জাকির আজিজ

১৬ জুন, ২০১৬ ০০:১৯

অনলাইনে নারী নিগ্রহের অভিযোগও ছিল তারানা হালিমের স্বাক্ষর জালকারী অভির বিরুদ্ধে!

স্বাক্ষর জাল করার দায়ে নিজের ব্যক্তিগত সহকারী জিএম আসিফ আল মামুন অভিকে বরখাস্ত করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট তারানা হালিম।এই অভির বিরুদ্ধে এর আগে অনলাইনে নারী নিগ্রহের অভিযোগও ওঠেছিল। এ বিষয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপও কামনা করে নারী অধিকারকর্মীরা অনলাইনে লেখালেখিও করেছিলেন। তবে সেসময় অভির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের ব্যক্তিগত সহকারি (পিও) জি.এম. আসিফ আল মামুন অভি বিলুপ্ত ঘোষিত বিতর্কিত ভার্চুয়াল সংগঠন সিপিগ্যাংয়ের সদস্য। যদিও প্রতিমন্ত্রীর সহকারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর অভি সিপি গ্যাংয়ের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন।  

সে সময় অভি দাবি করেছিলেন,  "আসিফ খান অভি" তিনি নন। তার ছবি ব্যবহার করে ওই নামে একটি ভুয়া একাউন্ট করা হয়; এবং তিনি এই বিষয়ে থানায় জিডি করেছেন।
 
এ বছর শুরুর দিকে আসিফ খান অভি প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় সফরে সফরসঙ্গী হিসেবে যান। ফেসবুকে আপত্তিকর পোস্ট সরানো বিষয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতেই তখন বিদেশ যান তারানা। সেসময় অনেকেই প্রশ্ন তুলেন, একজন চিহ্নিত নারী নিগ্রহকারীকে সাথে নিয়ে এমন বৈঠকে কীভাবে যান প্রতিমন্ত্রী।

ফেসবুকে শহীদ কন্যা ও সাংবাদিক সুপ্রীতি ধর ও তাঁর মেয়েকে জড়িয়ে আসিফ খান অভি নামক আইডি এবং সিপি গ্যাং সদস্যদের অশালীন মন্তব্য ঘিরে তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সমালোচনা হয়।  যদিও এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী আগে থেকেই জানতেন না বলে মিডিয়ায় প্রকাশ হয়।  

জানা গেছে, তারানা হালিম টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যোগদান করার পর তাঁর পিও-এর দায়িত্বে ছিলেন মো. সোহেল রানা। গত নভেম্বরে সোহেল রানার চাকরি হয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি)। এরপর জি.এম. আসিফ আল মামুনকে তারানা হালিম নিজের পার্সোনাল অফিসার (পিও) হিসেবে নিয়োগ দেন।

নিয়োগপ্রাপ্তির সাত মাসের মাথায় সাবেক সিপি গ্যাং সদস্য আসিফ খান অভি প্রতিমন্ত্রী স্বাক্ষর জাল করে বরখাস্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে টেলিযোগাযোগ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে ৩ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পরই অভিযুক্ত অভির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানা গেছে, জিটুজি ঋণচুক্তি অনুযায়ী বিটিসিএলের ‘টেলিকমিউনিকেশন মডার্নাইজেশন’ প্রকল্পের কাজ পাবে চীনা কোম্পানি জেডটিই। এ কোম্পানি কাজ না পেলে ওই ঋণচুক্তিই বাতিল হয়ে যাবে। তাই জেডটিইকে কাজ দিতে মন্ত্রণালয়ের সব আয়োজন যখন প্রায় ঠিকঠাক, তখনই ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল করে তার পিও অভি ওই কোম্পানিকে কাজ না দিতে অর্থ বিভাগকে চিঠি দেন। ওই সময় তারানা হালিম দেশের বাইরে ছিলেন। দেশে ফিরে প্রতিমন্ত্রী যখন বুঝলেন তার স্বাক্ষর জাল করে ‘প্রতারণা’ করা হচ্ছে, তখনই তিনি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাময়িক বরখাস্ত করেন।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি টেলিকমিউনিকেশন মডার্নাইজেশন প্রকল্প নামে বিটিসিএলের অধীনে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পে বিনিয়োগের শর্তসহ বেশ কিছু কারণ দেখিয়ে বিনা দরপত্রে এ প্রকল্পের জন্য চীনা কোম্পানি জেডটিইর সঙ্গে এককভাবে চুক্তির জন্য বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী একটি প্রস্তাব তৈরি করেন। এ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থাতেই প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের স্বাক্ষর জাল করে অর্থ বিভাগে চিঠি পাঠান তার পিও আসিফ আল মামুন অভি।

জালিয়াতি করে অর্থ বিভাগকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ‘এককভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি না করে সীমিত আকারে দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করুন।’ এ চিঠি পাওয়ার পর বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। চিঠি পেয়ে অর্থ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও বিস্মিত হন। যেখানে ঋণচুক্তির শর্ত হচ্ছে, ওই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে হবে; সেখানে এ ধরনের চিঠির অর্থ কী? বিষয়টি নিয়ে অর্থ বিভাগে বিস্তর আলোচনার পর তারানা হালিমের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। তখনই জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।

এরপর বিষয়টি নিয়ে প্রতিমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। জানতে চান কীভাবে তার স্বাক্ষর জাল করা হলো এবং কে এই কাজ করল। শুরু হয় অনুসন্ধান।

মন্ত্রণালয় খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, জাল স্বাক্ষরের চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠান প্রতিমন্ত্রীর পিও অভি। এ সংক্রান্ত অন্যান্য কাগজও তার কাছে ছিল। এ ফাইল বিভিন্ন দপ্তরে নিয়ে আসার কাজও তিনি করেছিলেন। তখনই সবাই বুঝতে পারেন জালিয়াতির মূল ব্যক্তিটি পিও অভি। পরবর্তীকালে এ নিয়ে তারানা হালিমের জেরার মুখে অভি জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন এবং আগামীতে এ ধরনের কাজ করবেন না বলে ক্ষমাও চান। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণের পর থেকে যেকোনো ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতাকারী তারানা হালিম তাকে কোনো রকম ছাড় দেননি।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সূত্র জানায়, জালিয়াতির বিষয়ে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ার পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম তাৎক্ষণিক তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। একই সঙ্গে কেন অভি এ ধরনের জালিয়াতি করেছেন এবং এর সঙ্গে আর কারা জড়িত, তা জানতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পরই অভিযুক্ত অভির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি অর্থ বিভাগকে তার স্বাক্ষর জাল করে চিঠি পাঠানোর বিষয়টি জানিয়ে ওই চিঠি অগ্রাহ্য করতেও মৌখিকভাবে জানান।

প্রসঙ্গত, অভিকে প্রতিমন্ত্রী তাঁর প্রিভিলেজ থেকে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাকে নিয়োগ দেওয়ার পর থেকেই বিতর্ক উঠতে শুরু করে বিশেষত ফেসবুকে সিপি গ্যাং সদস্যদের সঙ্গে তারও নারী নিগ্রহের সম্পৃক্ততার কারণে।  এসব বিষয়ে তখন সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমসহ একাধিক অনলাইনে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়।  

এরআগে গত বছর জুলাই মাসে আইসিটি বিভাগের উদ্ভাবন তহবিলের অনুদান পায় সিপি গ্যাং। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক শুরু হলে রাতারাতি প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেওয়া হয় হ্যাপিওয়ার্কস। আইসিটি মন্ত্রণালয় বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য পরবর্তী তালিকায় নতুন নাম যুক্ত করলেও শেষ পর্যন্ত সংবাদ মাধ্যমে আলোচনা হলে অনুদান বাতিল হয়ে যায়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত