তাহিরপুর প্রতিনিধি

০৪ মে, ২০২১ ২২:২৩

বেকার সময় পার করছেন যাদুকাটা নদীতে কাজ করা শ্রমিকরা

এক সময়ের হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মমূখর যাদুকাটা নদীর চারপাশে এখন সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। ঘাটে বাধা শত শত নৌকা। কাজ না থাকায় বেকার সময় পার করছে হাজার হাজার শ্রমিকরা। শুধু শ্রমিকরাই নয় হাওরাঞ্চেলের নিম্নআয়ের মানুষের কাজ না পাওয়ায় পরিবারগুলোতে খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে। এদিকে পরিবেশের বিপর্যয়ের কারণে সরকারি নিষেধাজ্ঞার ফলে কাজ হারিয়ে বসে আছেন যাদুকাটা নদীর এসব শ্রমজীবী মানুষ।

যাদুকাটার উপর নির্ভরশীল হাজার হাজার শ্রমিকের কাজ বন্ধ থাকায় এর প্রভাব পরেছে উপজেলার বিভিন্ন বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। যাদুকাটা নদী চালু থাকলে ঐসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেচা কেনা বেড়ে যায় আর টমটম, রিকশাসহ বিভিন্ন পরিবহন শ্রমিকদের জীবিকা নির্বাহ করতে সুবিধা হত। এখন সব কিছুতেই ভাটা পড়েছে। এবার ঈদের বেচাকেনাও নেই বলে জানায় বিভিন্ন ব্যবসায়ীগন।

সরজমিনে যাদুকাটা নদী ও তার চারপাশের গ্রাম ও উপজেলার বিভিন্ন বাজারগুলোতে শুধুই নীরবতার চিত্র দেখা যায়।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের উত্তর দিকের ভারতের মেঘালয় পাহাড় সংলগ্ন সীমান্তবর্তী নদী যাদুকাটা।

জানা যায়, যাদুকাটা নদীকে কেন্দ্র করে ১০-১৫ গ্রামের মানুষজনের জীবন জীবিকা চলে। নদীর বুক থেকে বালু আর পাথর তুলে বিক্রি করেই বছরের পর বছর ধরে সংসার চালাচ্ছেন বালু-পাথর শ্রমিকরা। একদিকে ইজারা জটিলতা ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে কাজ বন্ধ। অন্যদিকে যুক্ত হয়ে মহামারি করোনাভাইরাস।

গেল বছর থেকেই করোনাভাইরাসের কারণে দফায় দফায় লকডাউন আর নানাবিধ বিধিনিষেধের কারণে হাওর পাড়ের নি¤œআয়ের লোকজন নানামুখী সংকটে আছের। যাদুকাটার শ্রমিক ও ব্যবসায়িক সমিতিগুলো নদীতে কাজের দাবিতে মানববন্ধন,শ্রমিক সমাবেশ করে যাচ্ছে। কিন্তু এর সুফল পাচ্ছে না। কর্মহীন এসব শ্রমিকদের কেউ কেউ আবার কাজের সন্ধানে শহরমুখী হতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি তাদের এই জীবিকা নির্বাহের থেও বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাদাঘাট বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী এনামুল জানান, গত বছরের মার্চ মাস থেকে যাদুকাটা নদীতে বালু ও পাথর উত্তোলনের কাজ বন্ধ থাকায় বেচাকেনা নেই বললেই চলে। যাদুকাটা নদী কেন্দ্রিক আমাদের সকল ব্যবসায়ীদের ব্যবসা। কারণ আমাদের সকল ক্রেতা হল শ্রমিক। আর করোনায়তো আরও শেষ করে দিয়েছে। নদী চালু থাকলে কিছুটা বাঁচার উপায় থাকত। এখন লাভের বদলে ক্ষতির মুখে আছি।

সোহাগ বস্ত্র বিতানের মালিক সোহাগ মিয়া জানান, একেতো করোনা এর মধ্যে যাদুকাটা নদী বন্ধ, ফলে আমাদের বেচাকেনা নেই বললেই চলে। লাখ লাখ টাকা ব্যবসায় লগ্নি করে এখন গত এক বছর ধরেই ক্ষতির শিকার হয়েছি। আর কিছু দিন পর ঈদ কিন্তু বেচাকেনা নেই কারণ শ্রমিকদের হাতে টাকা নেই। নদী থেকে বালু উত্তোলনের কাজ চললে আমাদের বেচাকেনাও বাড়বে। না হলে সব শেষ।

যাদুকাটা নদীর শ্রমিক আমিনুল ইসলামসহ অনেকেই জানান, হাওরঞ্চলের শ্রমিকদের এখন বেঁচে থাকার জন্য অন্তত একটা কাজ দরকার। কাজ ছাড়া মিলবে না মজুরি। কাজ পেলে মজুরি পাবো তারপর জ্বলবে রান্না ঘরের চুলা। নদীতে কাজ না থাকায় এবার হাওরে ধান কেটেছি। এতেতো আর চলবে না। তবে বছরের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খেতে পারবেন ঘরের চাল। এতে কিছুটা স্বস্তি মিলছে। কিন্তু বাকী সময় কি ভাবে চলবে। সেজন্য বছরজুড়ে কাজ চাই।

তাহিরপুর সদর ইউনিয়নের মধ্য তাহিরপুর গ্রামের ঢাকা ফেরত শ্রমিক করিম মিয়া জানান,এলাকায় কাজ না থাকায় রাজধানীতে জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে সংকটে পড়েছি করোনার কারণে। ধান কাটা শুরু হওয়া মাত্র এলাকায় ফিরে ধান কাটার কাজে লেগে পড়েছি। এখন বাড়িতে আইছি কয়দিন ধান কাটমু। এলাকায় স্থায়ী কাজের ব্যবস্থা হলে খুবেই ভাল হত।

যাত্রী পরিবহনের কাজের মোটরসাইকেল চালক হানান মিয়াসহ অনেকেই জানান, নদী বন্ধের কারণে শ্রমিকদের কাজ নেই। ফলে আমরাও দিনের বেশির ভাগ সময়ই বসে সময় পার করি। নদী চালু হলে উর্পাজন বেড়ে যায়। আর করোনায় লকডাউন দিলে গাড়ি নিয়ে চলাচল করা যায় না। আমরা চলব কি ভাবে।

যাদুকাটা বালু-পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সমবায় সমিতির সাধারণ হাকিকুল মিয়া জানান, করোনা পরিস্থিতিতে যাদুকাটা নদীতে দু-হাজারের অধিক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কাজ না থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে সহায়তা পাই না।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদ্মাসন সিংহ জানান, যাদুকাটা নদীতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকরা হাওরে ধান কাটার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও অন্যান্য জটিলতার নিরসন না হওয়া অবধি যাদুকাটা নদীতে কোন কাজ করা যাবে না। শ্রমিকদের সরকারী সহায়তা অব্যাহত আছে।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করোনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, হাওরাঞ্চলের মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের বিকল্প পথ তৈরি করতে হবে। না হলে এই এলাকার মানুষের নিত্য জীবনের অভাব-অনটনের কোনো পরিবর্তন হবে না। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে যাতে এসব এলাকার মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত