চয়ন চৌধুরী

১৫ জুন, ২০১৮ ০২:১৭

জয়তু রুশ দেশের ফুটবলযজ্ঞ

রবি ঠাকুর লিখেছিলেন-
“নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে॥”

বর্ষাবরণের মাহেন্দ্রক্ষণে কবিগুরুর এ চরণ বাঙালি হৃদয়ে দোলা দেবে-ই। মধুমাস জ্যৈষ্ঠের শেষ ক’দিনের খরতাপের পর এবারের বর্ষা সত্যিকার প্রেমসুধা হয়ে আসছে। এবারে বর্ষার আবাহত গীতের সঙ্গে ঈদের রঙ মিশেছে। আম-বাঙালির জীবনের এই রঙকে আরও বর্ণিল করতে শুরু হচ্ছে অবাক চর্মগোলকের নান্দনিক শৈল্পিকতা।

বাঙালি জীবনে শিল্প-সাহিত্যের মূলস্রোত বরাবর-ই রবিঠাকুরের হাত ধরেই এসেছে। সেই নিয়ম মেনেই হয়ত এই জাতিকে মহাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের রূপ-রস দর্শন করিয়েছিলেন বিশ্বকবি। সোভিয়েত ভাঙার পর আজকের রাশিয়ার পরাশক্তি রূপ সকলের কাছেই চেনা। কিন্তু এবার ভিন্ন আরেক রাশিয়া সারাবিশ্বের সামনে পসরা সাজিয়েছে।

এও শিল্প; চর্মগোলকের শিল্প! এতে শিল্পীরা হাতে নয়; পায়ে শিল্প সৃষ্টি করবেন! এই শিল্পের পায়ে পায়ে-ই চিরচেনা বরফে ঢাকা পারমানবিক শক্তিধর রাশিয়া চলতি গ্রীষ্মে নবরূপে হাজির হচ্ছে বিশ্বনাগরিকের কাছে। ঐতিহাসিককালের যাগযজ্ঞ একালে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য পাওয়া অসম্ভব। আধুনিককালে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ অভিধা পাওয়া ফুটবল যজ্ঞ অবশ্য তার অভাব বুঝতে দেয় না।

১৪ থেকে  ১৫; মধ্য জুন থেকে মধ্য জুলাই। বিশ্বের নানা টাইম জোনের ফুটবলপ্রেমী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ভুলে যাবেন ব্যক্তির রোজনামচা। মেসি, রোনালদো, নেইনাম, মুলার, ইনিয়েস্তা, গ্রিজম্যান, সালাহ, কেন, সুয়ারেজ, মডরিচের পায়ে চর্মগোলকের শিল্পের ঘড়িতেই তাদের রোজনামচার সুর বাজবে।

বিশ্বকবিতে সূচনার নেপথ্যে ছিল দ্বারের বর্ষার সুন্দর্য। বর্ষায় বাঙালিকে সেই রবিঠাকুরে আশ্রয় নিতে হয়। আবার রুশদের জানতেও বাঙালির প্রথম ভরসা একই কবি। বাঙালির বর্ষায় এবার তাই বৃষ্টিভেজা মাঠে চর্মগোলকের শিল্পটুকু সঙ্গী হবে নিশ্চিত।
বোকা বাক্সের সৌজন্যে হাজার হাজার মাইল দূরের মাঠে ফুটবল শিল্পীদের শিল্পের ধারা বাঙালির পায়ে কতটুকু খেলা করবে; তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। তবে শারাপোভা, কুর্নিকোভাদের দেশের চর্মগোলকের শিল্প বাঙালির এবারের বর্ষার আনন্দ দ্বিগুণ হবে নিশ্চিত।

ইশশ, ফুটবল নিয়ে লিখতে গিয়ে বাঙালি, রবিঠাকুর আর বর্ষার কথাই বেশি লেখা হয়ে গেছে! অবশ্য রাশিয়া বিশ্বকাপে ৩২ দলের সুযোগ, সম্ভাবনা নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই। এসব বাঙালি ফুটবলপ্রেমী সকলের ইতিমধ্যে মুখস্ত হয়ে গেছে। এমনকি যে এক ডজন মাঠে খেলা হবে; তার বিস্তারিতও অধিকাংশের নখদর্পনে আছে।

তবে লেখার শেষ করার আগে রুশ কাহিনী একটু বলে নেওয়া দরকার। এমনিতেই অবশ্য পুতিনের দেশ নিয়ে বিশ্ববাসীর আগ্রহ; তার উপর বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে তা আরও মনোযোগ আকর্ষণ করে নিয়েছে। ফুটবল যজ্ঞ দেখতে আগতদের স্বাগত জানাতে রুশ বাস কন্ডাকটরদের হাসি শেখানো হচ্ছে বলে খবর। এদের কাছে হাসি মানে ৮ থেকে ১২টি দন্ত প্রদর্শণ!

রুশ ললনা নিয়ে যত-ই কাব্য করুন; বাঙালি নারী তার চেয়ে অনেক বেশি এবং অবশ্য সুন্দর হাসতে পারে। পক্ষান্তরে রুশ পুরুষের আবার খানিকটা দুঃখ আছে! ১৬৯৮ সালে তৎকালীন সম্রাট প্রথম পিটার রুশ পুরুষদের ক্ষেত্রে দাঁড়ি রাখতে চাইলে কর দেওয়ার আইন করেন। ভাগ্যিস আমাদের এদেশে এমন কোন অপআইন নেই; থাকলে লেখককেও করের আওতায় পড়তে হত!

শ্মশ্রু আইনের মত রুশদের চাইলে বাঙালি আরেকদিকে অনেক এগিয়ে আছে। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, বাংলা যেখানে ৩০ কোটি মানুষ কথা বলে; সেখানে রুশ ভাষায় কথা বলে ২৬ কোটি মানুষ।

আজ আর না। একমাস-ই কাব্য করার সুযোগ আছে! তবে শেষেও আরেকবার কবিগুরুকে স্মরণ। তিনি ‘লেখন’ এ লিখেছেন-
স্বপ্ন আমার জোনাকি
     দীপ্ত প্রাণের মণিকা,
স্তব্ধ আঁধার নিশীথে
     উড়িছে আলোর কণিকা॥  
বিশ্বকাপ নিয়ে ৩২ দেশের ৭৩৬ জন খেলোয়াড়, তাদের কোচ-সাপোর্ট স্টাফ, সমর্থক-অনুগারী মিলে শত শত কোটি মানুষের মনেও এখন উড়িছে আলোর কণিকা। বাংলার ঘরে-বাইরে উড়িছে প্রিয় দলের ঝান্ডা। জয়তু বিশ্বকাপ ফুটবল।

চয়ন চৌধুরী: সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত