এস আলম সুমন, কুলাউড়া

০৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ১৮:১০

৪৫ বছর পর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন কুলাউড়ার মিনারা বেগম

নিজের মাথা গোজার ঠাই নেই, কখনো বোনের বাড়ি আবার কখনো মেয়েদের শশুর বাড়ি থাকি। দুই ছেলে থাকলেও তারা কোন খোঁজখবর রাখে না। মুক্তিযোদ্ধের সময় পাক বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি জানার পর আমার স্বামী আমাকে তালাক দেন। মেয়েদের বিয়ের পর এলাকার স্থানীয় কিছু লোকের ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপের কারণে অনেকটাই ভয় এবং লজ্জায় মাথা গোজার একমাত্র অবলম্বন বাড়িটি বিক্রি করে দিয়ে চলে যাই সিলেটে বড় মেয়ের বাড়িতে। বর্তমানে সেখানেই থাকি। প্লাস্টিক কারখানায় বোতল বাছাইয়ের কাজ করি। অনেকটাই যাযাবর এর মত জীবন যাপন চালিয়ে যাচ্ছি। জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে এখন মুক্তিযোদ্ধার অসামান্য স্বীকৃতি পেয়ে গ্লানি অনেকটাই কমেছে। ৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিতা সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীরাঙ্গনা মিনারা বেগমের সাথে আলাপকালে এভাবেই কান্না ভেজা কণ্ঠে জানালেন তাঁর দু:খগাথা জীবন কাহিনী।

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর  প্রকাশিত গেজেটে বীরাঙ্গনা মিনার বেগমকে নারী মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় (প্রজ্ঞাপন ১১২০,গেজেট নং ১৪১) নাম অন্তর্ভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারী করে।

মিনারা বেগম মৌলভীবাজারে কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের আন্দ্রোকোনা গ্রামে ১৯৫৩ সালের ৪ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত রহমত আলী ছিলেন মাওলানা। তাদের মা ছোটকালেই ৩ বোন ও এক ভাইকে রেখে মারা যান। বড় বোন নুরুন্নেছার বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী শরীফপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী নিশ্চিন্তপুর গ্রামে। পরবর্তীতে তাঁর বাবা রহমত আলী সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহর পার্শ্ববর্তী রাজার গলি এলাকায় ভাড়া বাসায় তাদেরকে নিয়ে থাকতেন। ওইখানে মসজিদে চাকুরী করতেন।

মিনারা বেগম জানান, দিন তারিখ মনে নেই তবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পরে একদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রাজারগলি এলাকার বিভিন্ন বাসায় অভিযান চালায়। এক পর্যায়ে আমাদের দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে পাক হানাদার সদস্যরা। আমার বড় বোন, আমি এবং ছোট বোন শুধুমাত্র এই তিনজন বাসায় ছিলাম। বাবা ও ভাই বাহিরে ছিলেন। এসময় ঘরে কোন পুরুষ না পেয়ে আমাদেরকে মারধর করে। পরে আমাকে তুলে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে। পরবর্তী সময়ে জানতে পারি তৎকালীন সিভিল সার্জনের বাসভবন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প ছিলো। সেখানে নিয়ে তাঁরা আমার উপর বর্বর নির্যাতন করতে থাকে।

নির্যাতন সইতে না পেরে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখতে পাই আমি হাসপাতালে ভর্তি। এ সময় পাশে বসা আমার বড় বোন ও তাঁর স্বামী আমাকে জানান পাকিস্তানী বাহিনী ওই ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে তারা আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী হানাদারের ভয়ে আমার বাবা ও ভাই পালিয়ে ছিলেন। এসময় বড় বোনের স্বামী আমাদের তিন বোনকে নিয়ে তাঁর বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। এরপর থেকে বড় বোনের বাড়িতে থাকতাম।

যুদ্ধের প্রায় দুই বছর পর মৌলভীবাজারের সরকারবাজারের আকবর আলীর সাথে আমার বিয়ে হয়। আমার ঘরে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তীতে আমার স্বামী ৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে আমাকে নির্যাতনের বিষয়টি জানতে পেরে আমাকে তালাক দিয়ে দেন এবং আরেকটি বিয়ে করেন। পরে আমি আমার সন্তানদের নিয়ে আমার বড় বোনের বাড়ি নিশ্চিন্তপুরে বসবাস করতে থাকি। ওই এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে দুই কাঠার একখানা জমি কিনে সেখানেই একটি ঘর বানিয়ে সেখানেই থাকি। দুই ছেলে বিয়ের পরে স্ত্রী সন্তানসহ মৌলভীবাজারে চলে যায়। শুধু মাত্র দুই মেয়েকে নিয়ে অর্থাহারে অনাহারে দিন কাটে।

এ সময় স্থানীয় কিছু লোক আমাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ ও বিদ্রূপ করত। বড় মেয়েকে সিলেটে এবং ছোট মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর অনেকটাই ভয়ে সেই বাড়ি বিক্রি করে দেই। এরপর থেকেই কিছুদিন বোনের বাড়ি ও কিছুদিন মেয়েদের বাড়ি এভাবেই থাকি। বর্তমানে সিলেটে বড় মেয়ের বাড়িতে থাকি। সেখানকার শিববাড়ি এলাকার একটি প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করি। প্রতি সপ্তাহে কাজ অনুযায়ী ৩০০-৫০০ টাকা মজুরী পাই। বছর দুয়েক আগে যখন জানতে পারি বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর হাতে নির্যাতিত নারীদের (বীরাঙ্গনা) মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি তালিকা সংগ্রহ করছে। তখন এ তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মৌলভীবাজার জেলার ডেপুটি কমান্ডার মাসুক মিয়ার সহযোগিতায় সংশ্লিষ্ট দফতর বরাবরে আবেদন করি।

আবেদনের প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব মো. মাহবুবুর রহমান ফারুকী ও মহিলা সংসদ সদস্য কেয়া চৌধুরী আমার ব্যাপারে খোঁজ নেন। এ বছরের ১ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আমিসহ দেশের ১৬ জন বীরাঙ্গনার নাম অন্তর্ভুক্তি করে একটি গেজেট প্রকাশিত হয়।

তিনি আরও জানান, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এই স্বীকৃতি পেয়েছি। জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে গ্লানি অনেকটাই কমে গেছে। এখন হয়ত মাথা গোজার একটা ঠাঁই হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত