৩১ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:২৩
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে যে সুপারিশ দিয়েছে তা ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছে বিএনপি। দলটি বলেছে, জুলাই সনদে সইয়ের সময় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিল, পরে মুদ্রিত পুস্তকে এর কয়েকটি দফায় অগোচরে বদল করা হয়েছে। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের দিন জুলাই সনদের চূড়ান্ত কপি কারও সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। পরে ছাপানো পুস্তকের কপিতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মত কয়েকটি দফা আমাদের অগোচরে ফের সংশোধন করা হয়।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি বলেছে, এভাবে সংশোধনের কারণে প্রায় এক বছর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এটি অর্থ ও সময়ের অপচয়, প্রহসনমূলক এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণা। এটি শুধু জাতিকে বিভক্ত করবে; ঐক্যের বদলে সৃষ্টি করবে অনৈক্য। মনগড়া যে কোনো সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে তা অকল্যাণ বয়ে আনতে পারে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে দলের অবস্থান জানান। এর আগে গত বুধবার রাতে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
যেসব দফার অগোচরে সংশোধন
জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর অগোচরে নেওয়া সংশোধনের বিষয়গুলো তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরকারি-বেসরকারি অফিসে টাঙানো-সংক্রান্ত বিধান অনুচ্ছেদ ৪(ক) বিলুপ্ত করার বিষয়টি সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদিও প্রায় সব রাজনৈতিক দল এতে সম্মতি দিয়েছিল। এ ছাড়া সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ (পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম তপশিল) পুরোপুরি বিলুপ্ত করার বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব বিষয়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দল সম্মতি দিলেও অগোচরে সেটা চূড়ান্ত সনদে সংশোধনী আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমাদের দলের পক্ষ থেকে অনেক বিষয়েই ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে যেসব বিষয়ে ভিন্নমতসহ ঐকমত্য হয়েছে, তার উল্লেখ না রেখে দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ আসেনি তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে ঐকমত্য কমিশনের এসব সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় আমরা একমত হতে পারছি না।
ভিন্ন দিনে গণভোট অযৌক্তিক
জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের সুপারিশকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে প্রস্তাবিত গণভোট করা সম্ভব নয়। সময়স্বল্পতা, নির্বাচনের জন্য বিপুল ব্যয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ লোকবল নিয়োগ এবং সংসদ নির্বাচনের মতো বিশাল আয়োজন বিবেচনায় জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত। এক আয়োজনে, একই খরচে সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট করা বাঞ্ছনীয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠানে আমরা একমত হয়েছি জাতির স্বার্থে, ঐক্যের স্বার্থে। এর বাইরে আমরা কোনোদিনই একমত হবো না; প্রশ্নই ওঠে না।
সংবিধান সংস্কার আদেশ জারির এখতিয়ার সরকারের নেই
মির্জা ফখরুল বলেন, জুলাই সনদে সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলোকে দুটি বিকল্প পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন এবং আইনি ভিত্তি দিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জুলাই সনদে সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার ‘জুলাই সনদ সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’ শিরোনামে একটি আদেশ জারি করবে। সরকারে এ রকম আদেশ জারির এখতিয়ার নেই। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের সংজ্ঞা অনুসারে আদেশ আইনের মর্যাদাপ্রাপ্ত। সেটি জারির এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির।
দ্বিতীয় বিকল্প প্রস্তাবের বিষয়টি তুলে ধরে মহাসচিব বলেন, বিকল্প প্রস্তাবে সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা হবে বলে উল্লেখ করেছে। বিলে উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধান সংশ্লিষ্ট তপশিল-১ বর্ণিত ৪৮ দফার (ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত দফা) ওপর গণভোট হবে।
এসব দফার বিপরীতে স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত, ভিন্নমত, নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশ একপেশে ও জবরদস্তিমূলক জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। সে কারণে সংলাপের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন ভিন্নমত পোষণে রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকারকে আমলেই নেয়নি।
সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন নিয়ে আলোচনা হয়নি
মির্জা ফখরুল বলেন, সুপারিশে বলা হয়েছে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পাশাপাশি একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন হবে। তারা আলাদাভাবে সংসদ সদস্য এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন। অর্থাৎ নির্বাচিত জাতীয় সংসদটি একই সঙ্গে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে অভিহিত হবে।
প্রশ্ন হলো– নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত ছিল না; আলোচনার জন্য উপস্থাপিত হয়নি। সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হওয়ার অবকাশও ছিল না।
সংবিধান সংস্কার পরিষদের প্রস্তাব কারা দিল
সংবিধান সংস্কার পরিষদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা হয়নি জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, হঠাৎ সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের প্রস্তাবটা দেওয়া হলো। সেটা কারা দিল? সুপারিশে কীভাবে এলো? তাহলে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, নাকি সংবিধান সংস্কার পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে– সেই এখতিয়ার তো নির্বাচন কমিশনের নেই। এসব পরিকল্পনা বা প্রস্তাব সুপারিশ করে জাতিকে বিভ্রান্ত, অনৈক্য সৃষ্টি, বিভক্ত করা ঐকমত্য কমিশনের কাজ হতে পারে না। তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনের পরে সেটা পূর্ণাঙ্গভাবে আইনি রূপ পাবে এবং সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। এ লক্ষ্যে আমরা সবাই কাজ করার জন্য সরকার, ঐকমত্য কমিশন এবং সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
নির্বাচন নিয়ে অনাস্থা নেই
মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচন বিঘ্নিত হওয়ার কারণ নেই। নির্বাচনের ব্যাপারে কারও প্রতি আমাদের অনাস্থা নেই। এ নিয়ে শঙ্কাও দেখছি না। আমরা চাচ্ছি, দ্রুত নির্বাচন হয়ে যাক। আশা করছি, নির্বাচন হবে। নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। আগামী মধ্য ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন– প্রধান উপদেষ্টা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জাতির সামনে, আমরা সেটায় আস্থা রেখেছি। সে হিসেবে আমরা নির্বাচনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
দ্রুত গণহত্যার বিচার চাই
এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগের যারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত; সরকারি কর্মকর্তা যাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাদের অবশ্যই দ্রুত বিচার হতে হবে।
প্রয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার কাছে যাব
এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, নালিশের কিছু নেই। যে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে আমাদের মতামত জাতির সামনে তুলে ধরলাম। প্রয়োজনে আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে আবার যাব।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান ও মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ।
আপনার মন্তব্য