নিজস্ব প্রতিবেদক:

০৮ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:১৩

এবারও সিলেটের ৪৪ ইউপিতে ডুবল নৌকা

সিলেট বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনেও ধরাশায়ী হয়েছে নৌকা। অধিকাংশ ইউনিয়নেই বিদ্রোহী আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। গত বুধবার এই বিভাগে ৭৫টি ইউপিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে দুই ইউপির ফলাফল নির্ধারিত হয়নি। অন্যগুলোর মধ্যে ৪৪টিতেই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।

চার জেলায় আওয়ামী লীগের ১৭ জন নেতাকর্মী ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএনপির ১৫ জন, জামায়াতের ৪ জন ও জাতীয় পার্টির ১ জন, জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের ২ জন প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। আর নির্দলীয় ৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী এবার জয় পেয়েছেন। বিপরীতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জয় পেয়েছেন ২৯ ইউপিতে।

আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের নেতিবাচক ফলাফলের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা– বলেন, নৌকা প্রতীকে ভালো প্রার্থী দিতে না পারায় এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিভিন্ন ইউনিয়নে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এসব কারণে বেশির ভাগ ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পরাজয় হয়েছে। এছাড়া নেতাদের অনেকে গোপনে দলীয় প্রার্থীদের বিপক্ষেও কাজ করেছেন।

কোথাও স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও নৌকার বিরোধীতা করা এবং বিদ্রোহীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এই ভরাডুবির কারণে সাধারণ নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। আগামী সংসদ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করছেন নেতাকর্মীরা।

সিলেটে এবারও পিছিয়ে নৌকা

চতুর্থ ধাপেও সিলেটে কোনঠাসা হয়েছিলেন নৌকার প্রার্থীরা। পঞ্চম ধাপে জেলার ১৬ ইউনিয়নের ১০টিতেই হেরেছেন নৌকার প্রার্থীরা। এই ১০টির মধ্যে ২টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও ২টিতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া স্বতন্ত্রের ব্যানারে ৩টিতে জামায়াত, ২টিতে বিএনপি এবং একটিতে জাতীয় পার্টির এক নেতা জয় পেয়েছেন।

জকিগঞ্জের কাজলসার ইউনিয়নের একটি কেন্দ্রের বাইরে নৌকা প্রতীকে সিল দেওয়া ব্যালটসহ দুই রিটার্নিং কর্মকর্তা আটক হন। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যালট পেপার কম দেওয়া ও নিজেরা সিল দিয়ে ব্যালেট পেপার বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগে জকিগঞ্জের কাজলসার ইউনিয়নের সবকটি কেন্দ্র ও পাশ্ববর্তী একটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। ফল ঘোষণা হওয়া বাকি ১৬ ইউনিয়নের মধ্যে ৬টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।

জকিগঞ্জের ৭ ইউনিয়নের ৪টিতে আওয়ামী লীগ, একটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, একটিতে জামায়াত এবং একটিতে জাতীয় পার্টির নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয় পেয়েছেন।

কানাইঘাটের ৯ ইউনিয়নের মধ্যে ২টিতে আওয়ামী লীগ, ১টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, ২টিতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ২টিতে জামায়াত এবং ২টিতে বিএনপি নেতা বিজয়ী হয়েছেন।

সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘মনোনয়নের জন্য তৃণমূলের ভোটে যে পাশ করে এসেছে, তার নাম আমরা তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করে ঢাকায় পাঠিয়েছি। সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের যাচাই বাছাই করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট নিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যারা ফেল করেছেন নিশ্চই এলাকায় তাদের কোনো সমস্যা ছিল। এখানে স্থানীয় নির্বাচনে প্রধান হচ্ছে প্রার্থীর ব্যক্তিগত ইমেজ, এরপর নিজের অস্তিত্ব, দলের অস্তিত্ব। দল এখানে তাকে তিন নম্বরে। মানুষে ভোট দেয় ব্যক্তি দেখে। এছাড়া গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, এলাকা, আঞ্চলিকতা প্রাধান্য পায়।’

দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অনেক নেতার কাজ করার অভিযোগের বিষয়ে শফিকুর রহমান বলেন, ‘এরকম কিছু নেই। এখানে সংগঠনের কোনো দুর্বলতা নেই। কোনো কোন্দল ছিল না।’

এবারও সুনামগঞ্জে ফল খারাপ

সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা, জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলার ১৮টি ইউপিতে নির্বাচন হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয় পেয়েছে ৭ ইউপিতে। দলের ৫ জন বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এখানে বিএনপির ২ জন প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে জয়ী হয়েছেন। এর বাইরে আরও ৪ জন নির্দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয় পেয়েছেন।

সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন, ‘নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগে-আওয়ামী লীগে। জামায়াত-বিএনপি পাইছে একটা দুইটা। তবে মূল হচ্ছে নৌকার পরাজায়। এখানে যেটা হয়েছে (স্থানীয় রাজনীতে) এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের মনেরমতো প্রার্থী না হলে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করাই দেন। এছাড়া আগে যারা বিদ্রোহী ছিলেন, তারাতো আর মনোনয়ন পাননি। তাদের আর উপায়ও নাই। তাই অনেকে বিদ্রোহী হয়েছেন।’

‘‘বড় সমস্যা হচ্ছে পাওয়ারের সাথে রাজনীতির সমন্বয়ে গ্যাপ। যারা পাওয়ার নিয়ে আছেন- বিশেষ করে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান। তাদের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকেই। শাল্লায় উপজেলা চেয়ারম্যান ও সাংসদের প্রভাবে এখানে উনাদের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল।’’

ইমন বলেন, ‘আমি যেখানে নিজে গিয়েছি সেখানে নৌকা পাশ করেছে। সব জায়গায় তো আওয়ামী লীগের সেক্রেটারির যাওয়া সম্ভব না। চেষ্টা করেছি ১৮টির মধ্যে ১১ থেকে ১২টিতে যেতে। কোনো কোনো ইউনিয়নে অল্প ভোটে হরেছে। তাও বিদ্রোহীর সাথে। এমপির প্রার্থীর সাথে।’

‘‘এমপির নিজের বাড়ির কেন্দ্রে ৫৩ বা ৫৭ ভোট পাইছে নৌকা। এসব ক্ষেত্রে একজন সংসদ সদস্য যদি নৌকার বিরোধীতা করেন নৌকা জিতবে কিভাবে। ধর্মপাশা, মধ্যনগর, জামালগঞ্জে এমপি সাহেবের প্রত্যেক ইউনিয়নে একটা করে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল। একজন এমপি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দেওয়ার পর প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়ন বোর্ড অযোগ্যদের মনোনয়ন দিয়েছেন’। এরকম কথা বললে নেতাকর্মীরা তো বিভক্ত হবে।’’

হবিগঞ্জে নৌকার ফল বিপর্যয়

চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলার ২১টি ইউপিতে নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি ইউপিতে জয় পেয়েছে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বিএনপির নেতা-কর্মীরা। মাত্র ৬টিতে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। বিদ্রোহী ৬ জন নেতা-কর্মী জয়ী হয়েছেন। এর বাইরে জামায়াতের ১ জন এবং নির্দলীয় আরেকজন প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে বিজয়ী হন।

চুনারুঘাট উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৪টি, বিএনপি ২টি, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ৩টি ও একটিতে জামায়াত সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। জেলার মাধবপুর উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেছে, মাত্র ২টি ইউনিয়নে নৌকা মনোনীত প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। বাকি ৯টি ইউনিয়নে দলীয় কোন্দল ও বিদ্রোহী প্রার্থীর দৌরাত্ম্যে নৌকার বিপর্যয় হয়েছে।

ফল বিপর্যয়ের বিষয়ে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘বিদ্রোহী প্রার্থীই মূল কারণ। বিদ্রোহীদের বহিষ্কার করেছিলাম। এখানে একাধিক বিদ্রোহী হয়েছেন। নৌকার একজনের সাথে দুজন বিদ্রোহী, কোথাও তিনজন। তাহলে ভোট ভাগ হয়ে গেল না।’

তবে দলের কোন্দল ও নৌকার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোথাও কোথাও নেতাকর্মীদের গোপনে কাজ করার বিষয়ে বলেন, ‘প্রচারণায় গিয়েছি বেশিরভাগ ইউপিতে। কোন্দোল ছিল না। বিদ্রোহীই মূলক কারণ। তাছাড়া গোষ্ঠী, অঞ্চল, এলাকার প্রভাব পড়েছে।’

অন্যদিকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের ১৮টি ইউপিতে নির্বাচন হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ১০টি ইউপিতে জয় পেয়েছেন। এ ছাড়া দলটির আরও ৪ জন বিদ্রোহী জয় পেয়েছেন। এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিএনপির ৪ জন জয়ী হয়েছেন। শ্রীমঙ্গলে নৌকার প্রার্থীরা তুলনামূলক ভালো ফল করলেও কমলগঞ্জে তেমনটি হয়নি। শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ৯ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ৬টি, আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী একটি ও ২টিতে বিএনপি স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। কমলগঞ্জ উপজেলায় ৯টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ৪টিতে আওয়ামী লীগ, ২টিতে বিদ্রোহী ও ৩টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।

মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিছবাহুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিদ্রোহীদের বসাতে চেষ্টা করেছি। তারপরও যারা প্রার্থী ছিলেন তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে দল থেকে। দলের মধ্যে বিদ্রোহী থাকায় ভোট ভাগ হয়েছে। তবে বেশিরভাগই তো এসেছে নৌকা আর আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী। ৬৭ ইউনিয়নের মাঝে ১০ থেকে ১২টা পাশ করেছে বিএনপি। আর সব আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী। এরমধ্যে ৫০ ভাগ নৌকা, ৪৫ ভাগ বিদ্রোহী, ৫ ভাগ অন্যান্য দল।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত