আকবর হোসেন,জামালগঞ্জ

১৪ মার্চ, ২০১৬ ১৮:৫৫

জামালগঞ্জের অধিকাংশ জলমহালে তলা শুকিয়ে মাছ ধরার মহোৎসব

আইন আছে প্রয়োগ নেই

চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ জলমহালে  মেশিন দিয়ে তলা শুকিয়ে মাছ ধরার মহোৎসব ছিলো। এক শ্রেণীর অসাধু ইজারাদাররা ও সাব ইজারাদাররা। অনেক জলমহালের তীর বর্তী গ্রাম বাসী জলমহাল শুকানোর জন্য লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। আবার কোন কোন জলমহালের ইজারাদার ও সাব ইজারাদাররা প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ায় কেউ আর অভিযোগ করেননি। অভিযোগের পর স্থানীয় সাংবাদিকরা সরেজমিন পরিদর্শন করে সংবাদ প্রকাশের পর রাজনৈতিক দলের নেতা ও ইজারাদারদের লোকদের ধারা হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। ছোট বড় জলমহাল মিলিয়ে কয়েকটি জলমহালে অভিযোগ হলেও কার্যকর হয়েছি মাত্র একটি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে অভিযোগের পর অধিকাংশ অভিযোগের তদন্তভার উপজেলা ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকতার উপর পড়লেও তিনি দায়সারা ভাবে কাজ করেছেন,কোন ধরনের চোখে পড়ার মত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি।

উপজেলার এলজিইডির হিলিপ প্রকল্পের জলমহাল গুলি স্থানীয় সুবিধা ভোগীদের ব্যবহারের কথা থাকলেও সেগুলো সাব ইজারাদাররা ইচ্ছে মত তলা শুকিয়ে জলমহালের মাছ ধরেছেন। একদিকে যেমন প্রতারিত হয়েছেন কৃষকরা,অন্যদিকে জলমহাল শুকানোর কারণে মা মাছ গুলি,এমনকি পোনা মাছ গুলি হয়েছে নিধন। যা আমাদের জন্য হুমকির সরূপ। তবে আশার বানী শুনিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি অধিকাংশ জলমহালের অভিযোগের পর বারণ ও বাঁধা নিষেধ দিয়েছেন,আবার কোন কোন জলমহালে সরেজমিনে গিয়ে নিষেধ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ফেনারবাকের দত্তউজা বিলের অভিযোগের পর তিনি নিজে জলমহালে যান। ইজারাদারদের লোকদের মেশিন বন্ধ ও সেচতে নিষেধ করে আসার পরও রাতের আধারে হ্যাজাক লাইট দিয়ে আরও জোরেশোরে বিলটি সেচেন। এলাকাবাসী রাতেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন। পরের দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গত রবিবার তাকে আটক করে জামালগঞ্জ থানায় রাখেন। রবিবার রাতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট টিটন খীসা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জলমহালের ইজারাদার গোলাম সাকলাইন দীপককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এরির্পোট লেখা পর্যন্ত দত্তউজা বিলে আগের চেয়ে আরো দুটি মেশিন বাড়িয়ে জলমহাল শুকানোর কাজ চলছিলো বলে জানিয়েছেন অভিযোগকারীরা।

এলাকাবাসী ও হাওড় পাড়ের কৃষকদের জোরালো দাবী  যারা জলমহাল শুকিয়ে নিয়ম ভেঙ্গে মাছ ধরেছে তাদের জলমহালের লিজ বাতিলের। এরকম কয়েকটি হলে ভবিষ্যতে কেউ জলমহাল শুকিয়ে মাছ ধরবেনা।

উপজেলার সবচেয়ে বেশী জলমহাল ফেনারবাক ইউনিয়ন ও বেহেলী ইউনিয়নে। এর মধ্যে এবছর ফেনারবাক ইউনিয়নে বিল সেচার হিড়িক ছিলো। ছিলো রীতিমত উৎসবের মত। এক জলমহাল আরেক জলমহালের সাথে পাল্লা দিয়ে সেচা চলছিলো। স্থানীয়রা জানিয়েছেন বিল সেচার আগেই সংশ্ল্ষ্টি মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়,স্থানীয় নেতা ও হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিককে খুশী করে এই জলমহাল শুকানোর কাজ বাস্তবায়ন করেছে।

ইজারাদারা এলাকার প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ায় এলাকার সাধারণ মানুষ ভয়ে মুখ খুলেননি তেমনি স্থানীয় মৎস্য অধিদপ্তর দেখে ও না দেখার ভান করে থেকেছেন।
অভিযোগ গুলো ও সজেমিনে ঘুরে দেখা গিয়েছিলো উপজেলার ফেনারবাক ইউনিয়ন ও ভীমখালী ইউনিয়নের ছয়হারা গঙ্গাধরপুর মৌজার ছয়হারা নদীতে স্থানীয় নাম ঢালা বিলে ২টি পাওয়ার পাম্প মেশিন দিয়ে চলছে বিল সেচার কাজ।

একই ভাবে ভীমখালী ইউনিয়নের তেরানগরের ব্রিজের পাশে দোলতা নদীতে একটি বড় পাওয়ার পাম্প দিয়ে সেচা হয়েছিলো। কাশীপুর ও লক্ষ্মীপুরের গ্রামের মাঝামাঝি গুল বিলে বড় কয়েকটি পাওয়ার পাম্প দিয়ে বিল সেচা হয়েছে।

গঙ্গাধরপুর গ্রামের সামনে লম্বা বিলে ও বিনাজুড়ার সামনে লম্বা বিলেও মেশিন দিয়ে বিল শুকানো হয়েছিলো। গুল বিলের সাব ইজারাদাররা বিল সেচেছিলো। একই ভাবে লক্ষ্মীপুরের পাশে চাটনী বিলের ইজারাদার ও তার লোকেরা বিল সেচে ছিলো। রাজাপুর ব্রিজের সংলগ্ন দোলতা নদীর অপর অংশে মেশিন ও পানি সেচের পাম্প নিয়ে সেচা হয়েছিলো। ইজারাদাররা বিভিন্ন মৎস্যজীবী সমিতির নামে বন্দোবস্ত এনে নিজেরা সাব লিজ নিয়ে থাকেন, ইজারাদাররা সরকারী নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে তারা অধিক লোভের আশায় মেশিন দিয়ে শুকিয়ে জলমহালের তলা থেকে মাছ ধরে থাকেন। তলা শুকিয়ে মাছ ধরার কারণে এলাকার সাধারণ মানুষজন বঞ্চিত হচ্ছেন। ফেনারবাক ইউনিয়নের উড়া বিল, বেহেলীর কসমা বিল,হালির হাওরের কইয়ার বিল,ঘনিয়ার বিল,সাচনা বাজার ইউনিয়নের দোপাপসি বাউসা বিলও মেশিন দিয়ে তলা শুকয়ে মাছ ধরেছে।

অভিযোগ উঠেছিলো ফেনারবাক ইউনিয়নের চাটনী বিলের সাব-ইজারাদার আওয়ামীলীগ নেতার ভাতিজার বিরুদ্ধে। স্থানীয় সাংবাদিকরা জলমহালের ছবি তুলতে গেলে বাধা প্রদান ও বক্তব্য নেওয়ার সময়ও দাম্ভিকতার সুরে বলে যা পারো লিখো,লিখলে কিছুই হবে না। স্থানীয় মৎস্য অধিদপ্তর দেখে ও না দেখার ভান করছেন। আর বিলের পাড়ের মৎস্যজীবি ও সাধারন কৃষকরা তাদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায়নী। এখন পর্যন্ত কোন ফল পায়নী এলাকাবাসী,শেষ পর্যন্ত কোন ফল পাবেন কিনা দেখার ও অপেক্ষার বিষয়। কিছু না হলে সাব ইজারাদারের কথাই ঠিক হবে কিচ্ছু হবেনা,যার পারো লিখো। জলমহাল না শুকানোর জন্য গোসল করার জন্য মানবিক আবেদনও করেছিলো এলকাবাসী ফেনারবাক ইউনিয়নের উজান  ও ভাটী দৌলতপুরের ৫০ জন কৃষক পরিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। দৌলত পুরের সেন্টু সরকার,সঞ্জয় সরকার,প্রনয় পুরকায়স্থ সহ অনেকেই তার পরও কোন ফল পাননী।

এরকম উদাহরন একটি দুটি নয় শতাধিক। এমনিতেই পর পর দুবছর ভালো ফলন হয়নী,বন্যা, শিলা বৃষ্টি,অতিবৃষ্টির কারনে ফসলের ক্ষতি তার উপর সেচের পানি না পেলে আমাদের একমাত্র বোরে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হবে।

এভাবে পানি সেচে মাছ ধরার ফলে আমাদের কাছ থেকে দেশীয় প্রজাতির চির চেনা মাছ যেমন শিং, মাগুর, কই, টেংরা, পুটি, শোল, টাকি, বাইলা, মিনি, বেদা, গুলসাইয়া, রানী, বাইম, কটকইট্টা, কইলা, পাবদা,ঘইন্যা, তারা বাইম, মকা, ইছা, তিতনা সহ ইত্যাদি মাছ গুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বিলে পানি না থাকলে আমাদের জমিতে পানি দেওয়া সম্ভব হবেনা,ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে। জামালগঞ্জের একাধিক কৃষক জানিয়েছেন,এমনিতেই ফসল মাইর যায়,তার উপরে যদি জমিত পানি না দেউইন যায়,তাইলেতো ফসলের ক্ষতি অইবো।

স্থানীয় গোপালপুরের মৎস্যজীবি সম্প্রদায়ের একাধিক মৎস্যজীবি জানিয়েছেন,এখন আর আগের মতো মাছ নাই,থাকবো কি কইরা,মাঠি তলা তইন মাঠি খুইড়া মাছ ধরইন,ইলাখ্যান অইলে ঔষধ খাওয়নোর লাইগ্যাও আর দেশী মাছ পাওয়া যায়তো নাই ।

এলজিইডির হিলিপ প্রকল্পের মৎস্য বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম জানান, আমাদের পক্ষ থেকে বারবার নিষেধ করা হয়েছে,তার পরও যদি কেউ তলা শুকিয়ে মাছ ধরে এর দায়ভার সংগঠনকে নিতে হবে।

উপজেলা ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল হাসান জানান,বিলের তলা শুকিয়ে মাছ ধরার বিষযে আমি সকল জলমহালের ইজারাদারদের অবগত করেছে।২০ একরের নিচে যে বিল ইউ এন ও ,২০একরের উপরের গুলোকে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা টিটন খীসা জানান,ইতি মধ্যে সবগুলো জলমহালের ইজারাদারদের নোটিশ দিয়ে অবগত করা হয়েছে । তার পরও যদি কেউ আইন অমান্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত