ডা. এনামুল হক এনাম

১০ মে, ২০১৬ ০২:২৯

অশ্লীল যৌন বিজ্ঞাপন, চিকিৎসাশাস্ত্র কি বলে

“অমুক ঔষধালয়ের মহামূল্যবান আবিষ্কার, স্বপ্নে পাওয়া, হারবাল টনিক রোগ মুক্তি না হলে টাকা ফেরত, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, লন্ডন আমেরিকা আর নয়, রোগ মুক্তির শতভাগ গ্যারান্টি, তিন ঘণ্টায় উপকার, ১৪ থেকে ২১ দিনে আরোগ্য লাভ, হরিণের        ও কস্তূরী দিয়ে তৈরি ঔষধপত্র।”

যৌন মিলনে অক্ষমতা?
ধাতু পাতলা?
যৌন দুর্বলতা?
স্ত্রী মিলনে অনীহা?
হস্তমৈথুনের কারণে পুরুষাঙ্গ ছোট, বাঁকা ও নিস্তেজ?
উত্তেজনার অভাব?
অল্প উত্তেজনায় বীর্যপাত?
স্বপ্ন দোষ?
মহিলাদের গোপন স্থানে দুর্গন্ধ?
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া?
প্রস্রাবের রাস্তাদিয়ে পুঁজ পড়া?
মাথা ঘোরা?
বসা থেকে উঠলে চোখে আন্ধার দেখা?

রাস্তায় রিক্সা কিংবা বাসে এই ধরণের বিজ্ঞাপনের কাগজ হাতে পড়েনি এমন লোক কম পাওয়া যাবে। ছোট বড় সবাই প্রায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ি এইসব বিজ্ঞাপনের সামনে। কোনো রোগই নয় এমন ব্যাপারকে মানুষের মনে রোগ হিসেবে ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে দেদারসে ব্যবসা করে যাচ্ছে কিছু লোক।

এক বিবাহিত বন্ধু আমার কাছে এসে তার বিবাহিত জীবনে “যৌন অক্ষমতা”র কথা জানালো,
-দোস্ত, আমি ২-৩ মিনিটের বেশি পারি না।
-আমি জিজ্ঞেস করি কতক্ষণ থাকা দরকার?
-২০-৩০ মিনিট হলেই হবে, একটা ব্যবস্থা করে দে দোস্ত।
-আমি হেসে আবার জিজ্ঞেস করি তা কোথায় পেয়েছিস, যে পুরুষ মানুষ ২০-৩০মিনিট সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স (Sexual Intercourse) করে?
-সে অবাক হয়ে বলে, কেনো সিনেমায় যে দেখি।
-আমি হাসতে হাসতে আমার বন্ধুকে সিনেমার ব্যাপারটা বললাম, এগুলো যে আলাদা আলাদা শ্যুট করা সিন এক সাথে জুড়ে দিয়ে সিনেমা বানানো হয়েছে তা তার বিশ্বাস করতে যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে। সুস্থ যৌন জীবনে ২-৩ থেকে ৫মিনিট ইন্টারকোর্সে সময় যে অনেক তা তার বিশ্বাসই হয়না।

উপরে বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত পরবর্তী শব্দগুলোর কয়েকটি আমি মেডিকেল সায়েন্সে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করব:

ধাতু পাতলা: “ধাতু পাতলা” শব্দটা দিয়ে হয়তো সিমেন কনসেন্ট্রেশনের (Semen Concentration) কথা তা বুঝানো হয়েছে। যারা নিয়মিত যৌনমিলন কিংবা হস্তমৈথুন করেন তাদের সিমেন একটু পাতলা হওয়া স্বাভাবিক। এতে উদ্বেগের কিছু নেই। পুরুষদের ইনফারটেলিটি (Infertility) বা পুরুষত্ব এটার উপর নির্ভর করে না। শুক্রাণু গণনা বা স্পার্ম কাউন্ট (Sperm Count) দিয়ে পুরুষদের বাচ্চা জন্ম নেয়ার ভূমিকা কতটুকু তা নিরূপণ করা হয়।

যৌন দুর্বলতা: আমার মনে হয় এই শব্দ দিয়ে “যৌন অক্ষমতা” বুঝানো হয়েছে। কারো যদি ইরেকটাইল ডিসফাংশন (Erectile Dysfunction) থাকে তবে তার জন্য বাজারে উন্নতমানের ঔষধ পাওয়া যায়। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে এই অক্ষমতার কারণ কি, এবং সে অনুসারে তাকে চিকিৎসা দিতে হবে। এর জন্য অবশ্যই একজন যৌন রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

স্ত্রী মিলনে অনিহাঃ লাক অফ লিবিডো (Lack of Libido) মানসিক অশান্তি, পারিবারিক অশান্তি, যৌনসাথীর সাথে বুঝাপড়ার অভাব এই ধরনের কারণগুলোই সাধারণত যৌন মিলনে অনীহা সৃষ্টি করে। একজন সঙ্গীর সাথে দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে এই ধরণের অনীহা আসাটা অস্বাভাবিক নয়। নিয়মিত বিরতিতে যৌনমিলন, স্ত্রীর সাথে বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যাওয়া সহ সর্বোপরি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুললে এই ধরনের সমস্যা এড়ানো যায়। সমস্যা গুরুতর হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন।

অল্প উত্তেজনায় বীর্যপাত: (Premature Ejaculation) আমার কাছে মনে হয় ব্যাপারটা মানসিক। অল্প উত্তেজনায় বীর্যপাত হওয়ার কারণ অনেক হতে পারে। যারা সারাদিন যৌনতা নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগেন তাদের এমন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। লুকোচুরিতে যারা যৌনতা উপভোগ করছেন, তাদের এটা হওয়া স্বাভাবিক। মনে রাখবেন, যৌনমিলনে স্থান-কাল-পাত্র অনেক বড় ব্যাপার।

স্বপ্ন দোষ: এটা একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। রোগ তো অবশ্যই নয়। বালতি ভরে গেলে সেই পানি উপচে কিছুটা মাটিতে পড়বেই। আর হ্যাঁ, যারা সারাক্ষণ যৌনচিন্তায় ডুব দিয়ে আছে, তাদের এই সমস্যা বেশিই হওয়ার কথা। কিশোর-তরুণদের সপ্তাহে ১-২বার স্বপ্নদোষ হওয়া দোষের কিছু না, এই নিয়ে মনো কষ্টে না ভোগাই ভালো। কারণ এটা কোন রোগ না।

মহিলাদের গোপন স্থানে দুর্গন্ধ: সাধারণত ইউরিনারী ট্র্যাক ইনফেকশনে (Urinary Track Infection) এরকম হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে এন্টিবায়োটিক খেলেই তা ভালো হয়ে যায়। চিকিৎসক প্রয়োজনে প্রস্রাব পরীক্ষা করাবেন।

প্রস্রাবের রাস্তাদিয়ে পুঁজ পড়া: সাধারণত গনোরিয়াতে (Gonorrhoea) এমন হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে করার প্রয়োজন হয় এবং এন্টিবায়োটিক খেলে কয়েকদিনেই তা ভালো হয়ে যায়।

মাথা ঘোরা: (Vertigo) মাথাতো ঘুরতেই পারে, সারা পৃথিবীটাই যেখানে ঘুরছে। অধিকাংশ মাথাঘোরার রোগী আসে শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে, শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠলে আর মাথা ঘুরা থাকে না। তবে ঘন ঘন দীর্ঘদিন মাথা ঘুরা অবশ্যই দুশ্চিন্তার কারণ। অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (নিউরোলজি) এর পরামর্শ নিন। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে।

বসা থেকে উঠলে চোখে আন্ধার দেখা: সবারই হয়, আমারও হয়। এটা স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া।

আমার বিশ্বাস এই পেজের প্রত্যেকেই শিক্ষিত এবং এইসব ব্যাপারে সচেতন। আমি আপনাদের সবাইকে অনুরোধ করবো, যে কোন যৌন সমস্যায় একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং অন্যকেও নিতে বলুন।

“অমুক ঔষধালয়ের মহামূল্যবান আবিষ্কার, স্বপ্নে পাওয়া, হারবাল টনিক রোগ মুক্তি না হলে টাকা ফেরত, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, লন্ডন আমেরিকা আর নয়, রোগ মুক্তির শতভাগ গ্যারান্টি, তিন ঘণ্টায় উপকার, ১৪ থেকে ২১ দিনে আরোগ্য লাভ, হরিণের মৃগনাভী ও কস্তূরী দিয়ে তৈরি ঔষধপত্র।” এই ধরনের ফালতু বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হবেন না প্লিজ।

পোস্টের উপর আমি শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লিখে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার মনে হলো পোস্টটা কিশোর-কিশোরী, প্রাপ্তবয়স্ক সবার পড়া উচিত। তাই আমি সকলকেই অনুরোধ করব, নিজে সচেতন হোন এবং অন্য সকলকে  সচেতন হতে সহায়তা করুন।

ডা. এনামুল হক এনাম : প্রভাষক, সিলেট এমএজি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত