নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ মার্চ, ২০২১ ০১:৫৪

দুর্দিনের বন্ধু, সুদিন দেখা হলো না

সে এক দিন গেছে মানুষের। ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। এটা ধরা-ওটা ছোঁয়ায় মানা। কাজকর্ম সব বন্ধ। সে বড় দুর্দিন। গত বছরের এই সময়টা দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে সারাদেশের মানুষ।

সচ্ছলরা তবু খেতে-পরতে পেরেছেন। গরীবের তো সে সাধ্যও নেই। ঘরে বসে বসে কতদিন আর চলতে পারেন তারা। তখন জনপ্রতিনিধিরাও নেই পাশে। অথচ সুখে-দুঃখে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েই জনপ্রতিধি হয়েছিলেন তারা।

সিলেট জেলায় সংসদীয় আসন ৬টি। ৬ আসনে সাংসদ আছেন ছয়জন। ৫ জনই তখন ঢাকায়। ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল একজন। করোনা সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ের প্রায় পুরোটা সময় নিজ সংসদীয় এলাকায় ছিলেন সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমদু উস সামাদ চৌধুরী।

কেবল এলাকায় ছিলেনই না, মানুষের সেই দুর্দিনে বাড়ি বাড়ি খাদ্যসামগ্রী নিয়ে গেছেন তিনি। বিনামূল্যে নিত্যপণ্যের দোকান বসিয়েছিলেন। যেখান থেকে টাকা ছাড়াই নিজের প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে যেতে পেরেছে মানুষ। করোনায় চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরা এবং দেশে টাকা পাঠাতে না পারা প্রবাসীদের পরিবারের পাশেও দাঁড়িয়েছিলেন এই সাংসদ।

এমন কর্মকান্ডের মাধ্যমে করোনারকালের মানবিক মুখ হয়ে ওঠেছিলেন মাহমুদু উস সামাদ চৌধুরী। করোনার সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এখন অতীত। দেশে করোনার টিকা এসেছে। এবার সুদিন ফেরার প্রত্যাশা। করোনামুক্ত পৃথিবীতে শ্বাস নেওয়ার অপেক্ষা। তবে সেই সুদিন আসার আগে নিজেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। বৃহস্পতিবার দুপরে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস। গত ৮ মার্চ তার করোনা শনাক্ত হয়।

সিলেট-৩ (ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা) আসনে টানা তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন কয়েস। ২০১৫ সালে জনপ্রিয় লেখক ও সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ‘চাবুক মারার’ হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি অডিও রেকর্ডে জাফর ইকবালকে ‘সিলেটবিদ্বেষী’ আখ্যা দিয়ে ‘কোর্ট পয়েন্টে এনে চাবুক মারার’ কথা বলতে শোনা যায়। এনিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন কয়েস। পরে ২০১৮ সালে নিজ ক্যাম্পাসে জাফর ইকবাল আক্রান্ত হওয়ার পর সাংসদ কয়েস দাবি করেছিলেন, ছড়িয়ে পড়া অডিও রেকর্ডটি তার নয়। জাফর ইকবালকে মারার কথা তিনি বলেননি।

এরআগে ২০০৯ সালে সংসদে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিল উত্থাপন করে আলোচনায় আসেন কয়েস। তবে সবকিছু ছাপিয়ে করোনাকালীন মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসিত হন তিনি। আর বৃহস্পতিবার চলে গেলেন সকল আলোচনা-সমালোচনার উর্ধে।

নিজ নির্বাচনী এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের ২২ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। তবে তার আগেই ঢাকা থেকে নিজ এলাকায় চলে আসেন কয়েস। এরপর সাধারণ ছুটির মোড়কে লকডাউন থাকাকালীন সময়ে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন মানবিক কর্মসূচীতে অংশ নিতে দেখা যায় এই সাংসদকে।

স্থানীয়রা জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর সাংসদ কয়েস প্রথমে নিজ এলাকার জনগণকে সচেতন করতে প্রচারাভিযান শুরু করেন। এসময় করনীয় নির্ধারণে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে একাধিক বৈঠক করেন। লকডাউন ঘোষণার পর বিপাকে পড়া মানুষদের জন্য খাদ্য সহায়তা প্রদান শুরু করেন। এছাড়া ধান কাটার মৌসুমে নিজ এলাকার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে ধান কাটতে মাঠে নামেন তিনি। গতবছর রমজান মাস শুরু হওয়ার পর অসহায় মানুষদের বাড়ি বাড়ি ইফতারসামগ্রীও পৌঁছে দিয়েছেন সাংসদ কয়েস।

করোনাকালে সাংসদ কয়েসের এই মানবিক কর্মকান্ড ব্যাপক প্রশংসিত হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও তার কার্যক্রম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

গতবছরের এপ্রিলে সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরের সাথে আলাপ হয়েছিলো মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েসের। সেসময় তিনি বলেছিলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন- যেভাবে ভোট চাইতে জনগণের দুয়ারে গিয়েছিলেন এখন সেভাবে খাবার নিয়ে জনগণের দুয়ারে যাচ্ছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ পালন করছি। সরকারি বরাদ্ধের পাশপাশি নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অর্ধকোটি টাকা সহায়তার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।

কয়েস বলেছিলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা যদি মাঠে নেমে কাজ করতে পারেন, আমরা জনপ্রতিনিধিরা কেন পারবো না? শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে এখন সকল জনপ্রতিনিধিকে মানুষের পাশে থাকা উচিত।

সেদিন আলাপচারিতায় কয়েস আরও জানিয়েছিলেন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় আমি দশম শ্রেণির ছাত্র আর তখনই স্কাউট সদস্য হিসেবে নোয়াখালীতে গিয়েছিলাম রিলিফ নিয়ে। সেই থেকে শুরু আর আজ পর্যন্ত সব দুর্যোগে রিলিফ কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই সরাসরি জড়িত থেকেছি।

দুর্দিনে পাশে থাকা মানুষটির আচমকা এই বিদায়ে শোকস্তব্দ তার নির্বাচনী এলাকার মানুষজন।

ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত আলী বলেন, করোনার দুঃসময়ে অনেক সাংসদ নির্বাচনী এলাকায় ছিলেন না। ব্যতিক্রম শুরু কয়েস। তিনি করোনার পুরোটা সময় এলাকায় অবস্থান করে মানুষকে সহায়তা করেছেন। তিনি ছিলেন আমাদের দুর্দিনের বন্ধু। আজ তিনিই করোনায় চলে গেলেন।

মরদেহ আসবে আজ : মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েসের মরদেহ আজ শুক্রবার (১২ মার্চ) সিলেট আসবে। শুক্রবার সকাল ১১টায় হেলিকপ্টারযোগে ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকায় তার নিজ বাড়িতে নিয়ে আসা হবে মরদেহ। এরপর বিকেল ৫টায় কাশেম আলী বিদ্যালয় মাঠে তার নামাজের জানাযা অনুষ্ঠিত হবে।

১৯৫৫ সালে জন্ম নেওয়া কয়েসের মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিলো ৬৫ বছর। তিনি স্ত্রী ও ১ ছেলে রেখে গেছেন।

কয়েস সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও শেখ রাসেল শিশু কিশোর পরিষদের মহাসচিবের দায়িত্বে ছিলেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত