নিজস্ব প্রতিবেদক

১৪ অক্টোবর, ২০২০ ০১:৫৭

ছাত্রাবাসে ধর্ষণের পর হেফাজতে মৃত্যু: কাঠগড়ায় সিলেট মহানগর পুলিশ

বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি)-এর। একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন এসএমপি কর্মকর্তারা। এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে সমঝোতার চেষ্টার অভিযোগ ওঠেছিলো। নিজেদের এলাকায় ঘটনা ঘটলেও এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ৮ জন আসামির মধ্যে একজনকেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি মহানগর পুলিশ।  

এই ঘটনা নিয়ে বিতর্কের মধ্যে এবার এসএমপির আওতাধীন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ভেতরে নির্যাতনে এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠেছে। এ ঘটনায় রীতিমত কাঠগড়ায় সিলেট মহানগর পুলিশ। ওই ফাঁড়িতে সিলেট নগরের আখালিয়া এলাকার যুবক রায়হান আহমদের মৃত্যুর ঘটনায় ফাঁড়ির ইনচার্জসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের নাম উঠে এসেছে।

কেবল ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরাই নয়, রোববার সকালে রায়হানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া ও ভিন্নখাতে প্রবাহিতের চেষ্টা চালান। রায়হানকে ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে গণপিটুনিতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সর্বশেষ এই ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবর হোসেন ভূইয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না বলেও বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশের ব্যারাক থেকে অভিযুক্ত কর্মকর্তার পালিয়ে যাওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজ ছাত্রাবাসের সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক তরুণী। এই ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা। তবে সময়ক্ষেপণ করে তারা ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন এবং সমঝোতার চেষ্টা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন



রাত সাড়ে ৮টায় ওই ঘটনার পর পুলিশ রাত ৯টার দিকে ছাত্রাবাস এলাকায় পৌঁছে। অপরদিকে, ছাত্রাবাস থেকে নির্যাতিত তরুণীকে বের করে আনে রাত সাড়ে ১১টার দিকে। এই দীর্ঘসময় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। এদিকে, ধর্ষণের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগে শাহপরান থানা পুলিশের পক্ষ থেকে ফোন দেওয়া হয় স্থানীয় সরকার দলীয় এক নেতাকে। অভিযুক্তরা ওই নেতার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে। ধর্ষণের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগে পুলিশ কেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকে ফোন দেবে- এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই মহানগর পুলিশের কর্মকর্তাদের কাছে।  

এই ধর্ষণের ঘটনায় নির্যাতিত তরুণীর স্বামী বাদী হয়ে ৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ২/৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ৮ জন। তবে এদের কাউকেই মহানগর পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিলেট রেঞ্জ পুলিশ ও ৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছে র‌্যাবের হাতে। রেঞ্জ পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ধর্ষণের পর দীর্ঘসময় মহানগর এলাকায়ই ছিলো আসামিরা। পরদিন তারা মহানগর পুলিশের আওতাধীন এলাকা থেকে বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে যায়।

নিজেদের এলাকায় ঘটনা ঘটার পরও আসামি ধরতে না পারা, তাদের পালিয়ে যাওয়া ও পরে অন্যবাহিনীর হাতে সবাই গ্রেপ্তার হওয়ায় প্রশ্ন ওঠেছে সিলেট মহানগর পুলিশের ভূমিকা নিয়ে।

দেশব্যাপী তোলাপাড় সৃষ্টি করা ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে সমালোচনার মুখে থাকা সিলেট মহানগর পুলিশের বিরুদ্ধে এবার এক যুবককে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করা এবং সেই ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিতের চেষ্টা চালানোর অভিযোগ ওঠেছে।

গত রোববার (১১ অক্টোবর) ভোরে মারা যান সিলেটের আখালিয়া এলাকার যুবক রায়হান আহমদ। পুলিশের পক্ষ থেকে ওই দিন সকালে জানানো হয়, ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন রায়হান। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এমনটি জানান গণমাধ্যমকে।

তবে বিকেলে রায়হানের পরিবারের বক্তব্য গণমাধ্যমে আসার পর বদলে যায় চিত্র। পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, রোববার ভোরে রায়হান একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে তার মায়ের নাম্বারে ফোন দিয়ে জানান, তিনি বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাকে মারধর করা হচ্ছে। ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

বিজ্ঞাপন



ফোন পেয়ে ৫ হাজার টাকা নিয়ে তাড়াতাড়ি পুলিশ ফাঁড়িতে আসেন রায়হানের সৎ বাবা হাবিবুল্লাহ চৌধুরী। কিন্তু টাকা কম থাকায় রায়হানের সাথে তাকে দেখা করতেও দেয়নি পুলিশ। পরে ১০ হাজার টাকা নিয়ে তিনি আবার ফাঁড়িতে গেলে পুলিশ জানায়, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে ওসমানী হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে রায়হানের লাশ দেখতে পান হাবিবুল্লাহ।

এমন অভিযোগ নিয়ে তোলপাড়ের পর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তারা সিলেট পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সিসিটিভি ফুটেজে দেখতে পান- ভোরে একটি অটোরিকশায় করে সুস্থ অবস্থায় রায়হানকে ফাঁড়ির ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। আবার সকালে অসুস্থ অবস্থায় ধরাধরি করে তাকে ফাঁড়ি থেকে বের করে আনা হচ্ছে। এমন প্রমাণ পাওয়ার পর ফাড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিন পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত হওয়া অন্য পুলিশ সদস্যরা হলেন- বন্দরবাজার ফাঁড়ির কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাস।

প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন- এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেন।

তবে সাময়িক বরখাস্ত কিংবা প্রত্যাহার নয় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের দাবি ওঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এমন দাবির মুখেই এসআই আকবর পালিয়ে গেছেন বলে শোনা যাচ্ছে।

মঙ্গলবার সিলেট কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সৌমেন মিত্রও জানিয়েছেন, আকবরের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

তবে আকবরের পালিয়ে যাওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) জোর্তিময় মজুমদার।

এদিকে একের পর এক বিতর্ক জন্ম দেওয়ায় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণ ও হেফাজতে মৃত্যুর তদন্ত মহানগর পুলিশের কাছ থেকে সরিয়ে ভিন্ন কোনো সংস্থাকে প্রদানের দাবি জানিয়েছেন সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহীন। একই সঙ্গে রায়হান হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।
 
আর সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরীর দাবি, দুটি ঘটনারই বিচার বিভাগীয় তদন্তের।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত