সিলেটটুডে ডেস্ক

১৬ ফেব্রুয়ারি , ২০২১ ২৩:৫৫

উগ্রবাদীদের শেকড়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অর্থ বিচার নয়

অভিজিৎ হত্যা মামলার রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বন্যা

বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন তার স্ত্রী বন্যা আহমেদ। একসঙ্গে উগ্রবাদীদের উত্থান এবং শেকড়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অর্থ অভিজিৎ হত্যার বিচার নয় বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

তিনি বলেছেন, ঘটনার একদম প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়ার পরেও তদন্তকারীরা তার বক্তব্য নেননি, এমনকি কোনো যোগাযোগও করেননি। হামলার আগে বইমেলার যে আড্ডায় অভিজিৎকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তার আয়োজকদের বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

মামলার প্রধান দুই অভিযুক্তকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতদিনেও কেন গ্রেপ্তার করতে পারেনি, সেই প্রশ্নও তুলেছেন বন্যা।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি ও রাজু ভাস্কর্যসংলগ্ন এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কম্পিউটার প্রকৌশলী অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। তার স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর জখম হন।

এ ঘটনার ছয় বছর পর মঙ্গলবার মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান।

রায়ে ফাঁসির দণ্ড পেয়েছেন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক, সংগঠনের সদস্য মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন (সাংগঠনিক নাম শাহরিয়ার), আবু সিদ্দিক সোহেল (সাংগঠনিক নাম সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব), আরাফাত রহমান (সাংগঠনিক নাম সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস) ও আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে হাসিবুল ওরফে আব্দুল্লাহ।

আরেক আসামি শফিউর রহমান ফারাবীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত ছয় জনের মধ্যে জিয়া ও আকরাম পলাতক।

রায়ের পর নিজের ফেসবুকে একটি বিবৃতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বন্যা আহমেদ। এতে তিনি বলেন, ‘আজকে আদালত রায় দিয়েছে। এতে বিচার্য ছিল বিজ্ঞান, দর্শন এবং ধর্ম নিয়ে লেখালেখি ও বই প্রকাশের কারণে আক্রমণকারীরা তাকে হত্যা করেছে কি না। এ রায় আমার বা আমার পরিবারের কাছে শেষ কথা নয়। আমি এটা কখনও আশা করিনি।’

বন্যা অভিযোগ করেন, ‘গত ছয় বছরে মামলার তদন্তে যুক্ত কোনো ব্যক্তি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। অথচ আমি একজন সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী এবং হামলার শিকার। গত জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্রকাশ্যে মিথ্যা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমি সাক্ষ্য দিতে রাজি হইনি। সত্যিটি হলো, বাংলাদেশ সরকারের কেউ বা প্রসিকিউশনের কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।’

মামলার অন্যতম এক আসামিকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়েছে দাবি করে বন্যা আহমেদ বলেন, ‘২০১৬ সালে মুকুল রানা শরীফকে বিচারবহির্ভূতভাবে (যা বাংলাদেশে ক্রসফায়ার নামে পরিচিত) হত্যা করে বাংলাদেশের পুলিশ। আমাদের ওপর হামলাকারী জঙ্গি সংগঠনের অন্যতম সদস্য ছিল সে। শরীফ মারা যাওয়ার আগে দীর্ঘ সময় পুলিশি হেফাজতে ছিল। তাকে কেন মারা হলো?’

বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগারদের হত্যায় কারা অর্থের জোগান দিয়েছে, সেই প্রশ্নও তোলেন বন্যা।

অভিজিৎ রায় নিহত হওয়ার কিছুক্ষণ আগে বাংলা একাডেমির বইমেলা প্রাঙ্গণে একটি আড্ডায় সস্ত্রীক যোগ দেন। ওই আড্ডার আয়োজক ছিলেন বুয়েটের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আড্ডাটি সন্ধ্যা ৬টার দিকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ফারসীম মান্নান দেরি করে আসায় সেটি শুরু হতে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার বেশি বেজে যায়। তবে আলোচনা শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে ঘটনাস্থল থেকে চলে যান কয়েক যুবক।

ওই আড্ডার আয়োজন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বন্যা আহমেদ। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আমি এবং অভি বিজ্ঞানমনস্ক লেখক আড্ডায় যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আমাদের কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষায় রেখেছিলেন আড্ডার আয়োজকেরা। শেষে সন্ধ্যায় তাদের সঙ্গে দেখা হলো। ওই আড্ডার পর আমরা হামলার শিকার হলাম, আর খুন হলো অভিজিৎ। ওই আড্ডার আয়োজকদের কি তদন্তে ডাকা হয়েছিল? যদি হয়, তবে কী তথ্য মিলেছে?’

বন্যা মনে করেন, ‘কিছুসংখ্যক লোকের সাজা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে উগ্রবাদীদের উত্থান এবং শেকড়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অর্থ অভিজিৎ হত্যার বিচার নয়। ঠিক সেভাবে ব্লগার, প্রকাশক, সমকামীদের হত্যার ক্ষেত্রেও তা ন্যায়বিচার হতে পারে না। তাই এ রায় আমার বা তাদের পরিবারে স্বস্তি আনতে পারবে না।’

বন্যা আহমেদের অভিযোগের বিষয়ে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষকে দোষ দিলে চলবে না। আমাদের কাছে তাদের একটি টিঅ্যান্ডটি ফোন নম্বর ছিল, যেখানে ফোন করে বন্ধ পেয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘অভিজিতের ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, সে পরে আমেরিকার ঠিকানা দিতে চেয়েও দেয় নাই। বন্যার মামার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ওনাকে বলেছি, তাতেও কোনো লাভ হয় নাই।

‘বন্যার সঙ্গে একাত্তর টেলিভিশনের টকশোতে যোগাযোগ হয়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে, সাক্ষ্য দিতে আসেন। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমাদের সঙ্গে আমেরিকাতে যোগাযোগ করে সাক্ষ্য দেয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তার সেই কথা আমরা কীভাবে নিতে পারি?’

গোলাম ছারোয়ার খান বলেন, ‘আমরা নিয়মের বাইরে গিয়েও অনেক চেষ্টা করেছি। তাদেরও দায়িত্ব ছিল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাষ্ট্রপক্ষকে সাহায্য করা, কিন্তু সেটা তারা করেন নাই। আজ রায়ের তারিখে পরিবারের কোনো একজন সদস্য বা আত্মীয়স্বজন কেউ আদালতে আসেননি। আমরাও বিষয়টি নিয়ে অবাক হয়েছি।’

অন্যদিকে, বুয়েট শিক্ষক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীকে একধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত