ইয়াকুব শাহরিয়ার, শান্তিগঞ্জ (সুনামগঞ্জ):

১৮ মে, ২০২২ ০০:০৭

টানা বৃষ্টিতে শুকায়নি ধান, গজিয়েছে চারা: বিপাকে কৃষক

শিরিশ চন্দ্র দাশ। শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের নগর গ্রামের কৃষক তিনি। বন্যার শঙ্কা মাথায় নিয়ে দেড় দুইশ মন ধান তুলেছেন তিনি৷ বন্যার শঙ্কা কাটলেও দুঃশ্চিন্তা কাটেনি তার। সবগুলো ধান এখনো রয়ে গেছে স্যাঁতস্যাঁতে। শুকাতেই পারেননি। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পর থেকেই টানা বৃষ্টি। গুলিতে (মাড়াই করা ধানের স্তুপ) থাকতে থাকতে প্রায় সব ধানেই গজিয়েছে চারা। এভাবে আর দুচারদিন চললে পুরোপুরিই নষ্ট হয়ে যাবে তার সকল ধান। এ নিয়ে কোনো ভাবেই চিন্তা কাটছে না এ কৃষকের।

শিরিশ চন্দ্র দাশের ভাতিজা রিকন চন্দ্র দাশ বলেন, ধান পাঁকার আগে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার একটা শঙ্কা ছিলো। দুঃশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে অনেক কষ্টেসৃষ্টে ধান কেটে মাড়াই দেওয়ার পর থেকেই লাগাতার বৃষ্টি। গুলির সব ধানেই এখন চারা গজিয়েছে। এরকর আর দু’চারদিন চলতে থাকলে আমাদের যা ধান আছে তা তো নষ্ট হবেই, সেই সাথে সব কৃষকেরই শত শত মন ধান নষ্ট হবে।

এ তো শুধু একজন শিরিশ চন্দ্র দাশ কিংবা রিকন চন্দ্র দাশের আক্ষেপ আর দুঃশ্চিন্তার গল্প। এমন দুঃশ্চিন্তা আর দুঃখ মাখা গল্প এখনশান্তিগঞ্জ উপজেলাসহ জেলার শত শত কৃষকের। ঘুর্ণিঝড় ‘অশনি’র প্রভাবে গত সপ্তাহ থেকে টানা বৃষ্টিপাত ও বৈরি আবহাওয়ার কারণে জমি থেকে কেটে তুলা ধান শুকিয়ে ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষকরা। শুকানোর জন্য ধানের খলায় যেসব ধান স্তুপ (গুলি) করে রাখা হয়েছে তা কোনো ভাবেই শুকানো যাচ্ছে না। ফলে, দীর্ঘদিন ভেজা অবস্থায় ঢাকা থাকার কারণে গুলির ধানে গজাচ্ছে ধানের চারা। এতে পুরোপুরিভাবে সব ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকেরা। তবে, কোনো কোনো কৃষকেরা আপাতত কষ্টের ধানকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে প্রাচীন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। ধানকে ভিজিয়ে রাখছেন পানিতে। কেউ কেউ টিনের শেড কিংবা পাঁকা ঘরের মেঝেতে পালা করে শুকানোর চেষ্টা করছেন সোনার ফসল।

সাম্প্রতিক এ সমস্যা নিয়ে শান্তিগঞ্জ ও জামালগঞ্জ উপজেলার একাধিক কৃষকের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, এ ধানেই কৃষকের সারা বছরের সুখ আর দুঃখের ইতিকথা লেখা থাকে। গোলায় ধান থাকলে কৃষকের ঘরে সুখ না থাকলে অসুখ অর্থাৎ দুঃখ। অনেকটা দুঃশ্চিন্তার ভাগাড় মাথায় নিয়ে জমি থেকে ধান কেটে এনেছিলেন কৃষকেরা। তখনও পর্যন্ত তাদের মুখে ছিলো সোনালী হাসি। এ হাসি বেশি দিন আর টিকেনি। ঘুর্ণিঝড় ‘অশনি’র প্রভাবে বিরামহীন বৃষ্টিপাতে ফিঁকে করে দিয়েছে তাদের হাসি। মাড়াই করে রাখা ধান শুকাতে না পারার কারণে প্রায় সকল কৃষকের ধানেই চারা গজিয়েছে। এতে ক্ষতির সম্মুখিন হবেন কৃষকরা। তবে, এ সমস্যায় বসে নেই তারা। প্রাচীন পদ্ধতি অবলম্বন করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কিছুটা হলেও আসন্ন ক্ষতি থেকে বাঁচার।

অভিজ্ঞ কৃষকেরা জানান, আগেকার দিনে উদ্ভুত এমন পরিস্থিতিতে ধানকে বস্তাবন্দি করে পুকুর, ডোবা কিংবা নদীর পানিতে ভিজিয়ে রাখতেন অনেকে। যাঁদের নৌকা ছিলো তাদের কেউ কেউ ধানকে বস্তাবন্দি না করে খোলা অবস্থায় নৌকায় ভরে নৌকা একটি নির্দিষ্ট, নিরাপদ ও সুবিধাজনক জায়গায় ডুবিয়ে রাখতেন। এ অবস্থায় অনেক (১৫/২০ দিন) দিন পর্যন্ত ধানে চারা গজাতো না। এখনও কেউ কেউ কোনো জায়গায় এমন পদ্ধতি গ্রহণ করছেন যেনো ধানগুলো পুরোপুরি নষ্ট না হয়ে যায়। এ পদ্ধতিতে ধানের কোনো ক্ষতি না হলেও কৃষকের কষ্ট ও খরচ বেড়ে যায়। কিছুটা হলেও চালের গুণাগুণ কমে যায়। তবে, একথা মানতে রাজি নন প্রবীণ কৃষকেরা। তারা বলেন, এতে তো ধানের ক্ষতি হবেই না বরং লাভ হবে।

শান্তিগঞ্জের পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের মাদ্রাসাপাড়ার প্রবীণ কৃষক খোয়াজ আলী বলেন, লাগাতার বৃষ্টি-বাদল হলে আগে আমরা ধান বস্তাবন্দি করে পুকুর, ডোবা অথবা নদীতে ভিজিয়ে রাখতাম। দিন না উঠা পর্যন্ত থান তুলতাম না। কষ্ট একটু বেশি হতো কিন্তু একটা ধানও নষ্ট হতো না। চালও খুব ভালো হতো। এখনও হবে। কোনো চাল নষ্ট হবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শান্তিগঞ্জ উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের সলফ ও জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামসহ এ দুই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামের কৃষকরা বস্তাবন্দি করে ধানকে পানিতে ভিজিয়ে রেখেছেন। নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক মোমিন আহমদ ও সলফ গ্রামের কৃষক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের গ্রামে অনেক কৃষক ধান ভিজিয়ে রেখেছেন। ধানে চারা গজিয়েছে। আর যেনো চারা না গজায় সে জন্য এ পদ্ধতি। এটি বিজ্ঞানসম্মত কি না জানি না তবে অনেকটা কার্যকরী পদক্ষেপ।

এদিকে, ধান শুকানোর এ পদ্ধতিকে বিজ্ঞান সম্মত নয় বলে জানিয়েছেন শান্তিগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাজেদুর রহমান। বিজ্ঞান সম্মত না হলেও অনেকেই এ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন।

তিনি বলেন, এ ব্যপারে আমি কিছু বলতে চাই না। তবে আমাদের পরিকল্পনা আছে ড্রায়ার মেশিন (ধান শুকানোর যন্ত্র বিশেষ) নিয়ে আসার। মেশিনটা একটু দামী। প্রত্যেক ইউনিয়নে একজন কৃষকও যদি ভর্তুকির মাধ্যমে মেশিনটা নিয়ে আসেন তাহলে হয়তো ওই ইউনিয়নের কৃষকেরা অনেকটা উপকৃত হতেন। এ বছর আর সময় নেই। আগামী বছরের প্রথম দিক থেকেই আমরা ওইদিকে মুভ করবো। এবছর বিকল্প কিছু দেখছি না। আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী আশা করছি আগামীকাল পরশু থেকে বৃষ্টি কমে যাবে। রোদ উঠবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত