সিলেটটুডে ডেস্ক

২৪ এপ্রিল, ২০২১ ২১:৫১

রানাপ্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে করোনা

প্রাণে বেঁচে গেলেও রানা প্লাজার ধ্বসের ঘটনায় আহত অনেক শ্রমিকই আগের চেয়েও দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। এখনও ১৪ শতাংশ শ্রমিকের স্বাস্থ্য অবনতির দিকে রয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৮.৫ শতাংশ শ্রমিকের স্বাস্থ্য মোটামুটি স্থিতিশীল এবং ২৭.৫ শতাংশ সম্পূর্ণ স্থিতিশীল রয়েছে। ১৪ শতাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বেশিরভাগই মাথাব্যথা, হাত ও পায়ে ব্যথা, কোমর ব্যথা এমন বড় সমস্যা নিয়ে জীবন যাপন করছেন বলে একশনেএইডের জরীপে উঠে এসেছে।

অন্যদিকে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে দেখা যায়, ১২.৫ শতাংশ এখনও মানসিক ট্রমার মধ্যে রয়েছেন যা গত বছরে ছিল ১০.৫ শতাংশ। অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে গত বছরের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি শ্রমিকের। তবে বর্তমানে ৬২ শতাংশ শ্রমিকের মানসিক স্বাস্থ্য মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। এ বছর ২৫.৫ শতাংশ শ্রমিকের মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে ভালো অবস্থানে আছেন যা গত বছর ছিলো ২১ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ৪.৫ শতাংশ বেশি শ্রমিক মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে উন্নতি লাভ করতে পেরেছেন।

আজ ২৪ এপ্রিল।৮ বছর আগে এইদিনেই ধ্বসে পরে রানাপ্লাজা। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৮ম বার্ষিকীতে ‘কোভিভ-১৯: চ্যালেন্জেস ফর দ্যা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি সার্ভাইভর্স’ শীর্ষক প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) সকাল ১১টায় ভার্চুয়াল সংলাপে এ জরীপ ফলাফল উপস্থাপন করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশ। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত এক হাজার চার’শ জন শ্রমিকের ডাটাবেজ থেকে দুই’শ জনকে নমুনা হিসেবে নিয়ে এ জরিপ চালায় সংস্থাটি।

দুর্ঘটনার পর অনেকেই শারীরিক ও মানসিক কারণে কাজে ফিরে যেতে পারেননি। অনেকে কাজে ফিরলেও ঘুরাতে পারেনি ভাগ্যের চাকা। জীবন ধারণের তাগিদে অনেকে আবার বদলেছেন কাজের ধরন। তার উপর করোনা মহামারী তাদের জীবনে মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে।

বেশিরভাগ পরিবারেই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি একজন, তার উপর করোনার প্রভাবে হ্রাস পেয়েছে উপার্জন। তাদের আয়ের চিত্রের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এসব কাজ করে ১০.৫ শতাংশ শ্রমিক ৫ হাজার ৩০০ টাকার নিচে আয় করে। ৩৭.৫ শতাংশ শ্রমিক আয় করে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার ৩০০ টাকা। ২৯.৫ শতাংশ লোকের আয় ১০ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১৫ হাজার ৩০০ টাকার মধ্যে। উদ্বেগজনক হলেও সত্য ৯.৫ শতাংশ শ্রমিকের নেই কোন আয়। অথচ এসব পরিবারে খাদ্য, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, বাচ্চাদের পড়াশুনা ইত্যাদি জরুরী খাতে ১০ হাজার টাকার বেশি ব্যয় হয়।

অন্যদিকে ৬৭ শতাংশ মানুষ কারখানাগুলোতে সঠিক নিয়মনীতি ও কর্মঘণ্টা বজায় রাখার কথা স্বীকার করলেও ৩৩ শতাংশ বলছেন কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়েই কাজ করেন তারা। কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি তেমন মানা হচ্ছে না বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা।

এই ভার্চুয়াল সংলাপের উপস্থিত প্রধান অতিথি ও সংসদ সদস্য শিরিন আক্তার বলেন, ‘দেশে শ্রম আইনের বাস্তব প্রয়োগ হলে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা আদায় করা সম্ভব। তাছাড়া ক্ষতিপূরণ আইন স্বচ্ছভাবে তৈরি করা প্রয়োজন। কারখানায় সুন্দর কর্ম পরিবেশ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তৈরি করার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন, মালিকপক্ষ এবং সরকার পক্ষ একসাথে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ে দেশে পরিণত হতে গেলে অবশ্যই তাকে শ্রমিকদের অধিকার, মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা, ইনস্যুরেন্স, হেলথ কার্ডসহ আপদকালীন তহবিল গঠন করতে হবে যা রানা প্লাজা দুর্ঘটনার মতো যেকোনো বিপদ থেকে সাময়িক পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।’

পোশাক শ্রমিকদের জন্য সরকার থেকে করোনাকীলন প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, সেটি শ্রমিকদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে কি না তা মালিকদের পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়নকেও এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।

গবেষণার জরিপ সম্পর্কে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন,‘ ৮ বছরেও এত বিশাল সংখ্যক শ্রমিকদের এই অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। অথচ এ দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের অক্সিজেন বলা হয় শ্রমিকদের। ঔপনিবেশিক মন মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে এসে শ্রমিকের ন্যায্য দাবি পূরণ করতে হবে।’

শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের আহ্বায়ক হামিদা হোসেন বলেন, ‘আমারা প্রতিবছর রানা প্লাজা দুর্ঘটনার তারিখে শ্রমিকদের কবরস্থানে যাই। জায়গা দিন দিন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এখানে শ্রমিকদের স্মরণে বড় একটি মনুমেন্ট হওয়ার ছিলো তবে বাস্তবে তা হয়নি। প্রত্যেক বছর সিটি কর্পোরেশনের কাছে চিঠি দিয়েও রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিকদের কবর চিহ্নিত করার কাজটি আজও বাস্তবায়ন করানো যায়নি। তাছাড়া এতো বছরেও লিগ্যাল কমপেন্সেশন আসলো না যা এখনও হাই কোর্টে ঝুলে আছে। তিনি সেফটি কমিটি ও ইনস্যুরেন্স স্কিম কার্যকর করার মাধ্যমে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহবান জানান।’

ডায়লগে উপস্থিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পোটিয়াইনেন বলেন, ‘শ্রম ইস্যুতে নিরাপত্তা ও শাসন ব্যবস্থায় উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে আর এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এর সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে এবং এটি নিশ্চিতকরণে সরকারকে আইন প্রণয়ন করতে হবে।’ করোনাকালীন সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার, শিল্পকারখানা ও শ্রমিকদের সাথে নিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান তৈরির আহবান জানান তিনি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার আট বছরেও বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের জীবনে তেমন কোন ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। কর্মক্ষেত্রেও তাদের নিশ্চয়তা দেওয়া যায়নি। তাদের মধ্যে যারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত দেখা যায়।’ তাই তিনি তাদের চিকিৎসা নিশ্চিতকরণে থানা পর্যায়ে রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যকার্ড বিতরণ করা এবং আহতদের স্বাস্থ্যবীমা প্রণয়ের আহবান জানান তিনি।

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘আমাদের দেশে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ১ হাজারের মতো শ্রমিক বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ন্যাশনাল সোশাল সিকিউরিটি প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে হবে । জীবিকার জন্য মানুষের যেন জীবনহানি না হয়।’

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরও বাংলাদেশ এখনও একটি কার্যকর এমপ্লয়মেন্ট স্কিম তৈরি করতে পারেনি বলে হতাশা প্রকাশ করেন জিআইজেড এর টেক্সটাইল এবং লেদার এর ক্লাস্টার সমন্বয়কারী ওয়ের্নার ল্যাঞ্জ বলেন । তিনি শ্রমিকদের জন্য এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি ইনস্যুরেন্স (ইআইআই) চালু করার কথাও বলেন।

এ ভার্চুয়াল সংলাপে আরও যুক্ত ছিলেন এস অলিভারের সিনিয়র সাস্টেনেবিলিসটি কো-অর্ডিনেটর তাজুল ইসলাম, এসএ টিভির বিজনেস এডিটর সালাউদ্দিন বাবলুসহ আরও অনেকে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত