নিজস্ব প্রতিবেদক

৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০১:৩৫

৭ বছর পর মুখোমুখি নৌকা আর ধানের শীষ

পৌরসভা নির্বাচন ২০১৫

জাতীয় নির্বাচন ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এর আগে নৌকা-ধানের শীষ আর লাঙলের লড়াই আগে দেখেনি মানুষ। এবারই প্রথম দেখছে, এবং একই সঙ্গে দীর্ঘ সাত বছর পর একই ব্যালট পেপারে প্রতীকগুলো এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোও। সর্বশেষ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুখোমুখি হয়েছিল তারা। 

বুধবার (৩০ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের ২৩৪ পৌরসভায় একযোগে ভোটগ্রহণ হবে বুধবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত, যে নির্বাচনী এলাকায় ভোটার রয়েছেন ৭১ লাখ জন।

সারাদেশের মোট ভোটারের মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশের অংশগ্রহণ এই ভোটে থাকলেও দশম সংসদ নির্বাচনের পর এই পৌর নির্বাচন রাজনৈতিক ডামাডোলে ‘মর্যাদার’ লড়াইয়ের আবহ দিচ্ছে।

দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি বলছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে পৌর ভোটে তাদের অংশগ্রহণ। অর্থাৎ এই ভোটে তাদের জয় হলে সেটা নির্দলীয় সরকারের প্রতি মানুষের সমর্থন হিসেবে তুলে ধরবে তারা।

অন্যদিকে এই ভোটে হারলে ‘আকাশ ভেঙে পড়বে না’ বলে মন্তব্য করলেও আওয়ামী লীগ নেতারা আশা করছেন, সরকারের উন্নয়নের প্রতি সমর্থনের প্রকাশ ঘটবে নৌকার জয়ের মাধ্যমে।

২০১১ সালে চার ধাপে আড়াই শতাধিক পৌরসভায় ভোটে প্রার্থীরা দলের সমর্থন নিয়ে ভোট করেছিল। তাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিজয়ী মেয়র প্রার্থী ছিলেন প্রায় সমান-সমান।

১২ হাজারের বেশি প্রার্থীদের মধ্য থেকে তিন সহস্রাধিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে সাড়ে ৩ হাজার কেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট দেবেন ৭০ লাখ ৯৯ হাজার ১৪৪ পৌরবাসী।

মেয়র পদে ভোট দলীয় প্রতীকে হলেও সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ভোট হবে আগের মতোই নির্দলীয়ভাবে, যদিও তাতেও রয়েছে রাজনৈতিক আবহ।

৭ মেয়র বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়: 
এবার ২৩৪ পৌরসভায় একজন করে মেয়র, সংরক্ষিত ৭৩১টি ও সাধারণ কাউন্সিলর কাউন্সিলরের ২ হাজার ১৯৩টি পদ রয়েছে।

ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপ সচিব সামসুল আলম জানিয়েছেন, ২৩৪ পৌরসভা নির্বাচনে ২০টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মেয়র পদে ৯৪৫ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রয়েছেন। এরমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের ৭ মেয়র প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন।

২৩৪ পৌরসভার মধ্যে আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রার্থী মুখোমুখি রয়েছেন ২২২টিতে। সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৮ হাজার ৭৪৬ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ২ হাজার ৪৮০ জন প্রার্থী। এদের মধ্যে কাউন্সিলর পদে ৯৪ জন ও নারী কাউন্সিলর পদে ৪০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

৭ ওসি, ২ রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রত্যাহার: 
প্রচারের সময় বিধি লঙ্ঘন-হামলার অভিযোগে ১১৪টি বিষয় খতিয়ে দেখার জন্যে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিল ইসি, যার অধিকাংশের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে মাঠ পর্যায় থেকে প্রতিবেদন আসে।

ইসির এই পদক্ষেপটি নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা আসে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে সাহসী হতে পারেন না মন্তব্য করে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেছিলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিয়ে ইসি দায় এড়াচ্ছে।

বিএনপি শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছিল, মন্ত্রী-এমপিরা বিধি ভঙ্গ করে প্রচার চালালেও ইসি কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সেই কথায় সায় আসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের কাছে থেকেও।

শেষ দিকে এসে আওয়ামী লীগ পাল্টা অভিযোগ তুলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দাবি করে, বিএনপির মিথ্যাচারে ‘বিভ্রান্ত’ হয়ে ইসি তাদের ‘বাড়তি সুবিধা’ দিচ্ছে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দল থেকে ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও এসব বক্তব্য নিছক ‘রাজনৈতিক’ বক্তব্য হিসেবেই নেন সিইসি।

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দল তাদের বক্তব্য দিয়েছেন, আপনারাও শুনেছেন। আমরা কিন্তু বিএনপি, আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্র হিসেবে বাছ-বিচার করছি না, আমরা করবও না। যেখান অভিযোগ পাচ্ছি ক্রসচেক করছি, খবর নিচ্ছি, তারপর অ্যাকশন নিচ্ছি।”

অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ইসি ইতোমধ্যে দুজন রিটার্নিং কর্মকর্তা, অন্তত সাতটি থানার ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান সিইসি। সাতজন সংসদ সদস্যকে সতর্ক করার কথাও বলেন তিনি।

ভোটে দায়িত্বরত নির্বাহী হাকিমরা মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৯১ জনকে ১০ লাখ ২৬ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা এবং চারজনকে কারাদণ্ড দিয়েছে বলেও তুলে ধরা হয় সাংবাদিকদের সামনে।

পর্যবেক্ষণে ১০ সহস্রাধিক: 
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ১০টি করে সংস্থার বিরুদ্ধে পর্যবেক্ষণে আপত্তি জানালেও শেষ পর্যন্ত তাতে সাড়া দেয়নি ইসি। পৌর ভোটে ২৯টি সংস্থার চার সহস্রাধিক পর্যবেক্ষককে অনুমোদন দিয়েছে ইসি। সেই সঙ্গে ঢাকার গণমাধ্যমের জন্য দুই হাজার সাংবাদিককে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে।

ইসির জনসংযোগ শাখা জানিয়েছে, স্থানীয় পর্যায়ের অন্তত চার হাজার সাংবাদিককে ভোটের সংবাদ সংগ্রহে কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে।

পৌর নির্বাচনে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে কোনো বাধা সৃষ্টি হবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন কাজী রকিব। সেই সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণে সাংবাদিকদের সহায়তাও চেয়েছেন তিনি।

পর্যবেক্ষণে চার কমিশনার:
নির্বাচন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সিইসি কাজী রকিব চার কমিশনারের মধ্যে বিভাগভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টন করেছেন। ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন কমিশন জাবেদ আলী। রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন কমিশনার আবু হাফিজ এবং চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দায়িত্বে থাকবেন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ। নির্বাচনের পরদিন পর্যন্ত সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং মাঠপ্রশাসনকে দ্রুত নির্দেশনা দেবেন কমিশনের সদস্যরা।

মনিটরিংয়ে সেল গঠন:
ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কার্যক্রম মনিটরিংয়ে বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারকির জন্য জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিনকে প্রধান করে সাত সদস্যের মনিটরিং সেলের অন্য সদস্যরা হলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, একজন পুলিশ সুপার (এসপি), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের প্রতিনিধি, র‌্যাবের প্রতিনিধি, আনসার ও ভিডিপির মেজর পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার অথবা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পর্যায়ের কর্মকর্তা। ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপ-সচিব সামসুল আলম জানিয়েছেন, কমিটি ২৩৪ পৌরসভার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির তদারক ও পর্যবেক্ষণ করবে। যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ইসিকে অবহিত করবে এবং প্রয়োজনে ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবে।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ১২ হাজার:
২৩৪ পৌরসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ১২ হাজার ১৬৯ জন। এর মধ্যে মেয়র পদে ৯৪৩ জন ও সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে আট হাজার ৭৪৬ জন এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে দুই হাজার ৪৮০ জন। ইতিমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র পদে সাত জন এবং কাউন্সিলর পদে ৯৪ জন নির্বাচিত হয়েছেন।

দায়িত্বে ৬৭ হাজার কর্মকর্তা:
নির্বাচনে ২৩৪ জন রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ তিন শতাধিক সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া ২৩৪ পৌরসভায় ৬৬ হাজার ৭৬৮ জন কর্মকর্তা ভোটগ্রহণে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রতি কেন্দ্রে একজন করে তিন হাজার ৫৫৫ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, প্রতি বুথে একজন করে ২১ হাজার ৭১ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং প্রতি বুথে দু'জন করে ৪২ হাজার ১৪২ জন পোলিং কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নির্বাচনে তিন হাজার ৫৫৫টি ভোটকেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট নেওয়া হবে। ২৩৪ পৌরসভায় মোট ভোটার ৭০ লাখ ৯৯ হাজার ১৪৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৩৫ লাখ ৫২ হাজার ২৮৪ জন এবং নারী ভোটার ৩৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬০ জন।

এ ছাড়া পৌর নির্বাচনে মাঠে থাকবেন এক হাজার ২০৩ জন ম্যাজিস্ট্রেট। এর মধ্যে ৯৬৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ২৩৫ জন। গত ১৪ ডিসেম্বর থেকে আচরণবিধি তদারকিতে মাঠে কাজ করছেন ২৩৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে ভোটের পরও দুই দিন।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ৭৪ হাজার সদস্য:
নির্বাচনে মোবাইল ফোর্স হিসেবে পর্যাপ্ত সংখ্যক র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবেন। আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত থাকবেন ৭৪ হাজার পুলিশ-আনসার-ভিডিপির সদস্য। প্রতি সাধারণ কেন্দ্রের নিরাপত্তায় কমপক্ষে পাঁচ জন পুলিশ (অস্ত্রসহ), অঙ্গীভূত আনসার একজন (অস্ত্রসহ), অঙ্গীভূত এপিসি (অস্ত্রসহ), অঙ্গীভূত আনসার/ ভিডিপি ১২ জন সদস্য (নারী-৬, পুরুষ-৬) থাকবেন। পার্বত্য এলাকা, দ্বীপাঞ্চল ও হাওর এলাকায় শুধু পুলিশের সংখ্যা বেড়ে দু'জন হবে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্রে ছয়জন অস্ত্রধারী পুলিশসহ মোট ২০ সদস্যের নিরাপত্তা দল থাকবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত