শাকিলা ববি

২৩ এপ্রিল, ২০২১ ০১:২৫

সিলেটে বইপ্রেমীদের মিলনস্থল বাতিঘর

ছবি: বাতিঘর সিলেটের ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া

মানুষের মনের খোরাক ও জ্ঞান সাধনার মূল উপকরণই হল বই। বইয়ের আবাসস্থল হল গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি। একেকটি গ্রন্থাগারের তাকে-তাকে ঘুমিয়ে থাকে হাজার বছরের লিখিত-অলিখিত ইতিহাস। প্রাচীন শিলালিপি থেকে আধুনিক লিপির গ্রন্থিক স্থান হল গ্রন্থাগার। সিলেটেও রয়েছে বেশ কিছু সৃজনশীল বইয়ের গ্রন্থাগার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাতিঘর।

ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল থেকে সিলেটেও যাত্রা শুরু করেছে সৃজনশীল বইয়ের এ প্রতিষ্ঠানটি। সিলেট নগরের পূর্ব জিন্দাবাজার এলাকার গোল্ডেন সিটি কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় বিশাল জায়গাজুড়ে নিজেদের সিলেট শাখা চালু করেছে বাতিঘর।

সৃজনশীল বইয়ের সংগ্রহশালা বাতিঘরে প্রথমদিন থেকেই পাঠকরা ভিড় জমান। বইয়ের পাশাপাশি বাতিঘরের সাজসজ্জাও নজর কেড়েছে সিলেটের পাঠক ও দর্শনার্থীদের। সিলেট বাতিঘরে প্রবেশ করলে মনে হবে আপনি ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে না হয় সুরমা নদীপাড়ে স্থাপিত আলী আমজদের ঘড়িঘরের পাশে দাঁড়িয়ে বই পড়ছেন।  

সিলেটের দুটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা কিনব্রিজ ও আলী আমজদের ঘড়িঘরের আদলে সাজানো হয়েছে বাতিঘরের সিলেট শাখা। শুধু তাই নয়, চায়ের দেশ সিলেটের বাতিঘরের দেয়ালে করা হয়েছে চা-বাগানের আদলে। বাতিঘরে প্রবেশের সময় উপরে তাকালে দেখতে পারবেন শ্রীহট্টের ইতিহাস নামক বইয়ের কাভারের নকশা। তাই বই কেনার পাশাপাশি নান্দনিক সৌন্দর্য একনজর দেখতে, ছবি তুলতেও বাতিঘরে ভিড় জমান পাঠক ও দর্শনার্থীরা।

বাতিঘরের অভ্যন্তরীণ সজ্জা করেছেন শিল্পী শাহীনুর রহমান। আলোকসজ্জা করেছেন নাসিরুল হক খোকন ও জুনায়েদ ইউসুফ। বাতিঘরের এই নান্দনিক রূপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই শিল্পীদেরই প্রধান ভূমিকা রয়েছে বলে জানান বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ।

আজ ২৩ এপ্রিল, বিশ্ব গ্রন্থ ও গ্রন্থস্বত্ব দিবস। ১৯৮২ সালে ইউনেস্কো লন্ডনে আন্তর্জাতিক গ্রন্থ সম্মেলনের আয়োজন করে। এভাবেই ১৯৯৫ সাল থেকে ইউনেস্কো প্রতি বছর ২৩ এপ্রিলকে সবদেশে বিশ্ব গ্রন্থ ও গ্রন্থস্বত্ব দিবস পালন করার আহ্বান জানায়। ১৯৯৫ সালের এ দিনে উৎসাহ দিতে লেখক, প্রকাশক, পুস্তক বিক্রেতা ও গ্রন্থ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য দিবসটি উদযাপন করে ইউনেস্কো। ইউনেস্কোর উদ্দেশ্য ছিল শিশু-তরুণদের আনন্দময় গ্রন্থপাঠের মধ্য দিয়ে বিশ্বজগৎ আবিষ্কার করা। শুধু এটায় নয় তরুণ প্রজন্মকে মুক্ত বিশ্বের অংশীদার হয়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশের মাধ্যমে একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দেয়া।

সিলেট বাতিঘরের কর্মকর্তা লিংকন দাশ জানান, সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ক্রেতাদের জন্য খোলা থাকবে বাতিঘর। দেশি-বিদেশি লক্ষাধিক বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে এখানে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ১০ হাজার লেখকের নানা ধরনের বই পাওয়া যাবে এই প্রতিষ্ঠানে। ইতিহাস, আত্মজীবনী, জীবনী, প্রবন্ধ, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, শিল্পকলা, নাট্যতত্ত্ব, চলচ্চিত্র, ধর্ম, দর্শন, কথাসাহিত্য, অনুবাদ, কবিতা, শিশুসাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি, গবেষণাসহ নানা ধরনের বিষয়ের বইয়ের সমাহার রয়েছে বাতিঘরে। সিলেটি ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি কর্নার, ক্যাফে কর্নারসহ বেশ কিছু কর্নার রয়েছে। নির্বাচিত লেখক, শিশু–কিশোর কর্নার, প্রকাশনা সংস্থার কর্নারের পাশাপাশি এখানে সিলেটে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিষয়ের উপর একটি কর্নার আছে। রয়েছে একটি ক্যাফে কর্নারও।

বর্তমান করোনা মহামারির কারণে সারা দেশে চলছে লকডাউন। তাই এখন বন্ধ রয়েছে সিলেট বাতিঘর। তবে পাঠকদের সুবিধার জন্য বাতিঘরের অনলাইন সেবা চালু আছে।  

এ বিষয়ে লিংকন দাশ আরও জানান, লকডাউন চলাকালীন পাঠকদের জন্য খোলা রয়েছে বাতিঘরের অনলাইন সেবা। বাতিঘর প্রকাশিত বই অথবা অন্য যে কোনো দেশি-বিদেশি বই পেতে চাইলে বাতিঘরের ফেসবুক পেইজে ইনবক্স অথবা ০১৮৪২-৩০৪৩৪৪ এই নাম্বারে কল করে অথবা www.baatighar.com এই সাইট থেকে নিয়মিত অর্ডার নেওয়া হয়।

এছাড়াও বাতিঘরে রয়েছে স্বল্প আকারে বই পড়ার সুবিধা। গতানুগতিক গ্রন্থাগারে গিয়ে না পড়ে বই কেনার প্রথাকে ভেঙেছে বাতিঘর। যেকোনো পাঠক চাইলে বই পড়ে কিনে আনতে পারেন। বাতিঘরের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। তাছাড়া বাতিঘরে লেখকদের জন্যও রয়েছে বিশেষ সুবিধা। এখানে স্বল্প আকারে করা যায় বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান।

২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বাতিঘর সিলেট শাখায় বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আসেন দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখক বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। তখন বাতিঘর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল প্রখ্যাত এই কথাসাহিত্যিকের নতুন বই ‘অপরিচিত জীবনযাপন’। ওই বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গল্প আড্ডায় মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন এই কালজয়ী লেখক। ওইদিন সমরেশ মজুমদারকে দেখতে, তার সাথে কথা বলতে পাঠকদের উপচেপড়া ভিড় ছিল বাতিঘরে।

বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ বলেন, ‘আমরা নিজেরাও বইয়ের পাঠক। এমন অনেক সময় হয়েছে যে লাইব্রেরিতে বই খুঁজে পাইনি। পাঠক হিসেবে সেই বইয়ের খিদেটা আমার ছিল। সেই উপলব্ধি থেকে পাঠকের খিদা মেটাতে চেষ্টা করি বাতিঘরের মাধ্যমে। তাই বাতিঘরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল আমাদের কাছে ‘কোনো বই নেই বলি না’। একজন পাঠক একটি বই চাইলে সেটা দেশ বা বিদেশ যেখানেই থাকুক আমরা এনে দেওয়ার চেষ্টা করি।’   

তিনি বলেন, ‘পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা বাতিঘরের শাখা করি। সিলেটেও অনেক বইপ্রেমী আছেন। সিলেট বাতিঘরে বিভিন্ন লেখকের প্রায় ১ লক্ষ বই আছে।আদের একটি পাবলিকেশনও আছে। মানসম্মত পাণ্ডুলিপি পেলে আমরা বই প্রকাশের চেষ্টা করি।’  

দীপঙ্কর দাশ বলেন, ‘বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রায় সময়ই লকডাউন হয়। তাই পাঠকদের সুবিধার্থে গত বছর করোনা শুরুর পর থেকে অনলাইন সেবা চালু করেছি। এই অনলাইনেও ২০ হাজার বই এন্ট্রি করা আছে। আশা করছি শীঘ্রই বাতিঘরের পুরো বইয়ের কালেকশন অনলাইনে এন্ট্রি করা হবে।’  

বই বিপণনে নতুনত্ব এনে দেশজুড়ে পাঠকসমাজ গড়ে তোলার লক্ষের কথা জানিয়ে বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ বলেন,‘ আমরা যখন যে এলাকায় শাখা করি সে এলাকার স্থানীয়দের চাহিদা, সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে কাজ করি। সে চিন্তা ভাবনা থেকে সিলেটে কাজ করা হয়েছে। তাই সিলেট বাতিঘরের সাজসজ্জায় আমরা সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যকে স্থান দিয়েছি। এই সাজসজ্জা স্থানীয় পাটক ও দর্শনার্থীদেরও আকৃষ্ট করেছে বলে মনে করি। এবং এর পুরো কৃতিত্ব আমাদের শিল্পী শাহীনুর রহমানের। তার পরিকল্পনাতেই সিলেট বাতিঘরের সাজসজ্জা করা হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত