রিপন দে, মৌলভীবাজার

০৭ জানুয়ারি, ২০২২ ২১:১৫

পর্যটন বদলে দিয়েছে রাধানগর

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে এক সময়ের অজপাড়াগাঁ রাধানগর সারা দেশে পরিচিত হয়ে উঠেছে। দেশের বাইরে থেকেও পর্যটকরা আসেন এখানে।

পাখির চোখে দেখলে এ গ্রামটিকে মনে হবে এক শ্যামল সং­রক্ষিত বনভূমি। গ্রামের বাঁকে-বাঁকে গড়ে উঠেছে আধুনিক রিসোর্ট ও কটেজ।

একটি মাত্র গ্রামে এখন পাঁচতারা রিসোর্টসহ ২৫টি রিসোর্ট ও কটেজ। পরিকল্পনায় এবং নির্মাণের অপেক্ষায় আরও ২৫টি। দেশের বিভিন্ন একালার মানুষ ব্যবসা করছেন এখানে। কেউ রিসোর্ট দিয়েছেন, কেউ রেস্তোরাঁ, আবার কেউবা পরিবহনের কাজ করছেন।

দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকে এই গ্রাম। প্রতিদিন অন্তত ৫০০ পর্যটক এই গ্রামের হোটেল-রিসোর্ট-কটেজে বসবাস করেন।

পাঁচতারা হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান দিয়ে শুরু এই গ্রামের সামনের অংশ। যতই এগিয়ে যাওয়া যায়, চোখে পড়ে একের পর এক রিসোর্ট, হোটেল ও ইকো-কটেজ। শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে আসা পর্যটকদের বড় একটি অংশ থাকার জন্য এই গ্রামকেই বেছে নেন।

শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে আসা পর্যটকরা নিভৃতি খুঁজতে রাধানগর গ্রামকেই পছন্দ করছেন।

পর্যটনের ছোঁয়ায় বদলে গেছে এই গ্রাম। সারা রাত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসব পর্যটক আসেন। ফলে সারা রাত জেগে থাকে এই গ্রাম। প্রায় ৫০টির মতো খাবার হোটেলসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান গড়ে উঠেছে গ্রামে। আরও ২৫টি রিসোর্ট তৈরি হচ্ছে। কেউ জায়গা কিনে রেখেছেন, কেউ নির্মাণকাজ শুরু করেছেন।

পর্যটনকেন্দ্রিক নানা ব্যবসায় এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে সহস্রাধিক মানুষের। ১০ বছরে জায়গার দাম বেড়েছে ৫০ গুণ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্যুরিজম ব্যবসায়ীরা এই গ্রামে এসে বিনিয়োগ করছেন।

রাধানগর গ্রাম ঘুরে পাওয়া গেল শামছুল হক নামের এক পর্যটন ব্যবসায়ীকে, যিনি এই গ্রামে প্রথম ইকো-কটেজ গড়ে তোলেন ১৪ বছর আগে। তিনি এখন শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সাধারণ সম্পাদক।

শামছুল হক জানান, এক সময় মুদি দোকানের পাশাপাশি লেবুবাগান গড়ে তুলেছিলেন তিনি। দিনে দিনে শ্রীমঙ্গল পর্যটনে সমৃদ্ধ হতে থাকায় তিনি বুঝতে পারেন, এই খাতে ব্যবসা হতে পারে লাভজনক। তাই পরীক্ষামূলকভাবে ২০০৭ সালে লেবুবাগানের ভেতরে এক রুমের একটি ইকো-কটেজ করেন।

ভাবনার চেয়েও বেশি সাড়া পাওয়ায় পরে তিনটি কটেজ গড়ে তোলেন তিনি। ২০১৮ সালে এই কটেজের সামান্য দূরে ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আরেকজনের সঙ্গে মিলে নির্মাণ করেন আরও ৫টি কটেজ।

গাড়িচালক, ট্যুর গাইডসহ অন্তত ২০০ মানুষের জীবিকার উৎস তার এখন এই কটেজগুলো।

পর্যটন বদলে দিয়েছে রাসেল আলমের জীবন। তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি গৃহশিক্ষক হিসেবে পথচলা শুরু করেন। ২০০৫ সালে তিনিও আকৃষ্ট হন ইকোট্যুরিজমের প্রতি। প্রশিক্ষণ নিয়ে ট্যুর গাইড হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন রাসেল। কিছুদিনের মধ্যে তার আয় বাড়ে কয়েক গুণ।

বর্তমানে পর্যটনের মৌসুমে মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করছেন রাসেল। তিনি জানান, তার আশপাশে এমন অন্তত ১৫ জন গাইড আছেন, যাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে ট্যুরিজম।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই গ্রামে প্রতিদিন কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। পর্যটন খাতে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ ২০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। চা-শিল্পের পর পর্যটন খাতকেই এই অঞ্চলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিনিয়োগ যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে এই এলাকার জায়গার দাম।

বালিশিরা রিসোর্টের বিপণন উপদেষ্টা জাহানারা আকতার বলেন, ‘রাধানগর পর্যটকদের কাছে খুবই পরিচিত নাম। এখানে পর্যটনবান্ধব ব্যবসার সাফল্য দেখে আমরা ২০১৮ সালে কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। কোভিডের কারণে শুরুতে সমস্যা হলেও এখন পর্যটকরা আসছেন। অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে আমাদের বিনিয়োগের লক্ষ্যে সফল হতে কোনো সমস্যা হবে না।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য বিশ্বজিৎ দেববর্মা জানান, ১০ থেকে ১৫ বছর আগে এখানে জায়গার দাম ছিল ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা শতক। এখন শতক ৫ থেকে ৬ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

‘এসকেডি আমার বাড়ি’ নামের একটি রিসোর্টের পরিচালক সজল দাস জানান, কয়েক বছর আগে তিনি এখানে ব্যাংক লোন নিয়ে ২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন। ভালোই সাড়া পাচ্ছি। করোনার কারণে শুরুতে কিছুটা ক্ষতি হলেও স্বাভাবিক সময়ে এখানে পর্যটকদের অভাব নেই। শুক্র-শনিবার অনেক রিসোর্টের রুম এক মাস আগেই বুক হয়ে যায়।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় এই গ্রামে জনপ্রিয় ছিল আখচাষ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে আখ ব্যবসায়ী এবং এর সঙ্গে সংশিষ্ট শ্রমিকরা এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। ধীরে ধীরে লেবু চাষ এবং কাঁঠাল বাগান জনপ্রিয় হতে থাকে। এখনও এই এলাকায় লেবুবাগানের অস্তিত্ব চোখে পড়ে, রয়েছে কাঁঠালবাগানও।

২০১০ সাল থেকে এখানে পর্যটন ব্যবসা জনপ্রিয় হতে থাকে। ২০১৫ সালে তা বেগবান হয়। বর্তমানে প্রতিনিয়ত নতুন ব্যবসা তৈরি হচ্ছে পর্যটকদের মাথায় রেখে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন দেশি-বিদেশি খাবার হোটেল, হস্তশিল্পের দোকান, চা-পাতার দোকান।

শ্রীমঙ্গলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, পর্যটন বিকাশে এবং গ্রামীণ উৎপাদনশীল খাতগুলোকে পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে সরকার ‘গ্রামীণ উন্নয়নে পর্যটন’ ধারণা নিয়ে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে পর্যটন একটি গ্রামের আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা কীভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাধানগর।

এই গ্রামটি ইকো-ট্যুরিজমের ক্ষেত্রেও একটি দৃষ্টান্ত। দিন-রাত এখানে পর্যটকরা নিরাপদে চলতে পারেন। এই গ্রামকে কেন্দ্র করে যে পর্যটন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তার অর্থনৈতিক সুফল শ্রীমঙ্গল শহরসহ আশপাশের সব এলাকা পাচ্ছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত