১৫ নভেম্বর, ২০১৭ ১৭:১৮
একাত্তরে রাজাকারদের ধরে শাস্তি দেওয়ায় এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে অভিযুক্ত করে নাজেহাল করেছেন এক আওয়ামী লীগ নেতা। এই ঘটনা বইয়ে তুলে ধরায় লেখক আর ওই মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন তিনি।
হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিছবাহ উদ্দিন ভুইঁয়ার দায়ের করা এই মামলায় মঙ্গলবার জামিন পান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস মিয়া ও ‘দাস পার্টির খোঁজে’ বইয়ের লেখক হাসান মোরশেদ।
হাসান মোরশেদ জানান, একাত্তরে ভাটি অঞ্চলে যুদ্ধ করা জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বাধিন ‘দাস পার্টি’ নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি ২০১৫ সালের জুলাইয়ে হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জে যান। এসময় তার কথা হয় দাস পার্টির অন্যতম সদস্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হলিয়াস মিয়া, আজমিরীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিছবাহ উদ্দিন ভুইঁয়া ও তাঁর ভাই কাকাইলছেও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো.নুরুল হক ভুঁইয়ার।
মোরশেদ জানান, এসময় তাঁর সামনেই ইলিয়াস মিয়াকে একাত্তরের রাজাকারদের হত্যা করার জন্য নাজেহাল করেন মিসবাহ ও নুরুল হক।
ওই ঘটনার একটি ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, মিছবাহ মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াসকে অভিযোগের সুরে বলছেন- ‘এরা নিয়ে মেরে ফেলেছে, মারার কোন কথা ছিলো না। আমরা আটকিয়ে ছিলাম।’
এসময় ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলে, দাস পার্টির নিয়ম হলো, তারা এই মাটির উপর থাকবে না।’
তখন মিসবাহ উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, ‘তাহলে সব রাজাকারকে মারলে না কেনো?’
দাস পার্টিকে নিয়ে হাসান মোরশেদের বই ‘দাস পার্টির খোঁজে’ প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। বইতে এ ঘটনা তুলে ধরেন মোরশেদ।
গত ১৭ অক্টোবর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিছবাহ উদ্দিন ভুইঁয়া বাদী হয়ে আজমিরীগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতে মানহানি মামলা দায়ের করেন।
মানহানি মামলার এজাহারে মিছবাহ উদ্দিন ভুইঁয়া অভিযোগে করেন, মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস মিয়ার প্ররোচনায় ‘দাস পার্টির খোঁজে’ বইয়ের ৬০ পৃষ্টায় মিছবাহের ভাই কাকাইলছেও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো.নুরুল হক ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে মানহানিকর কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নুরুল হক আওয়ামীলীগের বিরোধী ছিলেন, এবং একজন সমর্থকের গলা থেকে নৌকার প্রতিক ছিঁড়ে ফেলেছেন বলে বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। যা মিথ্যা ও মানহানিকর।
বইয়ের ৭০ ও ৭১ পৃষ্টায় মিছবাহের পরিবারকে ‘পাকিস্তানের দালাল’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটিও মিথ্যে। এসব তথ্য উপস্থাপন করায় তার দুই কোটি টাকার মানহানি হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করেন মামলার বাদী মিছবাহ।
তবে আজমিরীগঞ্জ উপেজলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. তৈয়বুর রহমান খান বুধবার সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আওয়ামীলীগ নেতা মিসবাহ আমার সহপাঠি ছিলেন। তাঁর পরিবার মুক্তিযোদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলো। তাদের মালিকানাধিন একটি লঞ্চ একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা ব্যবহার করে। যুদ্ধের পর তাদের বাড়ি থেকে আমি উপজেলা শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক হোসেন আলী রাজাকে আটক করে হাইকমান্ডের হাতে তুলে দেই।
আর মিছবাহ উদ্দিন ভুইঁয়া সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমি ও আমার পরিবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলাম। আমার ভাই বানিয়াচয়ংয়ের বিথঙ্গল আখড়ায় পাকিস্তানিদের হত্যা করে এক হিন্দু নারীকে উদ্ধার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন বইয়ে এসব লেখাও রয়েছে। কিন্তু এলাকার বিরোধকে কেন্দ্র করে ইলিয়াস ও তৈয়বুর আমাদেও বিরুদ্ধে অপ্রপ্রচার চালাচ্ছে। সেই অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে হাসান মোরশেদ তাঁর বইয়ে আমাদের রাজাকার বলেছেন। তাই মানহানি মামলা করেছি।
তিনি বলেন, আমাদের তিনটি লঞ্চ ছিলো। একাত্তরে একটি লঞ্চ পাকিস্তানি সেনারা ভৈরব থেকে দখল কওে নেয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা তা উদ্ধার করে। আর শান্তি কমিটির সেক্রেটারিকে আমাদেও বাড়ি থেকে উদ্ধারের অভিযোগ সত্য নয়।
রাজাকারদের শাস্তি দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াসকে নাজেহাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের মত ছিলো সব রাজাকারকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া ও নিরস্ত্র কাউকে হত্যা না করা। কিন্তু সে(ইলিয়াস) তা মানেনি।
‘দাস পার্টির খোঁজে’ বইয়ের লেখক হাসান মোরশেদ জানান, আমি বইয়ের কাজে যখন সেখানে গিয়েছিলাম তখন তারা (মিছবাহ) বলছিলো যুদ্ধ শেষ হবার কয়েকদিন আগে ১১ জনের একদল সশস্ত্র রাজাকার এখানে ধরা পড়ে। দাসপার্টি এই রাজাকারদের হত্যা করে।
মিছবাহের দাবি মতে, এদেরকে নাকি হত্যা করার কথা ছিলো না। এই নিয়ে দাসপার্টির ইলিয়াস এর সাথে তার তর্ক হচ্ছিলো। তর্কেও এক পর্যায়ে ইলিয়াস শ্লোগান দিয়ে উঠে যান ‘‘পাকিস্থানের দালালেরা পাকিস্থানে ফিরে যাও’’। এ ঘটনাটি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, যুদ্ধকালীন সময়ে রাজাকারদের শাস্তি দেয়ার জন্য উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি একজন যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে অভিযুক্ত করছে। এটা হতে পারে না। এবং এই ঘটনার বিশ্লেষন বইয়ে প্রকাশের কারনে মানহানীর মামলা করেছেন মিছবাহ।
হাসান মোরশেদ বলেন, ‘১৯৭৩ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের ইনডেমনিটি দেয়া হয়েছে ১লা মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাধীনতার প্রয়োজনে সংঘটিত কোন হত্যাকান্ডের মামলা করা যাবে না। সেই অর্থে, এরকম কোন ঘটনার সমালোচনা ও পরোক্ষভাবে করা যায় না। একজন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে এই ঘটনার জেরে ধরে মামলা করাটাও নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।’
আওয়ামী লীগ নেতার দায়ের করা এ মামলায় মঙ্গলবার দুপুরে আজমিরীগঞ্জ আদালতের বিচারিক হাকিম রাজিব আহমদ তালুকদার লেখখ হাসান মোরশেদ ও মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস মিয়াকে জামিন দেন।
ভিডিও : রাজাকারকে শাস্তি দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাকে নাজেহাল
আপনার মন্তব্য