সিলেটটুডে ডেস্ক

২৯ মার্চ, ২০২৪ ১৪:৪১

কবর থেকে তোলা হবে ট্রান্সকমের পরিচালকের লাশ

ট্রান্সকম গ্রুপের পরিচালক আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের লাশ কবর থেকে তোলা হতে পারে। মামলার তদন্তভার পিবিআইর কাছে যাওয়ার পর এ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সংস্থাটির দায়িত্বশীলরা বলছেন, এধরনের তদন্তের ক্ষেত্রে কবর থেকে লাশ তোলার ঘটনা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ।

রাজধানীর গুলশান থানায় ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান, তার ছেলেসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ভাইকে হত্যার অভিযোগে শাযরেহ হকের করা মামলার তদন্তভার পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

মামলার তদন্তভার পিবিআই পাওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন গুলশান বিভাগের উপকমিশনার রিফাত হোসেন শামীম।

তিনি জানান, ১০ মাস আগে আরশাদের মৃত্যুর ঘটনায় গত ২১ মার্চ রাতে আরশাদের বড় বোন সিমিন ও তার ছেলে ট্রান্সকম গ্রুপের হেড অব ট্রান্সফরমেশন যারাইফ আয়াত হোসেনসহ ১১ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন আরশাদের আরেক বোন শাযরেহ হক।

জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৬ জুন রাজধানীর গুলশানের বাসায় নিজের শোয়ার ঘরে রহস্যজনক মৃত্যু হয় সিমিন রহমান ও শাযরেহ হকের একমাত্র ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের। অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আরশাদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগে এক সপ্তাহ আগে গুলশান থানায় মামলা করেন শাযরেহ। গুলশান থানা পুলিশ আরশাদের মৃতদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের অনুমতি পায়। মামলার তদন্তভার ২৭ মার্চ পিবিআইয়ে হস্তান্তর করা হয়। তদন্তের অংশ হিসেবে আরশাদের মৃতদেহ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছে পিবিআই। এজন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে আদালতে আবেদন করার প্রস্তুতি চলছে; চলতি সপ্তাহেই মৃতদেহ কবর থেকে তোলা হতে পারে বলে জানিয়েছেন পিবিআই ঢাকা উত্তরের তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

পিবিআই ঢাকা উত্তরের পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আদালতের নির্দেশে ভাইকে হত্যার অভিযোগে শাযরেহ হকের করা মামলার তদন্তভার পিবিআই পেয়েছে। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সব প্রক্রিয়াই গ্রহণ করবে পিবিআই। এ ধরনের মামলায় কবর থেকে মৃতদেহ উত্তোলন স্বাভাবিক তদন্তের অংশ। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মৃতদেহ উঠিয়ে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হবে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। এ মামলায় এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

শাযরেহ হক এর আগে সিমিন রহমান ও তার মা ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহনাজ রহমান (লতিফুর রহমানের স্ত্রী), বোন, ভাগ্নেসহ আটজনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, সম্পত্তি দখল ও অবৈধভাবে শেয়ার হস্তান্তরের অভিযোগ এনে আরও তিনটি মামলা করেন। গ্রুপের ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, সম্পত্তি দখল এবং অবৈধভাবে কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তর করার অভিযোগ এনে গত ২২ ফেব্রুয়ারি গুলশান থানায় এসব মামলা করা হয়। ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা লতিফুর রহমানের মৃত্যুর পর সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে এ তিন মামলার সূত্র ধরে পিবিআই এরই মধ্যে ট্রান্সকম গ্রুপের গুলশানের হেড অফিস থেকে বেশ কিছু নথি জব্দ করেছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার ট্রান্সকমের পাঁচ কর্মকর্তাকে প্রথমে জামিন দেওয়া হলেও পরে তা বাতিল করা হয়।

আরশাদ হত্যা মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অন্য ওয়ারিশ থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে কৌশলে বিষপ্রয়োগ/শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে সিমিন রহমানসহ অন্যদের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে।

এ মামলার আসামি হলেন ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান, তার ছেলে ও ট্রান্সকম গ্রুপের হেড অব ট্রান্সফরমেশন যারাইফ আয়াত হোসেন, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের ম্যানেজার (মেডিক্যাল অ্যাফেয়ার্স) ডা. মুরাদ, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস) ডা. মো. মুজাহিদুল ইসলাম, ট্রান্সকম লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স-আইন) মো. ফখরুজ্জামান ভুঁইয়া, ট্রান্সকম লিমিটেডের ট্রান্সকম গ্রুপ করপোরেট ফাইন্যান্সের পরিচালক মো. কামরুল হাসান, মো. জাহিদ হোসেন, ট্রান্সকম লিমিটেডের ম্যানেজার (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) সেলিনা সুলতানা, ট্রান্সকম লিমিটেডের ম্যানেজার (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) কেএইচ মো. শাহাদত হোসেন, বাবুর্চি রফিক ও ব্যক্তিগত গাড়িচালক মিরাজুল। এজাহারে ৭ নম্বর আসামি জাহিদ হোসেনের কোনো পরিচয় দেওয়া হয়নি।

মামলা এজাহারে বাদী শাযরেহ হক আরও উল্লেখ করেন, তার বাবা লতিফুর রহমানের মৃত্যুর পর আরশাদ ওয়ালিউর রহমান, সিমিন রহমান এবং তিনি নিজে তার বাবার সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মুসলিম শরিয়া আইন অনুযায়ী ওয়ারিশ। কিন্তু সিমিন রহমান এবং তার ছেলে যারাইফ আয়াত হোসেন বিভিন্ন জাল কাগজপত্র তৈরি করে স্থাবর সব সম্পত্তিসহ ট্রান্সকম গ্রুপের শেয়ার এবং পজিশন থেকে তাকে এবং তার ভাইকে বঞ্চিত করেন। এসব বিষয় জানার পর আরশাদের সঙ্গে কথা বলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২০২৩ সালের ৮ জুন আরশাদ আমমোক্তারনামা দেন শাযরেহকে। আরশাদ ডিভোর্সি ও নিঃসন্তান ছিলেন। আমমোক্তারনামা দেওয়ার কারণে সিমিন তার ভাইয়ের ওপর চরম ক্ষিপ্ত হন এবং এ কারণে জীবনের নিরাপত্তার কথা নিকটজনের কাছে আরশাদ বলেছিলেন। আমমোক্তারনামা দেওয়ার আট দিনের মাথায় ১৬ জুন লতিফুর রহমানের পুরোনো গৃহকর্মী মোসলেম হাওলাদারের মাধ্যমে আরশাদ গুরুতর অসুস্থ বলে জানতে পেরে তার গুলশানের বাসায় যান শাযরেহ। সেখানে গিয়ে ভাইকে বিছানায় মৃত অবস্থায় দেখতে পান। সেখানে আগে থেকেই সিমিন, যারাইফসহ মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই উপস্থিত ছিলেন।

মামলায় শাযরেহ হক দাবি করেন, তার ভাইয়ের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সংবাদ সেখানে উপস্থিত কেউ তাকে জানাননি। তা ছাড়া ভাইয়ের কোনো জটিল রোগও ছিল না। এ ঘটনার তিন-চার দিন আগে থেকে ভাইয়ের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করতে পারেননি। আরশাদের মৃতদেহ হাসপাতালে নিয়ে মৃত্যুর সার্টিফিকেট তাড়াতাড়ি গ্রহণ করা এবং ওই দিনই বিকালের মধ্যে দাফন করার জন্য সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন সিমিন। এর মধ্যে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে মৃতদেহ ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক ‘কেন দেরি করে আনা হলো’ এবং ‘অনেক আগেই মারা গেছেন’ বলে মন্তব্য করেন। মৃত ঘোষণার পর হাসপাতালের চিকিৎসক আরশাদের শারীরিক অবস্থা কী ছিল, তার কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি ছিল কি না জানতে চাইলে সঙ্গে থাকা ডা. মুরাদ নিজেকে আরশাদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে দাবি করেন এবং তিনি ‘সমস্ত জানেন’, ‘কোনো পুলিশি রিপোর্ট প্রয়োজন নেই’ বলে জানান। এরপর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ডা. মুরাদসহ সেখানে উপস্থিত কয়েকজন মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বজন ছাড়া মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে না বলে জানানোর পর শাযরেহ হকের স্বামী আরশাদ হক ভগ্নিপতি হিসেবে মৃতদেহ গ্রহণ করেন। হাসপাতালের সব কাগজপত্র ও মৃত্যুর সনদ ডা. মুরাদসহ অন্যরা নেন। তবে মৃত্যুর সনদের ছবি আরশাদ হক মোবাইল ক্যামেরায় তুলে রাখেন। মৃত্যুর কারণ ‘অজানা’ লেখা রয়েছে ওই সনদে।

মামলায় শাযরেহ হক দাবি করেন, বনানী করবস্থানে পারিবারিক আরও চারটি খালি কবর থাকার পরও তাড়াহুড়া করে তার ভাইয়ের মৃতদেহ তার ছোট বোন শাজনীনের কবরে কবরস্থ করা হয়। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদ্‌ঘাটনে ময়নাতদন্তের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিমিন হকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। আরশাদের মৃত্যুর পরপরই তার বাড়ি, গাড়িসহ অন্যান্য সম্পত্তি সিমিন রহমান, যারাইফ আয়াত হোসেনসহ অন্যরা দখলে নিয়ে নেন বলে মামলায় অভিযোগ করেন শাযরেহ হক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত