নিজস্ব প্রতিবেদক

২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৮:২৭

সিলেট আওয়ামী লীগে কামরানের বিকল্প কে?

২০০৮ সাল। সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্ববধায়ক সরকার ক্ষমতায়। বদরউদ্দিন আহমদ কামরান তখন কারাবান্দি। দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তবু সেসময় সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন এই সভাপতি।

এরআগের নির্বাচনগুলোতেও কামরানের এই জনপ্রিয়তার প্রমাণ মিলেছে। ১৯৭২ সালে ছাত্রঅবস্থায়ই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।
 
কেন কামরান এতো জনপ্রিয়- ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্ন করা হয়েছিলো সেবার কামরানের নির্বাচন পরিচালানা কমিটির সদস্য সচিব প্রয়াত সাংবাদিক মহিউদ্দিন শীরুকে।

জবাবে শীরু বলেছিলেন- কামরানকে কেউ আগে সালাম দিতে পারে না। তিনিই সবাইকে আগে সালাম দেন। সিলেটের লোকজন রাস্তাঘাটের উন্নয়নের চাইতে ভালো ব্যবহার ও সম্মান চান। কামরান সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করেন ও সবাইকে সম্মান দেখান। একারণে সিলেটবাসীও তাকে পছন্দ করেন।

এই ‘ভালো ব্যবহার’ দিয়েই টানা প্রায় ১৭ বছর সিলেট সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন কামরান।

‘এই শহরের প্রিয় নাম, বদরউদ্দিন আহমদ কামরান’- নিজের সমর্থকরা তার পক্ষে এমন স্লোগানও দিতেন। যদিও ২০১৩  ও ২০১৮ সালে সর্বশেষ দুটি সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আরফিুল হক চৌধুরীর কাছে হারতে হয় কামরানকে।

তবে ভোটের মারপ্যাচে হেরে গেলেও কামরান যে নগরবাসীর কাছে ‘প্রিয় নাম’ হয়েই ছিলেন তা আরেকবার বুঝা যায় তার মৃত্যুর পর। গত বছরের ১৫ জুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান কামরান। তার মৃত্যুর খবর দলমতনির্বিশেষে সিলেটের সকল মানুষকেই শোকাহত করে। করোনার ঝুঁকি উপেক্ষা করে তার জানাযায় মানুষের ঢল নামে।

বিজ্ঞাপন



কামরানের মৃত্যুর দেড় বছর পেরিয়েছে। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনেরও এখনো বছর দেড়েক বাকি। তবে এরইমধ্যে সিলেটে শুরু হয়েছে নির্বাচনী আলোচনা। বিশেষত সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগে কামরানের বিকল্প কে হতে পারেন এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। দলটির একাধিক নেতাই সিটি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হতে আগ্রহী।

সিলেট সিটির আগের সবকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কামরান ছিলেন অনেকটা ‘অটো চয়েস’। এবার কামরান নেই। ফলে আওয়ামী লীগকে খুঁজতে হচ্ছে নতুন প্রার্থী। তুমুল জনপ্রিয় কামরানের উৎকৃষ্ঠ বিকল্প কে হতে পারেন তা নিয়ে দলীয় ফোরামেরও চলছে আলোচনা।

তবে এখন পর্যন্ত কামরানের কোনো বিকল্প তৈরি হয়নি বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেল। সিলেটের এই নেতা বলেন, কামরান ভাইয়ের মাঠ পর্যায়ে যে গ্রহণযোগ্যতা ছিলো তা অন্য কারো নেই। তার কোনো বিকল্প নেই। তিনি দীর্ঘদিন জনপ্রিতিনিধি থেকে এ গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছেন, অন্যকারো পক্ষে রাতারাতি এটা করা সম্ভবও নয়।

কামরানের বিকল্প নেই তবু সিটি নির্বাচনের জন্য যোগ্য প্রার্থী খুঁজছে আওয়ামী লীগ- এমন তথ্য জানিয়ে নাদেল বলেন, আমাদের প্রার্থী সঙ্কট আছে। তবে দলীয় হাইকমান্ড এব্যাপারে চিন্তাভাবনা চলছে। বিভিন্ন জরিপে যিনি এগিয়ে আছেন তাকেই দল থেকে প্রার্থী দেওয়া হবে।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে কামরানকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ভোটের ব্যধানে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

দলের কোন্দল আছে, তবু এবারও বিএনপি থেকে মেয়র পদে আরিফুল হক চৌধুরীর মনোনয়ন পাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত বলে ধরা হচ্ছে। নগরে তার জনপ্রিয়তাও রয়েছে। ফলে কামরানের বিকল্পের পাশপাশি আরিফের যোগ্য প্রকিদ্বন্দ্বিও খুঁজতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে।

নির্বাচনের এখনও বছর দেড়েক বাকী থাকলেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে এখনই মাঠে নেমে পড়েছেন দলটির অনেক নেতা। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে নিজেদের মাঠ প্রস্তুত করার কাজ করে যাচ্ছেন তারা।

বিজ্ঞাপন



আগামী সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে ইতোমধ্যে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ এবং বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ছেলে ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আরমান আহমদ শিপলু।

এদরে মধ্যে শিপলু ছাড়া বাকী তিদনজনই গত সিটি নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন।

দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে মেয়র প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে ৫ জন নেতার নাম প্রস্তাব করে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ। তারা ছিলেন- মহানগরের তৎকালীন সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল আলওয়ার আলাওর, অধ্যাপক জাকির হোসেন ও তৎকালীন শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ। তবে দল থেকে বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

মেয়র পদে প্রার্থী হতে আগ্রহের কথা জানিয়ে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, গত নির্বাচনের সময় আমি মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ন সম্পাদক ছিলাম। তখনও দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলাম। এবার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বৃহত্তর পরিসরে কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রী চাইলে আমি জনগনের সেবা করতে চাই।

এই নির্বাচনে কামরানের অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংগঠন নেতা বানায়। কামরান ভাইকে সংগঠনই তৈরি করেছিলো। দায়িত্ব পেলে আমিও এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাই।

বর্তমান মেয়রের বিরুদ্ধে জনবিরোধী কাজের অভিযোগ এনে জাকির বলেন, তিনি জনবিরোধী কাজ করছেন। পানির বিল বাড়িয়ে দিয়েছেন। গাছ কাটছেন। প্রকল্পবাজি করছেন। জনগন এখন পরিবর্তন চায়। জনবান্ধব, পরিবেশবান্ধব মেয়র চায়।

গত নির্বাচনেও মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ। এবারও মেয়র পদে লড়তে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

আসাদ উদ্দিন বলেন, এবারও দলের মনোনয়ন চাইবো। আমি সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত আছি। দলের মূল্যায়ন করলে আমি সফল হতে পারবো।

নগরের সবশ্রেণির মানুষের সাথে সুস্পর্ক আছে জানিয়ে আসাদ বলেন, নগরের বর্ধিত অংশের সাথেও আমার ভালো যোগাযোগ আছে। নিয়মিতই আমি এসব এলাকায় যাতায়াত করছি।

বিজ্ঞাপন



আগামী নির্বাচনে কামরানের অভাব সম্পর্কে আসাদ বলেন, কামরান আমাদের প্রবীন নেতা। জনপ্রিয় নেতা। তার অভাব তো সকলেই অনুভব করবে। আমরাও করি। তবে নির্বাচনে এর প্রভাব ফেলবে না।

গত নির্বাচনেও মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন মহানগর আওয়ামী  লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ। নগরের ২০ নং ওয়ার্ডের টানা ৪ বারের কাউন্সিলর। এবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তার নাম আলোচিত হচ্ছে।

আজাদ বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে নগরবাসীর সেবায় নিয়োজিত রয়েছি। আশা করছি সবকিছু বিবেচনা করে দল এবার আমাকে মূল্যায়ন করবে।

আগামী সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কামরান পুত্র ডা. আরমান আহমদ শিপলুর নামও আলোচিত হচ্ছে। কামরান বেঁচে থাকতেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন শিপলু। এখন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন।

শিপলু বলেন, আমি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। সিলেটের মানুষের সাথে আমার পরিবারের আত্মার সম্পর্ক। আমার বাবা সিলেটের মাটি ও মানুষের নেতা ছিলেন। আজীবন বঙ্গবন্ধুর আর্দশের কর্মী ছিলেন। আমিও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার বাবার মতো সিলেটের মানুষের সুখে দুখে কাছে থাকার চেষ্টা করছি। সুযোগ পেলে আমি মানুষের জন্য কাজ করে যাবো।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত