ক্রীড়া প্রতিবেদক

২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ১৯:০৯

সালতামামি ২০১৫: ক্রিকেটে সাফল্যের তুঙ্গে থাকার বছর

অনেক শঙ্কা নিয়ে যে বছরের শুরু শেষটা এতটা সাফল্যের আলোয় মোড়া হবে সবচেয়ে বড় আশাবাদীও হয়ত এতটা ভাবেননি। ১৮ ওয়ানডে খেলে ১৩টিতেই জয়। সাফল্যের হারের বিবেচনায় অস্ট্রেলিয়ার পরেই অবস্থান। আর এশিয়ার বছরের সেরা ওয়ানডে দলের তকমা।

২০১৪ সালটা ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য চরম হতাশার, ব্যর্থতা ছিল নিত্যসঙ্গী। শ্রীলঙ্কা সিরিজ, এশিয়া কাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ভারত এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে ধারাবাহিক ব্যর্থতার সাথে ছিল সাকিবের সানপেনশন বিতর্ক। রুবেলের 'হ্যাপি' বিতর্কে জড়িয়ে যাওয়া।

তবে শেষটা ছিল আত্মবিশ্বাস যোগানোর আর মাশরাফির মঞ্চে আবির্ভূত হবার।  জিম্বাবুয়েকে টেস্ট এবং ওয়ানডেতে (৮-০) ধবলধোলাই করে। এই সিরিজেই ওয়ানডেতে মুশফিকের কাছ থেকে দায়িত্ব নেন মাশরাফি। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহাসিক সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মেনে নেন ক্রিকেট বিশ্লেষকরা।

বিশ্বকাপের বছর ২০১৫। অনেক ক্রিকেটের বছর। ভঙ্গুর, টালমাটাল বাংলাদেশকে দায়িত্ব নিয়েই পাল্টাতে থাকেন লড়াকু মাশরাফি।

২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, বিশ্বমঞ্চে পুল ‘এ’র সপ্তম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টস করতে নামার আগে সবগুলো অনুশীল ম্যাচে হেরে আসা বাংলাদেশ দল কেমন করবে ত নিয়ে চিন্তায় ছিল কোটি ক্রিকেটপ্রেমী। এই আফগানদের সাথে আগের বছর এশিয়া কাপে দেশের মাটিতে হেরে বসাও চোখ রাঙাছিল ভালোভাবেই।

তবে সব শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে  ক্যানবেরার মানুকা ওভালে আফগানদের দাপটের সঙ্গে ১০৫ রানে হারিয়ে মিশন শুরু হয় টাইগারদের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে পণ্ড হয়। লঙ্কানদের বিপক্ষে ২৬ ফেব্রুয়ারি ৯২ রানে হেরে বসে বাংলাদেশ।

কিন্তু ০৫ মার্চ পরের ম্যাচেই তিনশ রানের বেশি তাড়া করে  স্কটল্যান্ডকে ৬ উইকেটে হারায় লাল-সবুজের জার্সিধারিরা। তামিম, সৌম্য, মাহমুদুল্লার ব্যাটে ফুটে উঠে আত্মবিশ্বাস।

এর পরের ম্যাচ ০৯ মার্চ, অ্যাডিলেড, বিশ্বকাপের ৩৩তম ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। জিতলেই কোয়ার্টার ফাইনাল এমন সমীকরনে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের শতক, মুশফিকের ঝড়ো ফিনিশিং আর সৌম্যের আগ্রাসী শুরুতে ২৭৫ রানের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় মাশরাফির দল। তবে আসল চমক অপেক্ষা করছিল বোলিংয়ে। বিশ্বকাপের আগে 'হ্যাপী বিতর্কে' কারাগারে ঘুরে আসা পেসার রুবেলের আগ্রাসী পেসে ইংলিশরা কাবু হলে অবিস্মরনীয় জয় পায় বাংলাদেশ। মাশরাফি বাহিনীর জয়টি ছিল ১৫ রানের। ক্রিকেটের সুতিকাগার ইংল্যান্ড দল পর পর দুই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়।

অন্যতম ফেভারিট নিউনিল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে হেরে যায় বাংলাদেশ। তবে, লড়াই করেই ৩ উইকেটের হার মানে টাইগাররা। টানা দ্বিতীয় ম্যাচেও শতক হাঁকান মাহমুদুল্লাহ। ১২৮ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি। ৫৮ বলে সৌম্য করেন ৫১ রান। আর শেষ দিকে ব্যাটে ঝড় তুলে ২৩ বলে ৪০ রান করেন সাব্বির রহমান। মাশরাফির অনুপস্থিতিতে সে ম্যাচে সাকিবের নেতৃত্বে খেলে টাইগাররা ৭ উইকেট হারিয়ে তোলে ২৮৮ রান। জবাবে ৭ বল হাতে রেখে ৭ উইকেট হারিয়ে জয় তুলে নেয় কিউইরা। কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে ১০৯ রানে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু সে ম্যাচটি কতটা বিতর্কিত ছিল, তা সবারই জানা।

বিশ্বকাপ শেষেই দেশের মাটিতে ৩-০ ব্যবধানে বাংলাওয়াশ করে টাইগাররা। যে পাকিস্তানকে ১৯৯৯ এর ঐতিহাসিক ম্যাচে হারানোর পর তাদের বিপক্ষে আর জেতাই হচ্ছিল না, সেই তাদেরকেই সৌম্য-তামিমরে ছুঁড়ে ফেলেন মাঠের বাইরে। একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও জয় পায় বাংলাদেশ। টেস্টে তামিম-ইমরুল গড়েন রের্কড জুটি। তবে এক টেস্ট ড্র করলেও টেস্ট সিরিজ হেরে যায় টাইগাররা। পাকিস্তান সিরিজ দিয়েই সব আলো নিজের দিকে কেড়ে নেন উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান সৌম্য সরকার। ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিও পান তিনি।

এরপর ভারতকে মুস্তাফিজ কাটারে কুপোকাত করে ২-১ এ ওয়ানডে সিরিজে হারিয়ে বিশ্বকাপের বিতর্কিত ম্যাচের শোধ তোলে মাশরাফির বাংলাদেশ। এই সিরিজ দিয়েই বিশ্ব ক্রিকেটে আবির্ভূত হন মুস্তাফিজুর রহমান।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারার পর প্রথম ওয়ানডেও হেরেছিল বাংলাদেশ। তবে পিছিয়ে থেকেও দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২-১ ব্যবধানে হারায় দুর্দান্ত ম্যাশ বাহিনী। দুই ম্যাচেই ব্যাটিং তাণ্ডব দেখিয়ে ম্যাচ সেরা হন সৌম্য সরকার। তবে বৃষ্টি টেস্ট সিরিজের ফল এনে দিতে দেয়নি।

বছরের শেষটাও আরেকটি বড়দলকে ধরাশায়ী করার মধ্য দিয়ে শেষ হতে পারত। নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ট্রেলিয়া শেষ মুহুর্তে সফর বাতিল করায় বঞ্চিত হন টাইগার সমর্থকরা।  তবে জিম্বাবুয়েকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে ওয়ানডেতে এ বছর এশিয়ার সেরা দলের মার্যাদা অক্ষুন রাখে লাল সবুজের প্রতিনিধিরা।  

টি-টোয়েন্টি ফরমেটে টাইগাররা ২০১৫ সালে খেলেছে ৫টি ম্যাচ। এর মধ্যে দুটি ম্যাচেই জেতে স্বাগতিক হিসেবে খেলতে নামা বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ জেতে দাপটের সঙ্গে। সফরকারীদের ১৪১ রানকে লাল-সবুজরা টপকে যায় ২২ বল হাতে রেখে। সাকিব আর সাব্বির রহমানের দুটি অপরাজিত অর্ধশতকে ৩ উইকেট হারিয়ে সহজ জয় তুলে নেয় মাশরাফির দল। অপর জয়টি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৪ উইকেটের। একই দলের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ হার মানে ৩ উইকেটে। তার আগে দ. আফ্রিকার বিপক্ষে দুটি ম্যাচেই পরাজয়ের মুখ দেখে স্বাগতিক বাংলাদেশ।

এ বছর বাংলাদেশ পেয়েছে নতুন নতুন ম্যাচ উইনার। টেস্টের বিস্ময় মুমিনুল হক, তাইজুল ইসলাম, জুবায়ের লিখন আর ওয়ানডের চমক সৌম্য, সাব্বির, লিটন, মুস্তাফিজ, তাসকিনদের মতো বিশ্বমানের ক্রিকেটার নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশ্ব  মিডিয়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতির কথা বারবার ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। বলা যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক ফলাফল নিশ্চিত উর্ধগামী।

২০১৫ সালের সাফল্য সমর্থকদের প্রত্যাশাকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুন। ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপে মাশরাফিরা দারুণ কিছু করবে এমন প্রত্যাশা সকলের। 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত