নিজস্ব প্রতিবেদক

০৫ মে, ২০২১ ১২:৩৩

যেভাবে প্রকাশিত হয় পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হানকে হত্যার ঘটনা

প্রায় সাত মাস পর রায়হান আহমদ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করা হয়েছে। বুধবার সকালে ৬ জনকে অভিযুক্ত করে এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করবে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

অভিযোগপত্রে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ পুলিশের বরখাস্তকৃত উপ পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া আরও ৪ পুলিশ সদস্য ও এক তথাকথিত সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

রায়হানকে হত্যার দায়ে আজ ৫ পুলিশকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও প্রথমে এই ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিতের চেষ্টা করা হয়েছিলো। ছিনতাইকালে রায়হান গণপিটুনিতে মারা যান বলে প্রথমে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।

রায়হান হত্যা: নগরের আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কাষ্টঘর সুইপার কলোনি থেকে তাকে ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যান এই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ও তার সহকারীরা। এরপর কয়েক ঘণ্টা চলে নির্যাতন। শেষ রাতে এক পুলিশ সদস্যের মোবাইল থেকে নিজের চাচাকে ফোন করে রায়হান। এসময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্রুত ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসার জন্য চাচাকে অনুরোধ করে। ভোরে ফজরের নামাজের পূর্ব মূহূর্তে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে হাজির হন চাচা। তবে তখন তাকে রায়হানের সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এরপর ১১ অক্টোবর সকালে আবার চাচা ফাঁড়িতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়হানকে ওসমানী হাসপাতপালে পাঠানো হয়েছে। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে রায়হানের মরদেহ দেখতে পায় পরিবার।

ভিন্নখাতে প্রবাহিতের চেষ্টা: রায়হানের মৃত্যু জানাজানি হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, কাষ্টঘর এলাকায় ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন রায়হান। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেছে। বন্দুর বাজার ফাঁড়ির কর্মকর্তা ও সিলেট মহানগর পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সকাল থেকে গণমাধ্যমে এমন খবরও প্রকাশ হয়।

এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া

পরিবার ও এলাকাবাসীর বিক্ষোভ : নগরীতে গণপিটুনিতে ছিনতাইকারীর মৃত্যু- বিভিন্ন গণমাধ্যমে যখন এমন খবর প্রকাশ হচ্ছিলো, তখন ভিন্ন তথ্য নিয়ে সামনে আসে নিহত যুবক রায়হান আহমদের পরিবার ও আখালিয়া এলাকাবাসী।
রায়হানের বাসার সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে তারা জানান, ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে টাকার জন্য নির্যাতন চালিয়ে রায়হানকে হত্যা করেছে পুলিশ।

পরিবারের এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ হয়। এতে পর নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। আর পরিবার ও এলাকাবাসীর মাধ্যমে শুরু হওয়া রায়হান হত্যার বিচার দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো সিলেটজুড়ে।

পুলিশের উদ্যোগ: ফাঁড়িতে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠার পর মহানগর পুলিশের পক্ষে থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় বন্দরবাজার ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভ’ইয়াসহ ৪ পুলিশ সদস্যকে ১২ অক্টোবর সাময়িক বহিস্কার করা হয়। এরআগে ১১ অক্টাবর রাতেই হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। এরপর আরও চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়।

তদন্তে পিবিআই, আকবর পলাতক: পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠার পর কতোয়ালি থানা থেকে এই মামলা তদন্তের ভার দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)কে। তদন্তের দায়িত্ব পেয়েই তারা রায়হানের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে পুণরায় ময়না তদন্তের উদ্যোগ নেয়। দুই ময়না তদন্ত রিপোর্টেই রায়হানের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।

এরপর পিবিআই বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করে  বন্দরবাজার ফাঁড়ির কর্মকর্তা এসআই হাসান আলী, এএসআই আশেকে এলাহী, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, কনস্টেবল তৌহিদ মিয়া ও কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস। এদের সকলকেই আগে বহিস্কার করে সিলেট মহানগর পুলিশ।

এদিকে, সাময়িক বহিস্কার হওয়ার পর পুলিশ, লাইনে সংযুক্ত থাকা অবস্থায় পালিয়ে যান বন্দরবাজার ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই (বহিস্কৃত) আকবর হোসেন ভূঁইয়া। তিনি ভারতের মেঘালয়ে পালিয়ে যান বলে অভিযোগ ওঠে।

আকবর গ্রেপ্তার: নানা সমালোচনা ও তীব্র আন্দোলনের মুখে গতবছরের ৯ নভেম্বর কানাইঘাট সীমান্ত থেকে আকবরকে গ্রেপ্তার করে সিলেট জেলা পুলিশ। ভারতে পালানোর সময় সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে আটক করে বলে সেসময় জানিয়েছিলেন সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন।

তবে আরেকটি সূত্র জানায়, ভারতের সীমান্তের ভেতরে স্থানীয় খাসিয়ারা আকবরকে আটক করে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে এসে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। আকবরকে কানাইঘাট সীমান্তের ওপারে ভারতের একটি খাসিয়া পল্লীতে আটকের একটি ভিডিও ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে।

আকবরকে গ্রেপ্তারের পরদিন ১০ নভেম্বর তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয় পিবিআই। এরআগে এই ঘটনায় গ্রেপ্তার অন্য পুলিশ সদস্যদেরও রিমান্ডে নেওয়া হয়। তবে রিমান্ড শেষে তারা কেউই আদালতে স্বীকারোক্তিমলক জবানবন্দি দেননি।

সিলেটজুড়ে তীব্র আন্দোলন: পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যার পর এই ঘটনার বিচার দাবিতে সিলেটজুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। রাস্তায় নেমে আসে সবশ্রেণীর মানুষ। আকবর পালিয়ে যাওয়ার পর এ আন্দোলন আরও তীব্র হয়। পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আকবর পালিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এতে তীব্র ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়ে সিলেট মহানগর পুলিশ। ছেলে হত্যার বিচার দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন রায়হানের মা সালমা বেগম। আমরণ অনশনেও বসেন এই গৃহবধূ।  এসব আন্দোলনে সামনে থেকে  সমালোচনার মুখে সিলেট মহানগর পুলিশের তৎকালীন কমিশনার গোলাম কিবরিয়াকেও বদলি করা হয়।

অবশেষে অভিযোগপত্র: মামলার তদন্তকাজে দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ে পিবিআই। আদারত থেকেও রায়হান হত্যা মামলার অভিযোগপত্র ৩০ জানুয়ারির মধ্যে প্রদানের দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এই সময়ে তদন্ত শেষ না হওয়ায় পিবিআই’র আবেদনের প্যেক্ষিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ৩০ কার্যদিবস সময় বৃদ্ধি করে। তবে করোনার অজুহাতে এই সময়ের মধ্যেও অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়নি।

আকবর ও নোমান

তদন্তকারী সংস্থাটির পক্ষ থেকে একাধিকবার অভিযোগপত্র প্রদানের ঘোষণা দিয়েও পরে পিছিয়ে যায়। এনিয়ে ক্ষোভ দেখা দেয় রায়হানের পরিবারে। অবশেষে হত্যাকান্ডের প্রায় সাত মাস পর আজ এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করা হয়।  

আকবর ছাড়া অভিযোগপত্রে অন্য অভিযুক্তরা হলেন, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত সহকারী উপ পরিদর্শক (এএসআই) আশেকে এলাহি, হাসান উদ্দিন, পুলিশের কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, টিটু চন্দ্র দাস এবং কথিত সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান। নোমানের বিরুদ্ধে এসআই আকবরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা ও রায়হানকে নির্যাতনের আলামত ধংসের অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান।

তিনি জানান, অভিযোগপত্রভূক্ত ৬ জনের মধ্যে ৫ পুলিশ সদস্যই কারাগারে আছেন আর নোমান পলাতক রয়েছেন। এই ঘটনায় তৌহিদ মিয়া নামে আরেক পুলিশ কনস্টেবলকে গ্রেপ্তার করা হলেও সম্পৃক্ততা পাওয়া না যাওয়ায় তাকে অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত করা হয়নি বলে জানান এসপি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত