নিজস্ব প্রতিবেদক

১১ মার্চ, ২০২৪ ২৩:০৮

২৫ বছরে সিলেটের ৩০ শতাংশ টিলা কেটে সাবাড়

ফাইল ছবি

সিলেটে টিলা কেটে সাবাড় করে ফেলা হচ্ছে। গত আড়াই দশকে এখানকার ৩০ শতাংশ টিলা কেটে ফেলা হয়েছে। ব্যক্তির পাশপাশি টিলা কাটছে সরকারি প্রতিষ্ঠানও।

কী পরিমাণ টিলা সিলেটে ছিল, এর সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান কোথাও নেই। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের চার জেলায় বর্তমানে ১ হাজার ৮৭৫টি টিলা আছে। এসব টিলার আয়তন ৪ হাজার ৮১১ একর। এর বাইরে আড়াই দশকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ টিলা কেটে ফেলা হয়েছে।

২ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় সিলেট সদর উপজেলার নালিয়া বাঘমারা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি টিলার বেশ খানিকটা অংশ কেটে প্রায় সমতল করে ফেলা হয়েছে। নির্মাণ করা হচ্ছে আধা পাকা একটি ঘর। ঘরের মালিক কে? এমন প্রশ্নের জবাব দিতে চাননি দুজন শ্রমিক। নির্মাণাধীন ঘরের পাশে টিলা কেটে আরও একাধিক প্লট তৈরির কাজ চলছে।

একই দিন দুপুর সাড়ে ১২টায় সিলেট নগরের আখালিয়া মোহাম্মদীয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি টিলার প্রায় অর্ধেক কেটে ফেলা হয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক বসতি স্থাপনের কাজ করছেন। তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এই টিলা কে কাটছেন, তাঁরা কোনো জবাব দেননি।

গত কয়েক দিনে সিলেট নগরের হাওলদারপাড়া, ব্রাহ্মণশাসন, আখালিয়া, মোহাম্মদীয়া ও দুসকি এবং সদর উপজেলার নালিয়া ও খাদিমনগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এভাবেই অন্তত ১১টি টিলা কেটে বসতি নির্মাণ করার চিত্র পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৬ (খ) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করতে পারবে না। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড় বা টিলা কাটা যেতে পারে।

যারা টিলা কাটছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি, যাদের বিরুদ্ধেই টিলা কাটার অভিযোগ ওঠে, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বলছে, সিলেট বিভাগের চার জেলায় একসময় কয়েক হাজার টিলার অস্তিত্ব ছিল। এর মধ্যে হাজারো টিলা কেটে ফেলা হয়েছে। এখনো দেদার সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলা কাটা চলছে। অথচ তা ঠেকাতে প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই।

    
পরিবেশ অধিদপ্তর ৩০ শতাংশ টিলা কাটার তথ্য জানালেও বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিমের দাবি, পরিবেশ অধিদপ্তর প্রকৃত হিসাব দেয়নি। সিলেটের অন্তত ৫০ শতাংশ টিলা সাবাড় হয়ে গেছে। এখনো সিলেট নগর, শহরতলি ও আশপাশের উপজেলায় প্রকাশ্যে টিলা কাটা চললেও তা বন্ধের উদ্যোগ নেই। বিশেষ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরদারি না থাকায় টিলা ধ্বংসকারীরা বেপরোয়া।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫৬ সালে ভূমির মাঠ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের ছয়টি উপজেলায় ১ হাজার ২৫টি টিলার অস্তিত্ব রয়েছে। এর বাইরে আরও তিনটি উপজেলায় কিছু টিলা আছে। এসবের মধ্যে শতাধিক টিলা পুরোপুরি বা আংশিক সাবাড় হয়ে গেছে।

২ মার্চ সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের হাওলদারপাড়ায় মজুমদার টিলাটি অনেকটাই কেটে সমতল করে একাধিক পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর টিলার বাকি অংশও কাটা চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাওলদারপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, মজুমদার টিলার অধিকাংশ অংশকে এখন সমতল ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। রাতের আঁধারে এ টিলা কাটা চলে।

২ মার্চ নগরের ব্রাহ্মণশাসন ও দুসকি এলাকা এবং ৩ মার্চ সদর উপজেলার খাদিমনগর এলাকা ঘুরে আরও চারটি টিলা কাটতে দেখা গেছে। এ ছাড়া সিলেটের গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও জৈন্তাপুর উপজেলায় অন্তত চারটি টিলা কাটতে দেখা গেছে।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়নমূলক কাজের জন্য টিলা কাটছে। এর বাইরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বসতি নির্মাণের জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলা বেশি কাটা হচ্ছে। খননযন্ত্রের সাহায্যে (ভেকু) রাতের বেলা এসব টিলা কাটা হয়। কোথাও কোথাও কোদাল দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে দিনের বেলাতেই টিলা কাটা হয়। টিলা ও টিলায় থাকা গাছ কাটার ফলে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে।

বেলা সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার জানান, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পাহাড়-টিলা কর্তন বা অন্য কোনো উপায়ে ভূমিরূপ পরিবর্তন করা যাবে না। অথচ পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে সিলেটে টিলা কাটা চলছেই।

পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, ২০২১ সাল থেকে চলতি বছরের ৩ মার্চ পর্যন্ত সিলেটে পাহাড় ও টিলা কাটার বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট উইং ৮১টি অভিযান চালিয়ে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করেছে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার ৩১৩ টাকা। ভ্রাম্যমাণ আদালত ২৫টি অভিযান চালিয়ে টিলা কাটার দায়ে ২১ লাখ ১৫ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি ২১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক এমরান হোসেন বলেন, টিলা রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর কাজ করছে। টিলা ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অভিযান হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। যাঁরা টিলা কাটার সঙ্গে জড়িত থাকবেন, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।

এ ব্যাপারে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, কোথাও টিলা কাটার খবর পেলে বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ছাড়া টিলা যেন কেউ কাটতে না করতে পারে, এ জন্য প্রশাসনের কঠোর নজরদারি আছে।
সূত্র: প্রথম আলো

আপনার মন্তব্য

আলোচিত