নিজস্ব প্রতিবেদক

০৯ ফেব্রুয়ারি , ২০১৭ ০১:০৩

সিলেটের রাজনীতিতে নেতৃত্ব শূন্যতা

সরকারে ছিলেন না, দলেও প্রভাব কমে গিয়েছিলো। তবু এতদিন শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ছিলেন সিলেটের রাজনীতির অভিভাবক হয়ে। ৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে তিনিও চলে গেলেন। সুরঞ্জিতের এই মৃত্যুতে সিলেটের রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে নেতৃত্ব শূন্যতা।

২০০১ সালে সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর মৃত্যুর মাধ্যমে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিলো সুরঞ্জিত সেনগুপ্ততে এসে তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর-মাঝখানে চলে গেছেন দেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, বিপ্লবী বরুণ রায়, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও শাহ এএমএস কিবরিয়া, সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী, সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ ও সৈয়দ মহসিন আলীসহ আরো কয়েকজন জাতীয় নেতা।

ওয়ান-ইলিভেন বিতর্কে রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে সরে পড়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মুহাম্মদ মনসুর।

নানা বিতর্ক সত্ত্বেও আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজের অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী। তিনিও নিখোঁজ রয়েছেন ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে।

আর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে রাজনীতিতে থেকে দূরে রয়েছেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী।

এদের বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি না হওয়ায় ও নতুন নেতা গড়ে না উঠায় এই সঙ্কট আরো তীব্র হয়েছে বলে জানান রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।

বর্তমানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ছাড়া দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নীতি নির্ধারণী কমিটিতে নেই সিলেটের কোনো নেতা। নাহিদ আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মনোনীত হন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের আহ্বায়ক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, এখানকার নেতারা দলীয় বৃত্তের মধ্যে বন্দি। এমনকি দলের মধ্যেও সবার কাছে তারা গ্রহণযোগ্য নন। দলের ভেতরের গ্রুপ উপগ্রুপের নেতা তারা। ফলে দল ছাপিয়ে জাতীয় নেতা, সব মানুষের নেতা হয়ে উঠতে পারছে না।

সুরঞ্জিত সেনরা যে দল ছাপিয়ে সকলের নেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তার প্রমাণ মিলেছে সোমবার সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও। জামায়াত ছাড়া প্রায় সব দলের নেতারাই এদিন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র (সাময়িক বহিষ্কৃত) ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরীও। যিনি সুরঞ্জিত সেন হত্যাচেষ্টা মামলারও আসামী।

এ ব্যাপারে আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, সাইফুর রহমান, সুরঞ্জিত সেনরা অনেক উঁচু মাপের মানুষ ছিলেন। তাঁদের মতো মানুষ হয় না। আমাদের শ্রদ্ধা তাদের প্রাপ্য।

বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি না হওয়ার জন্য প্রয়াত নেতারাও ‘অনেকাংশে দায়ী’ বলে মনে করেন ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এইসব নেতারা তাদের বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করে যাননি। হয়তো তাঁরা মনে করেছেন বিকল্প তৈরি করলে প্রতিদ্বন্দ্বী বেড়ে যেতে পারে।

এছাড়া ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া দলের ভেতরে নেতৃত্বের চর্চা না থাকাকেও নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দেওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সিলেট বিভাগের নেতাদের মধ্যে আব্দুস সামাদ আজাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্পিকার, শাহএএমএস কিবরিয়া অর্থমন্ত্রী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পান।

তবে পরেরবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই সংখ্যা নেমে আসে তিনে। মন্ত্রী হন আবুল মাল আবদুল মুহিত, নুরুল ইসলাম নাহিদ ও এনামুল হক মোস্তফা শহীদ। চলতি সরকারে অসুস্থ মোস্তফা শহীদের বদলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মৌলভীবাজারের সাংসদ সৈয়দ মহসিন আলী। তাঁর মৃত্যুর পর এখন সিলেটের নেতাদের মধ্যে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত ও শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন নুরুল ইসলাম নাহিদ।

কেবল মন্ত্রীসভা নয়, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আব্দুস সামাদ আজাদ ও সর্বশেষ কাউন্সিলের পূর্ব পর্যন্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রেসিডিয়ামে থেকে দলেরও অন্যতম নীতিনির্ধারক ছিলেন। এখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামে রয়েছেন কেবল নাহিদ।

বিএনপির সর্বশেষ শাসনামলে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন এম সাইফুর রহমান। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন তিনি। সেবার প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন সিলেটের আরেক নেতা হারিছ চৌধুরী। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশ ছেড়ে যান হারিছ চৌধুরী। এরপর আর তিনি দেশে ফিরেননি। আর সাইফুর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির শীর্ষ নীতিনির্ধারণী ফোরামে ঠাঁই হয়নি সিলেটের কোনো নেতার।

কেবল আওয়ামী লীগ বিএনপি নয়, সিলেটের বাম রাজনীতিতে রয়েছে নেতৃত্বের সঙ্কট। একসময় বরুণ রায়, পীর হবিবুর রহমান, আব্দুল হামিদের মতো নেতারা পুরো দেশের বাম রাজনীতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিপ্লবী বরুণ রায়ের মৃত্যুর পর এই ধারায়ও দেখা দেয় শূন্যতা।

সিলেটের অন্যান্য জাতীয় নেতাদের মধ্যে ২০০১ সালের ১ হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল আব্দুস সামাদ আজাদ, ২০১০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর দেওয়ান ফরিদ গাজী, ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সৈয়দ মহসিন আলী, ২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এনামুল হক মোস্তফা শহীদ মারা যান।

আর ২০০৪ সালের ২৭ হবিগঞ্জের নিজ এলাকায় গ্রেনেড হামলায় নিহত হন শাহএএমএস কিবরিয়া ও ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নিহত হন এম সাইফুর রহমান।

সিলেটের বাসিন্দা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন মনে করেন, তরুণদেরই এই শূন্যতা পূরণ করতে হবে।

জাকির বলেন, আমরা যারা তরুণ আমাদেরকে প্রয়াত হওয়া জাতীয় নেতাদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের তাদের মতো গড়ে তুলতে হবে।

গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্বে আছেন সিলেটের নেতা ব্যারিস্টার আরশ আলী। তিনি বলেন, আগে যারা রাজনীতি করতেন তারা অনেক পড়াশোনা করতেন। রাজনীতি, সমাজনীতি, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের অনেক জানাশোনা ছিলো। ফলে তাদের নিয়ে হয়তো অনেক সমালোচনা করা যাবে কিন্তু তাদের মেধা ও প্রজ্ঞাকে অস্বীকার করা যাবে না। এখন যারা রাজনীতি করছেন তাদের মধ্যে পড়াশোনার অভাব।

তবু আশাবাদ ব্যক্ত করে আরশ আলী বলেন, কোনোকিছু তো শূন্য থাকবে না। এই শূন্যতাও পূরণ হবে। আশা করছি, ভালো কিছু দিয়েই পূর্ণ হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত