নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ জানুয়ারি, ২০১৬ ০২:৫৪

সাফল্য-ব্যর্থতায় আওয়ামী লীগ সরকারের ২ বছর

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দুইবারের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের ২ বছরপূর্তি আজ (১২ জানুয়ারি)। ২০১৩ সালের এ দিনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের শপথ নেয়।

সর্ববিনাশী জঙ্গি তৎপরতা, আগুন সন্ত্রাস, বিদেশি নাগরিক হত্যা ও ব্লগার হত্যার মতো পরিস্থিতি সত্ত্বেও দেশকে নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে সামনে এগিয়ে নিতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এখানে আছে সাফল্য যেমন, ঠিক একইভাবে আছে ব্যর্থতার কালো নখর।

আছে সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও সংগঠনের বেপরোয়া তৎপরতা, ঠিক তেমনি আছে দেরিতে হলেও সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চাইতে ঘটনা ঘটার আগের সেগুলো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকাটাই ছিল কাঙ্ক্ষিত, যদিও সেখানে আছে ব্যর্থতার নজির।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু:
বাংলাদেশের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। এ সেতুকে ঘিরে অনেক ষড়যন্ত্র ছিল, ছিল অনিশ্চয়তা। অবশেষে স্বপ্নের এ সেতু নির্মাণে হাত দিয়েছে সরকার। এটা সরকারের বিশাল এক অর্জন সন্দেহ নেই।

মধ্যম আয়ের দেশ:
আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নয়নে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্তি একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। আমরা জানি স্বাধীন দেশ হিসাবে যাত্রা শুরুর লগ্নে দেশটির ভাগ্যে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসাবে একটি অভিধা জুটেছিল। আর মাত্র সাড়ে চার দশকের মধ্যে দেশটির জন্য এমন স্বীকৃতি যথেষ্ট গর্বের বিষয়। এই স্বীকৃতি অর্জনের পেছনে বর্তমান সরকারের দিক-নির্দেশক ভূমিকা যেমন কৃতিত্বের দাবিদার তেমনি স্বীকৃত হতে হবে জনগণের অবদান।

সমুদ্রসীমা বিজয়:
সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা বিরোধের আন্তর্জাতিক আইনি নিষ্পত্তি এ সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধের নিষ্পত্তি হয়েছিল সরকারের বিগত মেয়াদে, আর ভারতের সঙ্গে হয় বর্তমান মেয়াদে। সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান দেশটির জন্যে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। উভয় সাফল্যই নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের পর্যাপ্ত কূটনৈতিক প্রস্তুতির কারণে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার:
সরকারের গর্ব করার মতো সাফল্যের পুরোভাগে রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির রায় কার্যকর। দেশি-বিদেশি সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে সাকা চৌধুরী, কামারুজ্জামান ও মুজাহিদের মতো রাজাকার ও আলবদর নেতাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।

বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে অর্থাৎ ২০১০ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নতুন করে শুরু করা হয়, যা দ্বিতীয় মেয়াদেও চলমান আছে। তবে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি ওঠলেও সরকার এ নিয়ে এখনও কোন ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নিতে পারে নি, বা নেয় নি।

প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি :
সরকারের এ মেয়াদে দুটি মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পেয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনায় এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নেতৃত্বের অবদানের জন্য জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনপি) সর্বোচ্চ পরিবেশবিষয়ক সম্মান 'চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ' এবং ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) 'আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার' অর্জন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া ওয়াশিংটনভিত্তিক সাময়িকী ফরেন পলিসির বিশ্বের একশ' চিন্তাবিদের তালিকায় নাম আসে শেখ হাসিনার। তিনি ওই তালিকায় সিদ্ধান্ত প্রণেতা ক্যাটাগরিতে শীর্ষ ১৩ জনের তালিকায় ছিলেন।

বেপরোয়া মন্ত্রী-সাংসদ:
সরকারের একাধিক মন্ত্রী সাংসদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া আচরণ ও বক্তব্য প্রদানের বিষয়টি ছিল দৃষ্টিকটু। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যিনি প্রতি সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতার পর প্রাথমিক অবস্থায় একে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে ওড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।

ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা ও জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও হত্যার ঘটনা ছিল এ সরকারের সবচেয়ে বড় অস্বস্তির কারণ। কিন্তু তিনি এসব ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে সমালোচিত হয়েছেন।

ভারতীয় নাগরিক অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তরের ঘটনা মিডিয়ায় প্রথমে তিনি জানেন না বলে ওড়িয়ে দিতে চাইলেও এর দেড় ঘণ্টা পর তা স্বীকার করে নেওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে। 

অভিযোগ ওঠেছে এলজিআরডি মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে। তার ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়েছেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। সামান্য এক ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে তাকে নজিরবিহীনভাবে হেনস্থা করা হয়েছে। সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে আইসিটি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করে তাকে হয়রানি করা হয়েছে। 

সিলেটের সাংসদ মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী কয়েস বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল সিলেটের কোর্ট পয়েন্ট নিয়ে গিয়ে দোররা মারার হুমকি দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি।

উপমন্ত্রী জয় একটা অনুষ্ঠানের ব্যানারে নিজের নাম দেখতে না পেয়ে সচিবালয়ে ভাঙচুর চালান। প্রকাশক দীপন হত্যার পর দীপনের বাবাকে কথাসন্ত্রাসে আক্রমণ করেন মাহবুবুল আলম হানিফ। এমপি পিনু খানের ছেলে রনির বিরুদ্ধে দু'জনকে খুন করার অভিযোগ উঠেছে। গাইবান্ধার সাংসদ মনজুরুল ইসলাম লিটন এক শিশুকে গুলি করার ঘটনা ঘটেছে।

নিষ্প্রাণ সংসদ :
দশম সংসদ নিষ্প্রাণ। সত্যিকার বিরোধী দল অনুপস্থিত। মন্ত্রীসভায় থেকে জাতীয় পার্টির প্রধান বিরোধী দল হওয়াটা অনেকের কাছেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। নানা ছুতোয় সংসদ বর্জন না করার বিষয়টি ইতিবাচক হলেও সরকারের সুরে কথা বলায় বিরোধী দলের ভূমিকা ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

দুর্নীতি :
দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পুরোপুরি স্বাধীনভাবে চলতে পারছে কি-না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবে দুর্নীতির তদন্ত ও অনুসন্ধান নিশ্চিত করতে দুদক মন্ত্রী-এমপি-আমলাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখনও ন্যায়পাল নিয়োগ হয়নি।

ব্লগার হত্যা ও বিশিষ্টজনদের হুমকি:
সরকারের দুই বছরে লেখক-প্রকাশক, ব্লগার, সংস্কৃতিকর্মী ও বিশিষ্টজনদের হুমকির মচ্ছব চলছে। গত বছরের শুরুতেই অভিজিৎ রায়কে খুন করে ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা। এরপর একে একে ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, ফয়সাল আরেফিন দীপনকে খুন, আহমেদুর রশীদ, রণদীপম বসু ও তারেক রহিমের ওপর আক্রমণ করলেও পুলিশ কাউকে ধরতে পারে নি।

শিয়া ও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদ এবং কান্তজিউর মন্দিরে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় কিছুটা হলেও কাবু হয়েছে সরকার। রাজধানীতে শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিল-পূর্ব প্রস্তুতিতে বোমা হামলার ঘটনা নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে। ধর্মযাজকের ওপর নৃশংস হামলার ঘটনায় সরকার বিব্রত হয়েছে।

২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। সে নির্বাচনে বিএনপি সহ অধিকাংশ দলই বর্জন করলেও এই দুই বছরে সরকার বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নিয়েছে। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠলেও নির্বাচন ব্যবস্থায় দলীয়ভাবে বিএনপিকে নিয়ে সরকারের অন্যতম সাফল্য।

বহির্বিশ্বে এ বছর বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বেড়েছে। নির্বাচন, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে মতভেদ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। ভারত ও চীনের সঙ্গে সখ্য বেড়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী সামরিক জোটে সমর্থন দেওয়ায় সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার হয়েছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় কার্যকরের পর বিবৃতি, জাল মুদ্রা পাচার ও জঙ্গি অর্থায়ন নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে খারাপ হলেও দেশের অধিকাংশ মানুষই একে সমর্থন করছে। এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জোরেশোরেই ওঠেছে।

গত দুই বছরে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বহু ক্ষেত্রেই সরকার সাফল্য দেখিয়েছে। বিশেষ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজসহ আরও অনেক অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সফলতা এসেছে। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচি যতটা প্রসারিত হয়েছে, ততটা গভীরতা পায়নি। পহেলা বৈশাখে নারী নিপীড়নের মত ঘটনায় সরকার কোন ব্যবস্থা নিতে পারে নি। দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অস্থিরতা চলছে। 

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতার কারণে সরকারের প্রথম বছরটি উৎকণ্ঠায় কেটেছে। ওই বছরে এক ধরনের চাপিয়ে দেওয়া স্থিতিশীলতা বিরাজ করলেও দ্বিতীয় বছরে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পথ ছেড়ে ইতিবাচক রাজনীতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত