নিজস্ব প্রতিবেদক

২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ১৯:২২

সালতামামি ২০১৫: বর্বরোচিত শিশু হত্যা ও দ্রুততম বিচারের বছর

সিলেটের সদর উপজেলার বাদেআলী গ্রামের ১৩ বছরের শিশু সামিউল আলম রাজন। কিছুটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি। তাই লেখাপড়ার ছেড়ে মায়ের সাথে সবজি চাষ এবং তা বাজারে বিক্রি করেই নিত্য অভাবের সংসারে কিছুটা সহযোগিতা করতো রাজন।

এই গ্রামীণ, নীরিহ, গরিব শিশুটিই জাগিয়ে তুললো পুরো দেশ। জাগিয়ে তুললো পুরো দেশের বিবেক। পুরো দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এলো এই শিশুর জন্য। মানুষ দাবি জানালো ন্যায় বিচারের এবং গ্রুত বিচারের। এমনকি জনতা উদ্যোগী হয়েই আসামীদের তুলে দিলো পুলিশের হাতে।

ঘটনার সূত্রপাত গত ৮ জুলাই। এই সকালেও অন্যান্যদিনের মতো সবজি বিক্রি করতে কুমারগাও আসে রাজন। কুমারগাওয়ে একটি গাড়ি মেরামতখানায় চুরির অপবাদে রাজনকে আটকে রেখে মারধর শুরু করে এই মেরামতখানার চৌকিদার ময়না। (যদি আদালতে সাক্ষীরা জানিয়েছেন, বলাৎকারে ব্যর্থ হয়েই রাজনের বিরুদ্ধে চুরির অপবাদ তুলে ময়না।)

এরপর সেই মারধরে এসে শরিক হয় এই গাড়ি মেরামতখানার মালিক মুহিত হােসেন, তার ভাই সদ্য সৌদি ফেরত কামরুল ইসলামসহ অন্য ভাইয়েরা এবং আশপাশের আরো কয়েকজন। বিকৃত-বিভৎস নির্যাতন চালানো হয় রাজনের উপর। এই নির্যাতনের ভিডিওচিত্রও ধারণ করে ঘাতকরা।

নির্যাতন সহ্য করে না পেরে একপর্যায়ে মারা যায় শিশু রাজন। মৃত্যুর আগে পানি খেতে চেয়েছিলো রাজন। তাকে ঘাম খেতে বলে ঘাতকরা।

তবে তখন পর্যন্ত পুলিশ, ঘাতকেরা, রাজনের গ্রামের লোকজন আর সংশ্লিষ্ট দু'একজন ছাড়া তেমন কেউ জানতো না ঘটনাটা। মিডিয়ায় গুরুত্বহীনভাবে এসেছে লাশ উদ্ধার আর মামলা দায়েরের খবর।

১০ জুলাই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে রাজনকে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র। ১১ জুলাই থেকে সকল মিডিয়ার প্রধান খবরে পরিণত হয় এই ভিডিওচিত্র। এরপর তো ইতিহাস। সারাদেশজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। টনক নড়ে প্রশাসনের। সরকারের বড় বড় মন্ত্রীরা এসে ভীড় করতে থাকেন রাজনের বাড়িতে। আসে বিভিন্ন মহল থেকে অর্থ সাহায্য। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলতে থাকে দেশের বাইরেও।

বাদেআলী গ্রামের এই নিরীহ শিশু হত্যার ঘটনাই হয়ে ওঠে দেশের সবচেয়ে আলোচিত খবর।

রাজন হত্যার পরপরই পালিয়ে সৌদি আরব চলে গিয়েছিলো মামলার প্রধান আসামি কামরুল ইসলাম। সেখানেই সৌদি প্রবাসীরা তাকে আটক করেন। জনতার চাপে ইন্টারপোলের (আন্তর্জাতিক পুলিশ) মাধ্যমে গত ১৫ অক্টোবর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

রাজন হত্যার ঘটনা নিয়ে যে যখন দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে ঠিক সেই সময়ে, ৩ আগস্ট বিকেলে খুলনার টুটপাড়া কবরখানা মোড়ে এক ওয়ার্কশপে মোটরসাইকেলে হাওয়া দেওয়া কমপ্রেসার মেশিনের মাধ্যমে মলদ্বারে হাওয়া ঢুকিয়ে হত্যা করা হয় ১২ বছরের শিশু রাকিব হাওলাদারকে। এই হত্যার ঘটনায়ও দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বছরজুড়েই এই দুটি শিশু হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলে।

এই দুটি হত্যার কান্ডের বিচার কাজও শেষ হয় দ্রুততম সময়ে। যা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় এক অনন্য নজির সৃষ্টি করে।

৮ নভেম্বর শিশু রাজন ও রাকিব হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয়। মাত্র ১৪ কার্যদিবসে রাজন ও ১০ কার্যদিবসে রাকিব হত্যা মামলার রায় প্রদান করা হয়।

সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলার রায়ে সূদি পালিয়ে যাওয়া প্রধান আসামী কামরুল ইসলামসহ চার জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।

রায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন- ময়না চৌকিদার, তাজউদ্দিন আহমদ বাদল ও জাকির হোসেন পাভেল। অপরদিকে একিদিনে ঘোষিত রাকিব হত্যা মামলার রায়ে দুই জনের মৃত্যুদণ্ড হয়। ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামিরা হলেন শরীফ মোটরসের মালিক মো. শরীফ ও তাঁর সহযোগী মিন্টু।

তবে দ্রুততম সময়ে বিচার কাজ শেষ হওয়ার ক্ষেত্রে রাজন ও রাকিব হত্যা মামলাকেও ছাপিয়ে যায় সিলেটে আরেক আলোচিত শিশু হত্যা, আবু সাঈদ হত্যার মামলা। মাত্র ৮ কার্যদিবসে গত ৩০ নভেম্বর সাঈদ হত্যা মামলার রায় প্রদান করা হয়। রায়ে ওলামা লীগ নেতাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- সিলেটের বিমানবন্দর থানার বহিস্কৃত কনস্টেবল এবাদুর রহমান পুতুল, সিলেট জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাকিব ও র‌্যাবের কথিত সোর্স আতাউর রহমান গেদা।

চলতি বছরের ১১ মার্চ নগরীর শাহ মীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আবু সাঈদ (৯) অপহৃত হয়।

অপহরণের তিনদিন পর ১৪ মার্চ নগরীর ঝর্ণারপাড় সোনাতলা এলাকায় পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমান পুতুলের বাসার ছাদের চিলেকোঠা থেকে আবু সাঈদের বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত