সাজু মারছিয়াং, শ্রীমঙ্গল

১৮ ফেব্রুয়ারি , ২০২৪ ১১:৪৪

প্রীতির মৃত্যু: দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামকে খোলা চিঠি

মৌলভীবাজারের চা-শ্রমিক সন্তান প্রীতি উরাং (১৫) গৃহে কাজের জন্যে রাজধানীতে গিয়েছিল দুই বছর আগে। সেখানে কাজ হয় তার দেশের অন্যতম প্রধান ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায়। দুই বছর সেখানে কাজ করার পর এই মাসের প্রথম সপ্তাহ সেই বাসার নয় তলা পড়ে যায় প্রীতি। মৃত্যু হয় তার।

প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলা হচ্ছে। পুলিশি তদন্ত চলছে। পুলিশ এরইমধ্যে ওই ফ্লাটের বাসিন্দা আশফাকুল হক ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে। আশফাকুলের প্রতিষ্ঠান দ্য ডেইলি স্টার এনিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

পত্রিকাটির বিবৃতি নিয়ে বক্তব্য দিয়েছে “নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ” নামের একটি সামাজিক সংগঠন। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামকে উদ্দেশ করে দেওয়া নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ-এর খোলা চিঠি হুবহু প্রকাশ করছে।

প্রতি
মাহফুজ আনাম
সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার

জনাব
নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।

আপনার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় প্রীতি উরাং নামে একজন শিশু গৃহকর্মী কাজে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় ৯ তলা ভবন থেকে পড়ে নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে মামলা দায়ের হয়েছে। এলাকাবাসীর ধারণা প্রীতি উরাং হত্যার শিকার এবং অভিযোগ আপনার সম্পাদিত পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে। বর্তমানে সৈয়দ আশফাকুল হক এবং তার স্ত্রী গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশী হেফাজতে রয়েছেন। প্রীতির মৃত্যুতে সমাজের নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এমতাবস্থায় দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক হিসেবে আপনি যে বিবৃতি প্রদান করেছেন, তা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

প্রিয় সম্পাদক
ঘটনার দশদিন পর হলেও এই বিবৃতি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমরা আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু বিবৃতিটি আমাদের হতাশ করেছে। এই বিষয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়া খোলা চিঠির মাধ্যমে তুলে ধরছি:

০১. আপনি গত ৬/৮/২০২৩ তারিখে আশফাকুল হকের বাসার অপর একজন শিশু গৃহকর্মীর একই ভাবে পড়ে গিয়ে আহত হওয়ার বিষয়টি বেমালুম চেপে গেছেন, যা আপনার মতো একজন বলিষ্ঠ সম্পাদকের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত। আমরা যার পর নেই হতাশ হয়েছি। আমরা মনে করি সত্য প্রকাশের বিপরীতে এই বক্তব্য দিয়ে আপনি এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছেন মাত্র;

০২. আপনি দুটি সুনির্দিষ্ট বিষয়—প্রথমটি, অভিযুক্ত ব্যক্তি দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক হওয়ার কারণে শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা হিসেবে আমরা কি তদন্ত প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করছি? এবং দ্বিতীয়টি, আমরা কি এ ঘটনায় সেভাবেই প্রতিবেদন প্রকাশ করছি, যেভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে করি? এভাবে চিহ্নিত করে প্রদত্ত বিবৃতিটি অভিযুক্তের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি একটি প্রভাবশালী পত্রিকার প্রভাব বিস্তারের দুরভিসন্ধি বটে। দ্বিতীয়বার একই ধরনের ঘটনার অবতারণা হলেও একই অভিযুক্ত আশফাকুল হককে দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদকের পদে বহাল রাখা’- প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা নয় কি? একটি নিরপেক্ষ ও নির্মোহ তদন্তের স্বার্থে আশফাকুল হককে নির্বাহী সম্পাদকের পদ থেকে অপসারণ করে বিবৃতি প্রকাশ করা হলে, সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বশীলতা প্রমাণিত হতো;

০৩. আপনি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় আছেন, উল্লেখ করেছেন। অথচ একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরপর একই ধরনের দুটি অভিযোগ উঠে এসেছে, যা আপনি অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন। অভিযোগটি বিচারাধীন থাকার পরও আপনি তা বিবৃতিতে উল্লেখ করেননি। এমনকি আপনার পত্রিকার পক্ষ থেকে অন্যান্য ঘটনার মতো এই ২টি ঘটনায় সরেজমিন অনুসন্ধান করে বিশ্লেষণধর্মী ও তুলনামূলক আলোচনার প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি, যা পত্রিকার পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ।

০৪. আপনার বক্তব্যে—“শিশুদের অধিকার সমুন্নত রাখতে দ্য ডেইলি স্টারের নীতিতে অটল রয়েছি” উল্লেখ করলেও কার্যত শিশু শ্রমিক নিয়োগ করার বিষয়ে কোনো প্রকার অবস্থান ব্যক্ত না করে বরং শিশু শ্রমের প্রতি মৌন সমর্থন দেওয়া হয়েছে;

০৫. আপনি পাঠকদের সতর্ক করে বলেছেন—“কিছু ক্ষেত্রে ঘটনাটি বিকৃত ও অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করা হচ্ছে”। কিন্তু কোন ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত মনে হলো তা প্রকাশ করেননি। প্রীতি উরাং কে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে কিংবা ৭ বছরের ফেরদৌসির পড়ে যাওয়া বা তার পরিবারের সাথে ২লাখ টাকায় আপোষ করা? কিংবা প্রীতিকে ধর্ষণ করা হয়েছে এগুলোকে অতিরঞ্জিত বলছেন? আমাদের জানার আগ্রহ—আপনি কি এই অভিযোগগুলো বিষয়ে কোনো প্রকার অনুসন্ধান করেছেন? অনুসন্ধান করেছেন কি কিভাবে ৭ বছরের ফেরদৌসির পড়ে যাওয়ার ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা তথ্যগত ভুল প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছে?

আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই—
আপনার প্রতিষ্ঠান কি শিশু শ্রমিক রাখার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে?
হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ এবং জেলখানায় বন্দি আসামিকে সাময়িক বরখাস্ত না করা কি গণমাধ্যমের নৈতিকতা ও মূল্যবোধগত বিষয়?
শিশু প্রীতি ও ফেরদৌসির সাথে কি ন্যায়বিচার হয়েছে?
কেন বারবার একই বাড়িতে এমন ঘটনা ঘটছে- বিষয়টি কি একটি দায়িত্বশীল গণমাধ্যম হিসেবে আপনি বিবেচনায় নিয়েছেন?
যখন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে তখন উপযুক্ত আইনি সহযোগিতা প্রদানের জন্য প্রীতির পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন?
দুটি অভিযোগ বিলম্বে রেকর্ড করা কিংবা তদন্ত প্রতিবেদনের আদলে অভিযোগকারীর টিপসহি অঙ্কিত অভিযোগের বর্ণনা বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেছেন?

আমরা বিশ্বাস করি, দ্য ডেইলি স্টারও একই প্রশ্নের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই সেগুলোকে আলোচনায় তুলতে চাইছে না।

প্রিয় সম্পাদক
দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, উন্নত জীবন পেতে শিশু প্রীতিদের গৃহকর্মীর কাজে ঢাকায় আসাকে আমরা সমর্থন করি না। শিশু গৃহকর্মী নিয়োগকে সমর্থন করে শিশুর সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা করা এক ধরনের উপহাস। এমনকি শিশু শ্রমের বিরোধিতা না করে সাংবাদিকতার মাধ্যমে শিশুর উন্নয়নে কাজ করার প্রতিশ্রুতিকে একটি সুশোভন বাক্যালাপে পরিণত করেছে মাত্র। আমরা আহবান জানাচ্ছি—অবিলম্বে দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক আশফাকুল হককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান এবং প্রীতি উরাং ও ফেরদৌসির বেগমের পরিবারকে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সহায়তা করুন।

আপনাকে ধন্যবাদ

খোলা চিঠি প্রেরক
নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আপনার মন্তব্য

আলোচিত