সিলেটটুডে ডেস্ক

০৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:১৩

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় চিকিৎসক ও পুলিশ সঠিক প্রতিবেদন দেননি: আদালত

বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও পুলিশ সঠিক প্রতিবেদন (রিপোর্ট) দেননি বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন হাই কোর্ট। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

রোববার (৬ আগস্ট) হাই কোর্টের বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেন। রায়ে দুজনের ফাঁসি বহাল রাখা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও দুজনকে খালাস দেন আদালত। এ ছাড়া নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ১৩ জনের মধ্যে দুজনকে খালাস দেওয়া হয়। আসামিদের মধ্যে ১১ জন পলাতক থানায় তাদের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি হাই কোর্ট।

আসামিদের সকলেই ছাত্রলীগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে বিশ্বজিতের দর্জি দোকান ছিল। তিনি থাকতেন লক্ষ্মীবাজার এলাকায়। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর।

ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল দুজন হলেন রফিকুল ইসলাম শাকিল ও রাজন তালুকদার। এ ছাড়া নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং দুজনকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া দুজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিরা হলেন রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, সাইফুল ইসলাম, কাইয়ুম মিঞা টিপু, রাজন তালুকদার ও মীর মো. নূরে আলম লিমন।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিরা হলেন এ এইচ এম কিবরিয়া, ইউনুস আলী, তারিক বিন জোহর তমাল, গোলাম মোস্তফা, আলাউদ্দিন, ওবায়দুর কাদের তাহসিন, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল-আমিন, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, মোশাররফ হোসেন ও কামরুল হাসান।

নিম্ন আদালতের রায়ের বিষয়ে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে অনুমতির জন্য আবেদন) ও আসামিদের করা আপিলের রায় রোববার ঘোষণা করা হলো। বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর রায় দেন বিচারিক আদালত।

২০১৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক প্রস্তুত হয়।

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির ডাকা সকাল-সন্ধ্যা অবরোধের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভেবে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে ছাত্রলীগের একদল কর্মী বিশ্বজিৎকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ হত্যার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তদন্ত শেষে চলতি বছরের ৫ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২১ জন কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ মামলার ৮ আসামিকে ফাঁসি ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

ভিডিওচিত্রে যা দেখা গিয়েছিল
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি ঠেকাতে সরকারি দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ সেদিন সন্দেহের বশে পুরনো ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে বিশ্বজিৎ দাসকে। কিছু ছাত্রলীগ নেতার দ্বারা সংঘটিত এই হত্যার ঘটনাটি ঘটে দিনের আলোয় সাংবাদিকদের সামনেই। বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনের চ্যানেলে এই হত্যাকাণ্ডের যে ফুটেজ।

এসব ভিডিও ফুটেজের একটিতে দেখা গেছে, বিশ্বজিৎকে একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার বারান্দায় ৭-৮ জন মিলে আঘাত করছে। এদের কারও হাতে ধারালো অস্ত্র, কারও হাতে চাপাতি, কারও হাতে কাঠের টুকরা আবার কারও হাতে রড। তারা সবাই বিশ্বজিৎকে ঘিরে ধরে আঘাত করছিল। এসময় বিশ্বজিৎ কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু কোনও আঘাতকারী তার কথা শুনছে এমনটা দেখা যায়নি ভিডিও চিত্রে। হামলাকারীদের একজনের শরীরে শার্টের ওপর হাতাকাটা সুয়েটার, একজনের শরীরে কালো রঙের শার্ট, একাধিক ব্যক্তিকে সাদা রঙের জামা ও দুইজনকে লালরঙের শার্ট পরিহিত অবস্থায় দেখা গেছে।

দ্বিতীয় তলায় বিশ্বজিৎকে ৭-৮ জন মিলে যখন আঘাত করছিল তখন সে নানাভাবে ছোটাছুটি করে বাঁচার চেষ্টা করছিল। এরমধ্যে আরও অনেক হামলাকারী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যারা প্রত্যেকেই তাকে আঘাত করেছে। আঘাত করার এক পর্যায়ে আরও অনেককে তাকে কিল ঘুষিও মারতে দেখা গেছে। কয়েকজন হামলাকারীকে দেখা গেছে বিশ্বজিৎকে ধাক্কা মেরে ভেতরের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে বিশ্বজিৎ ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে চলে যান। তখন আর কিছু দেখা যায়নি।

এরপর আরেকটি ভিডিও চিত্রে বিশ্বজিৎকে প্রথমে যে মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় আঘাত করা হয়েছিল তার সামনে নিচতলায় রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা গেছে। ওইসময়ের ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, বিশ্বজিৎ তখন রক্তাক্ত। দ্বিতীয় তলা থেকে নিচে দৌড়ে নামছেন। তাকে ধাওয়া করছে বেশ কয়েকজন যুবক। এরপর আবারও তারা বিশ্বজিৎকে ঘিরে ধরে মারতে থাকে। হামলাকারীদের প্রত্যেকের হাতেই রড, লাঠি ও ধারালো অস্ত্র দেখা গেছে।

আরেকটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, দোতলায় যখণ বিশ্বজিৎকে আঘাত করা হচ্ছে তখন রাস্তায় দাঁড়ানো অনেক মানুষ। এদের কেউ কেউ ছেলেটিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চিৎকার করছেন। তাদের সঙ্গে আশপাশ থেকে ভেসে আসছে আরও অনেক হইহল্লা।

অপর একটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, শার্টের বোতাম খোলা এক যুবক বীরদর্পে ঘটনাস্থল ত্যাগ করছে, যার পরনের শার্টের বাম পাশের বুক পকেটের ওপর লাল রক্তের ছোপ। পরবর্তীতে ওই যুবককে রফিকুল ইসলাম শাকিল ওরফে চাপাতি শাকিল হিসাবে শনাক্ত হয়েছে। বিশ্বজিতের রক্ত নিয়েই ক্যামেরার সামনে দিয়ে তাকে চলে যেতে দেখা গেছে।

এছাড়া বিভিন্ন স্থির চিত্রেও রড, লাঠি দিয়ে পেটানো ও চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য দেখা গেছে।

ময়নাতদন্তে যা লিখেছিলেন চিকিৎসক
বিশ্বজিতের মৃত্যুর পর মিডফোর্ড হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা বিশ্বজিতের মরদেহে এসব রড-লাঠি-ধারালো অস্ত্রের কোনও আঘাত খুঁজে পাননি। ধরা পড়েনি কিল-ঘুষি ও লাথির জখমও। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. মাকসুদুর রহমান বিশ্বজিৎ-এর শরীরে ধারালো অস্ত্রের মাত্র একটি আঘাত উল্লেখ করেছিলেন রিপোর্টে। রিপোর্ট নম্বর ৪৬৭/১২। রিপোর্ট তৈরির তারিখ ১৫ই ডিসেম্বর/২০১২।

রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেছেন, পিঠের ডান পাশে ৩ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও দেড় ইঞ্চি প্রস্থের একটি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। বাম পা থেঁতলে গেছে। মৃত্যুর কারণ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। এর বাইরে আর কোনও তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।

এদিকে, সুরতহাল প্রতিবেদনের সঙ্গেও মেলেনি ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন। লাশের সুরতহাল তৈরিকারী পুলিশ কর্মকর্তা বিশ্বজিতের শরীরে ২৫-২৬ টি আঘাতের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলেন। রক্তাক্ত ক্ষত স্থানসহ অসংখ্য ফোলা-জখমের দাগ ছিল লাশের দেহে বলেও উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

রায়ের পর্যবেক্ষণে যা বলেছেন আদালত
ছাত্র রাজনীতির নামে কিছু ছাত্র হত্যা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে থাকে। তারা মনে করে এতে তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ হবে। তাদেরকে কিছু রাজনৈতিক নেতা উৎসাহিতও করে। বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায় ঘোষণাকালে ছাত্র রাজনীতির নীতি ও কৌশল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিচারপতি এ মন্তব্য করেন।

রায়ে বলা হয়েছে, “বিশ্বজিৎ কোনো রাজনৈতিক দল করত না। সে ছিল নিরস্ত্র ও নিরীহ। এই হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত না হলেও হামলাকারীদের উন্মত্ত আক্রমণেই বিশ্বজিতের মৃত্যু হয়েছে।”

আদালত বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা এধরনের নেতাদের দ্বারা নির্যাতিত হয় যদি তারা দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ না নেয়। এটা অ্যালার্মিং। এসব ছাত্রনেতাকেই ভবিষ্যৎ জাতীয় নেতা ভাবা হয়ে থাকে। ছাত্র রাজনীতির কৌশল (পলিসি) সঠিক নয়।

রায়ে বলা হয়, “এমন একটা সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেছে যে, মিছিলে লোক বাড়ানোর জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয়। অনেক সময় আবাসিক শিক্ষার্থীরা হলের সিট ধরে রাখতে মিছিলে বা কর্মসূচিতে আসতে বাধ্য হয়।

“যদি সাধারণ শিক্ষার্থীরা দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করে তবে তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এরকম ঘটনাও দেখা গেছে যে, পরীক্ষার হলে নকল করতে না দেওয়ায় দায়িত্বরত শিক্ষককে মারধর করা হয়েছে। এটি ছাত্র রাজনীতির জন্য অশনি সঙ্কেত। কারণ তারাই ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেবে।”

রায়ের পর্যবেক্ষণে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছে হাই কোর্ট।

আদালত বলেছে, সাক্ষ্য এবং ভিডিও চিত্রে বিশ্বজিতের শরীরে একাধিক আঘাতের উল্লেখ থাকলেও মামলার সুরতহাল, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে একটি মাত্র আঘাতের কথা এসেছে। তবে প্রতিবেদন দুটিতে আঘাতের স্থান নিয়ে গড়মিল রয়েছ।

“একটি অস্বচ্ছ তদন্ত সমাজকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলতে পারে এবং সমাজে এ ধরনের অপরাধ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিতে পারে। ফলে ন্যায়বিচারের স্বার্থেই এ দুটি (সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত) বিষয়ে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।”

বিশ্বজিতের পরিবারের প্রতিক্রিয়া
বিশ্বজিত হত্যা মামলার রায়ে ক্ষুব্ধ-বিস্মিত তার ভাই উত্তম দাস। এ হত্যা মামলায় রায় ঘোষণার পর তিনি বলেন, ‘এটা কেমন রায় হলো! এমনটা তো আমরা চাইনি। এটা বিচার না খেলা? আগের আদালত আট জনকে ফাঁসি দিলো। আর এখন দিলো মাত্র দুই জনকে। তাহলে আগের বিচারক কী দেখে রায় দিলেন।’

উত্তম দাস বলেন, ‘দুই রায়ে এত পার্থক্য হয় কিভাবে! এখন দেখি চারজনকে খালাসও দেওয়া হয়েছে। তার মানে এই চারজন জড়িত ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘উচ্চ আদালত রায় দিলেন, কী বলব। অনেকেই জানতে চেয়েছেন খুশি হয়েছি কি না? এটা কি খুশি হওয়ার মতো রায়? কী বলব ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।’

তিনি বলেন, ‘আমি তো বিশ্বজিতের ভাই। সাধারণ জনগণকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করুন এ রায়ে তারা খুশি নাকি। আমি তো বলব আমি খুশি নই। আমার আরও চাই।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত