সিলেটটুডে ডেস্ক

০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০২

বিতর্ককে সঙ্গী করে শেষ ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ

ঐক্যের ইঙ্গিত দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ প্রণয়ন করলেও, সেই সনদকে দিয়ে বিতর্কের শুরু করে শেষ হলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যকাল। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করা হয়েছে। এই বিতর্ককে সঙ্গী করে দুই দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর গতকাল ৩১ অক্টোবর শেষ হয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যকাল। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ কার্যকরের ভার এখন প্রধান উপদেষ্টার হাতে। ঐকমত্য কমিশন ঐক্যের বদলে বিভাজন সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপিসহ বেশ কিছু দল। 

গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫। বিএনপিসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল সেখানে স্বাক্ষর করেছে। কমিশন তার কার্যকালে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে তিন দফায় অর্ধশতাধিক বৈঠক করেছে কমিশন। ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ তৈরি করেছে। এ দলিলে ২৫টি রাজনৈতিক দলকে স্বাক্ষর করাতে পেরেছে কমিশন। কিন্তু সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও গণভোটের সময়কাল নিয়ে দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতভেদ দেখা দিয়েছে।

সংস্কারের উদ্যোগ ও কমিশন গঠন
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। পরবর্তী সময়ে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট গঠিত হয় সরকার। ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেন ছয়টি সংস্কার কমিশনের। এগুলো হলো সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন।

এই ছয় কমিশনের প্রধানদের নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ কার্যকর করতে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যার কাজ ছিল রাজনৈতিক দলগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখায় ঐকমত্য গড়ে তোলা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করে গঠিত এই কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ১৩ ফেব্রুয়ারি।

কমিশনের বৈঠক ও কার্যক্রম
প্রথমে ছয় মাসের মেয়াদে গঠিত হলেও পরবর্তী সময়ে দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন দফায় কমিশনের মোট ৭২টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসবের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ সংলাপ। বাকিগুলো জুলাই সনদ তৈরি ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত উপকমিটির বৈঠক।

বৈঠকগুলোতে প্রথম চার মাসের সংলাপে আলোচ্যসূচি ছিল সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন ব্যবস্থার পুনর্গঠন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন ও প্রশাসনিক জবাবদিহি। জুলাই মাসে আলোচনার মূল ফল হিসেবে প্রণীত হয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’, যা রাষ্ট্র সংস্কারের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা হিসেবে চিহ্নিত হয়।

‘জুলাই জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষর
গত ১৭ অক্টোবর ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং কমিশনের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে সই করেন এই ঐতিহাসিক দলিলে।

সনদে প্রধানত ছয়টি বিষয়ের ওপর ঐকমত্য গঠিত হয়। এগুলো ছিল: ১. গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ। ২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিচারপতিদের নিয়োগে সংসদীয় অনুমোদন। ৩. দুর্নীতি প্রতিরোধে সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসন। ৪. প্রশাসনিক জবাবদিহি ও নাগরিক সেবা নীতিমালা। ৫. মানবাধিকার রক্ষায় স্বাধীন কমিশন। ৬. পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর পেশাগত সংস্কার। সনদটির লক্ষ্য ছিল ২০২৫ সালের মধ্যেই রাষ্ট্রকাঠামোর মূল সংস্কার শেষ করা।

‘নোট অব ডিসেন্ট’ নিয়ে বিতর্ক
সনদে ২৫ দল সই করে। তবে সব প্রশ্নে পূর্ণ ঐকমত্য ছিল না রাজনৈতিক দলগুলোর। বিএনপি, গণফোরাম ও গণঅধিকার পরিষদ সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতি নিয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেয়। তাদের দাবি ছিল সংবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব সংসদীয় আলোচনার মাধ্যমে পাস করতে হবে, কমিশনের মাধ্যমে নয়।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জোর দেয় এ বিষয়ে গণভোট করে তাৎক্ষণিকভাবে অনুমোদন নেওয়ার পক্ষে। এই বিরোধ পরে আরও প্রকট হয় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ইস্যুতে।

বাস্তবায়ন সুপারিশ ও গণভোট বিতর্ক
গত ২৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশমালা হস্তান্তর করে কমিশন। তাতে প্রস্তাব ছিল: ১. সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা হবে; ২. ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন বা তার আগেই গণভোট আয়োজন করা হবে; ৩. সনদের বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণে ‘জাতীয় বাস্তবায়ন বোর্ড’ গঠিত হবে।

এরপর গণভোটের সময়কাল ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক বিভাজন। বিএনপি এবং কয়েকটি দল চায় জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হোক, যাতে নির্বাচিত সংসদই বাস্তবায়নের পূর্ণ দায়িত্ব পেতে পারে।

অন্যদিকে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল জোর দেয় নভেম্বরে গণভোট আয়োজনের ওপর, যাতে সনদ প্রধান উপদেষ্টার সাংবিধানিক ক্ষমতায় কার্যকর হয়।

এ ছাড়া ৩০ অক্টোবর সনদের আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় ইসির কাছে নভেম্বরেই গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ আটটি রাজনৈতিক দল। এসব দাবিতে নির্বাচন ভবনের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ শেষে দলগুলোর পক্ষ থেকে সিইসির হাতে স্মারকলিপি তুলে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বিরোধ এখন দুই স্তরে দেখা যাচ্ছে: এক. বাস্তবায়নের পদ্ধতি; দুই. গণভোটের দিনক্ষণ। সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা এবং সেটি খুব দ্রুত।’

এদিকে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় দ্বিতীয় ধাপের পাঁচ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব যথাযথভাবে বিবেচনা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট কমিশনপ্রধানরা। এরপর স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, নারী, শ্রম অধিকার ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশ জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্তির আহ্বান জানালেও তা আংশিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়।

বিশেষ করে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ- বৈষম্যবিরোধী সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় সামাজিক সংগঠনগুলো অসন্তোষ জানায়।

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর, এক বছর এক মাসে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম ধাপের ছয় কমিশন এবং দ্বিতীয় ধাপের পাঁচ কমিশন তাদের কাজ শেষ করে। ১৫ জানুয়ারি থেকে ধাপে ধাপে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশনগুলো এবং ৮ ফেব্রুয়ারি সরকার প্রকাশ করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন। এই ১১ কমিশনের যৌথ সুপারিশই পরবর্তী সময়ে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার ভিত্তি গড়ে তোলে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত