এখনও বেঁচে আছি। তবে আধমরা হয়ে আছি। মুজিব ভাই কি আমাদের রক্ষা করবে না? আমাদের এই চরম দুঃখ- দুর্দশার কথা বঙ্গবন্ধুর কানে তুলো।
-শীলা

পাক হানাদারের বন্দী শিবির থেকে লেখা এক নির্যাতিতা বাঙালির চিঠি এটি। শীলা নামের এক বীরাঙ্গনার তার বান্ধবী রিতার কাছে লেখা এই চিঠিতে উঠে এসেছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য এই দেশের নারীদের ত্যাগের মহিমান্বিত রুপ আর পাক হায়েনাদের নির্যাতনের চিত্র। দেশ তখন মুক্ত। তবু মুক্তি মিলে নি শীলাদের। নিজের মুক্তির জন্য এই নারীও তাই পথ চেয়ে আছেন সেই মহানায়কের, যাঁর তর্জনীতে লুকিয়ে ছিলো আমাদের স্বাধীনতা।

১৯৭২ সালের ২১ জুন সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত, গোলাম রব্বানী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বিন্দু বিন্দু রক্তে’ প্রকাশিত হয় এ চিঠিটি। কেবল নাম ব্যতীত চিঠিটির প্রেরক ও প্রাপকের আর কোন পরিচয় উল্লেখ করা হয় নি।
প্রায় সমসাময়িক সময়ে সিলেট থেকে প্রকাশিত, আমীনুর রশীদ চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘যুগভেরী’তে প্রকাশিত হয় স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও পাক বন্দীশিবিরে আটক থাকা জনৈক ব্যক্তির আরেকটি চিঠি। চিঠিটি লেখা হয়েছিলো ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ। যুগভেরীতে এই পত্র লেখকের নামও ছাপানো হয় নি।

পিতার কাছে লেখা পত্রের শেষাংশে পত্র লেখক লিখেছেন, ... ‘নিচে কয়েকটি কথা লিখিতেছি। আর যাহা লিখিতেছি তাহা বর্ণে বর্ণে সত্য। তাহা হইতেছে, আমি এখন আছি এই রকম। ধোপাদিঘীর পশ্চিমপাড়ে যাহা আছে এবং সেখানে যারা থাকে, যে হালে থাকে ঠিক সেভাবেই আছি। আর কাজ হচ্ছে, ওখানে তারা যে কাজ করে সেই কাজ। অনেকে আছি। এখানে যাদেরকে রাখা হয়েছে তাদের নামের পাশে লালকালি দিয়ে অনেককিছু লেখা হচ্ছে। সবকিছু খুলিয়া লেখা সম্ভব নয়। কারন তো বুঝতেই পারছেন। এখানে ১২০০ এর বেশী বিমান বাহিনীর লোক।’

উল্লেখ্য, পত্রে উল্লেখিত ধোপাদিঘির পশ্চিমপাড় বলতে পত্রলেখক জেলহাজতের কথা বুঝিয়েছেন। এই স্থানে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার অবস্থিত। এবং নিজের অবস্থা হাজতিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

এতো গেলো বন্দি শিবির থেকে লেখা নির্যাতিতদের চিঠি। যুদ্ধের ময়দান থেকেও আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র পাশে সরিয়ে কখনো কখনো হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। প্রিয়জন আর সহযোদ্ধাদের কাছে নিজের, যুদ্ধের আর দেশের অবস্থা জানিয়ে লিখেছিলেন চিঠি। সেইসব চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবর্ণনীয় দূর্ভোগ, সর্বগ্রাসী অভাব, দালালদের দৌরাত্ম সত্ত্বেও বীর যোদ্ধাদের সাফাল্য গাঁথা ও চুড়ান্ত জয়ের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। কোন কোন চিঠিতে আবার মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের পরিবারের প্রতি মমত্ববোধ, প্রিয়জনদের জন্য দুশ্চিন্তা আর পরিবরারের জন্য সাত্ত্বানার বাণী গাঁথা রয়েছে। এইসব টুকরো টুকরো আশা, হতাশা, সান্তনা, প্রতীজ্ঞাই হয়ে ওঠেছে এখন মুক্তিযুদ্ধের দলিল।

মুক্তিযুদ্ধে সিলেট অঞ্চলের এক অনন্য যোদ্ধার নাম সুলেমান হোসেন। ৪নং সেক্টরের হয়ে যুদ্ধ করেছেন তিনি। ’৭১ এর ১০ ডিসেম্বর সিলেট শহরের ধুবড়ী হাওড়ের (অধুনা উপশহর) কাছে প্যারাসুট দিয়ে হেলিকাপ্টার থেকে নামার পরই পাকসেনারা তাকে ঘিরে ফেললে দীর্ঘক্ষণ ধরে চলা সম্মুখ যুদ্ধ শেষে তিনি আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। চুড়ান্ত বিজয়ের ঠিক পূর্ব মূহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর পাকসেনারা তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। কারো কারো বর্ণনায়, ১৪ ডিসেম্বর তিনি সিলেট-তামাবিল সড়কে পাক সেনাদের বহনকারী গাড়ি আক্রমণ করলে তাৎক্ষনিক যুদ্ধে শহীদ হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিলেটস্থ জিন্নাহ হলের নাম পাল্টিয়ে শহীদ সুলেমান হল নমকরণ করা হয়। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে পরিবার পরিজনদের কাছে বেশকিছু চিঠি লিখেছেন সুলেমান। চিঠিগুলোর বেশিরভাগই তাঁর প্রবাসী বড় ভাইয়ের কাছে অর্থ সাহায্য চেয়ে লেখা।

উল্লেখ্য, সুলেমান হোসেনের এই বড় ভাই মকবুল হোসেন মুক্তিযুদ্ধে বিপুল পরিমান আর্থিক সাহায্য করেন। এছাড়া শহীদ সুলেমানের আরেক অনুজ লোকমান হোসেন সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেন ও যুদ্ধে আহত হন।
একাত্তরের ১৬ এপ্রিল আসাম থেকে বড় ভাইকে লেখা সুলেমানের চিঠিতে ফুটে ওঠেছে তাদের আর্থিক দৈনতা ও দূর্ভোগের চিত্র।

চিঠির একাংশে সুলেমান লিখেছেন,- ‘... বর্তমানে আমাদের মৃত্যুর দুইটি পথ খোলা আছে। একটি হইল বুলেট, অন্যটি হইল পেট। যতক্ষন আমরা দুনিয়ার বুকে শ্বাস ছাড়িব ততক্ষন আমাদের বাঁচিয়া থাকিতে হইবে। আমরা বাড়ির অবস্থা দেখিয়া সহ্য করিতে না পারিয়া সীমান্ত পার হইয়া প্রায় ৭০ মাইল হাঁটিয়া বর্তমান ঠিকানায় আসিয়াছি।

সুতরাং আমাদের জীবন সংগ্রামে আপনাদেরকেও অংশগ্রহণ করতে হবে। বাড়িতে কোনদিন তিনচার অক্তে একবার ভাত খাওয়া সম্ভব হইতেছে না। কারন টাকা আমাদের বাজারে নেই। নিজে বিক্রি করিবার কথা বলিলেও দু’খানা পয়সা পাওয়া যায় না।’

২৮ নভেম্বর তারিখে একই ব্যক্তিকে লেখা আরেকটি পত্রে সুলেমান লিখেছেন, ‘...আমার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। কারন টাকা পয়সা আমার কাছে ঔষধের মতই হয়েছে। আপনার সাথে দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ হারানোর জন্যই আমার আজ এই অবস্থা। শীতের দাপটে রাতে ডিফেন্সে থাকা যায় না। কারন শীতের একটি কাপড়ও আমার নেই।...'

এইসব নানা প্রতিকুলতা সত্ত্বেও সুলেমান দেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে ছিলেন দৃঢ় প্রতৃজ্ঞ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীন। ৭ জুলাই তারিখে প্রবাসী বড় ভাইকে লেখা এক চিঠিতে ভেসে ওঠেছে সেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞারই চিত্র। সুলেমান লিখেছেন,-
‘ ... বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোন শক্তিই দমিয়ে রাখতে পারবে না। আমাদের বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ পরাধীনতার নাগপাশকে পদদলিত করিতে বদ্ধ পরিকর। এতে যদি আমার বাংলাদেশ শ্মশানে পরিনত হয় তবু আমরা কিছু ছাড়ব না। বাংলা স্বাধীন ও শত্রু মুক্ত হবে সত্য, তবে কবে এবং কি অবস্থায় স্বাধীন হব সেটা বলা যায় না। ...আমাদের প্রবাসী বন্ধুগণ যদি আমাদের সঙ্গে থাকেন তাহলে ইয়াহিয়ার বাবার ক্ষমতা নেই যে আর বাংলাদেশে শাসন চালাবে। পাঞ্জাবি বেনিয়ারা এবার বুঝে নিয়েছে যে তাহারা আর এখানে থাকতে পারবে না। আমরা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়া মা-বোন ও মাতৃভূমির পবিত্রতা রক্ষা করিব।

...আমার সকল পণ প্রতিজ্ঞাকে কেউ নস্যাৎ করতে পারবে না। দালালদের খতম করার জন্য আমাদের গেরিলা বাহিনী শহরে প্রবেশ করেছে। দুইতিন সপ্তাহের মধ্যে দালালদের বংশ থাকিবে না। এরাই আমারে বড় শত্রু। যাক জয় আমাদের হবেই। আমাদের জন্য চিন্তা করিবেন না বাঁচিয়া থাকিলে দেখা হইবে।...’

তারিখবিহীন আরেকটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন,- ‘...বাংলা স্বাধীন হবেই হবে। আমরা ইতিহাসে দেখিয়াছি সংগ্রামীর কোনদিন পরাজয় হয়নি, হবেও না। যদি দুনিয়ার কোন দেশ আমাদের সাহায্য না দেয় তবু পাঞ্জাবির বুটের নিচে মাথা রাখিব না।...’

তারিখ ও ঠিকানা উল্লেখ না করে মায়ের কাছে লেখা একটি চিঠিতে সুলেমান লিখেছেন,- ‘...মা আজকে আপনার সবচেয়ে বড় গৌরব যে, আপনার ছেলে সত্যিকারের দেশসেবার উপায় পেয়েছে। সত্যিকারের দেশসেবা করে যদি প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় সেটা ভাল। যাক আমার জন্য চিন্তা করিবেন না অদূর ভবিষ্যতেই দেখা হবে।। আমাদের চুড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের আর বেশি বাকী নয়।...’

চুড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের আর বেশি বাকী নয় তা ঠিকই আঁচ করতে পারলেও হায়েনাদের হাতে নিজের মৃত্যটা আঁচ করতে পারেন নি সুলেমান। তাই মাকে অদূর ভবিষ্যতেই দেখা হওয়ার আশ্বাস দিলেও আর কখনোই মায়ের সাথে দেখা হয়নি তাঁর।

মুক্তিযুদ্ধে সাচনা বাজারে পাক বাংকার ধ্বংসের সময় শহীদ হন সিরাজুল ইসলাম। এর আগে সুনামগঞ্জে সুরমা নদীতে পাকসেনাদের পরিবহন বহরে গেরিলা আক্রমন চালান তিনি। কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে পড়াকালীন সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন সিরাজুল। একসময় এই কলেজের ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই সুনামগঞ্জস্থ টেকেরঘাট থেকে নিজের পিতাকে লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন নিজের ও দেশের অবস্থা আর অবস্থানের কথা। হুশিয়ারি উল্লেখ করেছেন দালালদের প্রতি।

সিরাজুল লিখেছেন,- ‘ ... দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমাদের জন্য ও দেশ স্বাধীন হইবার জন্য দোয়া করিবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি। কারণ দেশ স্বাধীন না হইলে আমাদের জীবনের কোন মূল্য থাকিবে না। তাই যুদ্ধকেই জীবনের পাথেয় হিসেবে নিলাম। মৃত্যুর মুখে আছি। যেকোন সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করিবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাঙলার বুকে পুত্র হারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন।

দেশবাসী, স্বাধীন বাংলা কয়েমের জন্য দোয়া কর, মীর জাফরী করিও না। কারন মুক্তি ফৌজ তোমাদের ক্ষমা করিবে না এবং বাঙলায় তোমাদের জায়গা দেবে না।

ছালাম, দেশবাসী সালাম।’

সিলেট অঞ্চলের কিংবদন্তি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাসের শহীদ হওয়ার ঘটনা আরো অধিক বিক্ষুব্দ করে তুলেছিলো এতদ্ঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের। জগৎজ্যোতির মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে তাঁর সহযোদ্ধা সানু মিয়া আরেক মুক্তিযোদ্ধা গৌরাঙ্গ দেশীকে একটি ছোট্ট চিঠি লেখেন। সংক্ষিপ্ত এই চিঠিতে প্রতিভাত হয়েছে জ্যোতির প্রাণের বদলা নেওয়ার দৃপ্ত শপথ।

দাদা,
এখানে এসে জ্যোতিকে পেয়েছিলাম। চারদিন হলো, সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। তাঁর কাজ সে শেষ করেছে, এবার আমাদের পালা। জ্যোতিকে ম্লান হতে দেবো না, রক্তের প্রতিশোধ আমরা রক্তেই নেব।
ইতি
সানু মিয়া

মন্মথকুমার দাস চৌধুরী ছিলেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের শিক্ষানুরাগী ও সমাজ হিতৈষী ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি শরনার্থীদের স্বদেশপ্রেমে উদ্ভূদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর সাথে বেশকিছু পত্রবিনিময় হয়েছে কমলগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক চেরাগ উদ্দিন আহমদের। যুদ্ধের সর্বশেষ খবরা খবর ছাড়াও এসব চিঠিতে মূলত আলোচ্য হয়েছে যুদ্ধের রাজনৈতিক বিষয়াদিগুলো। এমনই কিছু চিঠিতে চেরাগ আলী লিখেছেন স্থানীয় নেতৃত্বের সংকীর্ণ চিন্তা চেতনা ও ব্যক্তি স্বার্থে অন্ধ হয়ে ওঠার কথা।

৭ অক্টোবর তারিখে তিনি এক চিঠিতে লিখেছেন,- ‘... এখানেও আ’লীগ নেতৃবর্গের মধ্যে রেষারেষি ও দলাদলি চলিতেছে। কে কোন পদ পাইবেন ইহাই সকলের লক্ষ্য। মুক্তি সংগ্রামের সাফল্যের প্রতি কাহারো বড় একটা টান নাই। আমরা কোথায় চলিয়াছি এবং আমাদের ভবিষ্যত কি, খোদাই জানেন। ... একমাত্র ভরসা মুক্তি ফৌজ, ওরা যদি নিজ শক্তিতে, মৃত্যুবরণ করিয়া দেশ উদ্ধার করিতে পারে তবেই বাঙালির মুক্তি। ... দেশ উদ্ধারের জন্য বিশ্বাসঘাতক কিছু লোক ছাড়া বাঙালী মাত্রই মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে, ইহাই শুভলক্ষণ। এইবার যদি বাঙালী স্বাধীনতা অর্জন করিতে না পারে তবে কয়েক শতাব্দির জন্য বাঙালী দাস জাতীতে পরিনত হইবে।...’

আরেকটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘... এমএনএ প্রধানত খোয়াইতেই থাকেন। প্রায়ই আগরতলা যাতায়াত করেন। শুনেছি এখন নাকি তাঁহার পাঁচজন বডিগার্ড এবং বৈঠকখানায় মেঝেকার্পেট বিছানো। এখন তিনি ‘টু বিগ এ মেন’ সুতরাং আমাদের নাগালের বাইরে। ...আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আমাদের এমএনএ ও এমপিএগণ আমাদের এবং দেশের প্রতি খুব আনসিম্পেথেটিক।...’

এইরুপ নানা ঘাত প্রতিঘাত, ঘরের শত্রু, বাইরের শত্রুকে প্রতিহত করে আমাদের মুক্তিসেনারা সূর্যের লালটুকু ছিনিয়ে আনেন বাঙলার সবুজ জমিনে। আমাদের পতাকা হয়ে ওঠে টিয়ে পাখির মতো লাল আর সবুজ। যুদ্ধজয় ও বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার পর সিলেটের মহিলা মুক্তিফৌজ ঘটনের অন্যতম উদ্যেক্তা ও নারীনেত্রী প্রীতিরানী দাশ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অর্ঘ হিসেবে তাঁতের তৈরি একটি উপহার পাঠান। এই উপহার পেয়ে প্রীতিরানীকে চিঠি লেখেন মুজিব।
’৭২ এর ২১ নভেম্বর তারিখে চিঠিটি বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা।

শ্রদ্ধেয়া প্রীতিরানী দাস
আমার আদাব গ্রহণ করবেন। তাঁতশিল্পের নিদর্শন স্বরুপ আপনার দেয়া উপহারখানা জেনারেল ওসমানী সাহেবের মারফত পেয়ে খুবই খুশি হয়েছি। শিল্প জগতে তাঁতশিল্প এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বিশেষকরে বাংলাদেশের উন্নতমানের তাঁতশিল্প একটি গৌরবের বিষয়। দেশের ভাঙ্গা অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রশ্নে আপনাদের ভূমিকা কোন অংশে কম নয়। সেহেতু আমাদের তাঁতশিল্পের ক্রমবিকাশ এবং বিশ্বের হস্তশিল্পাঙ্গনে এর সুপ্রতিষ্টিত স্থান আমার একমাত্র কাম্য।

সরকার এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগীতা করে যাবে। দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে আপনাদের প্রচেষ্টাকে আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ইতি
শেখ মুজিব

এ চিঠি আমাদের মহান নেতার মহত্ত্বকেই ফুটিয়ে তুলে। আজকের দিনে যা অভাবনীয়।

চিঠিপত্রে মুক্তিযুদ্ধ
এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত যুদ্ধদিনের চিঠিগুলো দীপংকর মোহান্তের সৌজন্যে প্রাপ্ত। গবেষক দীপংকর মোহান্ত দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মুক্তিসংগ্রামের অনুল্লেখ্য ও অন্তরালে থাকা বিষয়াদিগুলো তুলে আনতে। তারই ধারাবাহিকতায় পুরো সিলেট বিভাগ ঘুরে, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের তথ্য তালাশ করে খুঁজে বের করেছেন এই দূর্লভ ও দূস্প্রপ্য চিঠিগুলো। যা মলাটবন্দী করেছেন ‘চিঠিপত্রে মুক্তিযুদ্ধ’ নামে। দীপংকর মোহান্তের সম্পাদনায় বইটি প্রকাশ করেছে সাহিত্য প্রকাশ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত