সিলেটটুডে ডেস্ক

০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:৩৩

গুরু অপরাধে লঘু দন্ড!

ভোলাগঞ্জে ব্যবসায়ীর কাছে থেকে ইউএনও ৩০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ, ‘কু-উদ্দেশ্য’ খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি

পাথর কোয়ারিতে ‘বোমা মেশিন’ হিসেবে পরিচিত অবৈধ যান্ত্রিক খননযন্ত্রের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান পরিচালনার সময় ইউএনওর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ৩০ লাখ টাকা পাথর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন সেই টাকা। সেটা প্রমাণিতও হয়েছে তদন্তে।

তবে তদন্ত কমিটি এই অর্থ গ্রহণের পেছনে কোনো ‘কু-উদ্দেশ্য’ খুঁজে পায়নি। আর মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তাঁর সুপারিশে এটিকে ঘুষ হিসেবে বর্ণনা না করে ‘অসদাচরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর ইউএনওর শাস্তি হিসেবে দুটি বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
 
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের স্থানীয় প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে বোমা মেশিন বিরোধী অভিযান বন্ধ রেখেছিল। পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালালে পাড়ুয়াবাজার এলাকায় তারা পাথর ব্যবসায়ীদের হামলার মুখে পড়ে। ক্ষুব্ধ পাথর ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন করেন- স্থানীয় প্রশাসনের কর্ণধার কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আসিফ বিন ইকরামকে ৩০ লাখ টাকা দেওয়ার পরও কী করে চলে এ অভিযান? যদিও উচ্চ আদালতের নির্দেশ পাথর কোয়ারিগুলোতে প্রতি মাসে অন্তত একবার বোমা মেশিনবিরোধী অভিযান চলার। কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাথর কোয়ারিগুলোর একটি ভোলাগঞ্জের পাথর কোয়ারিতে অভিযান চালানোর জন্য ঘুষ নেন ইউএনও। এই অর্থ হস্তান্তরের পরপরই সেখানকার কোয়ারিতে বোমা মেশিনের বিরুদ্ধে নজরদারি অভিযান বন্ধ হয়ে যায়।

অভিযোগ গুরুতর হওয়ায় ধামাচাপা দেওয়া কঠিন হয়ে পরে ইউএনও আসিফ বিন ইকরামের। তার বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। যুগ্ম সচিব আ ন ম কুদরত ই খুদার নেতৃত্বে গঠিত কমিটি তদন্তে প্রমাণ পায়, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আবদুল আলী নামের এক পাথর ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন ‘মেসার্স শাহ আনোয়ার আলী স্টোন ক্রাশার’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব থেকে ক্রস চেকের মাধ্যমে দুই দফায় ২৫ ও ৫ লাখ টাকা গ্রহণ করেন ইউএনও আসিফ। সেই অর্থ তিনি জমা করেছিলেন তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে।

ইউএনও আসিফ বিন ইকরাম তদন্ত কমিটির কাছে তাঁর কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, স্থানীয় দুই পাথর ব্যবসায়ীর মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে তিনি ওই অর্থ জামানত হিসেবে রেখেছিলেন এবং জেলা প্রশাসকের জ্ঞাতসারে কাজটি করা হয়েছে। কিন্তু ওই অর্থ তিনি স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে কেন রাখলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

জ্যেষ্ঠ সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে লিখেছেন ‘স্ত্রীর নামে সরকারি অর্থ জমা দেওয়া অসদাচরণের শামিল...সার্বিক বিবেচনায় অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। এবং তাঁর দুটি বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত দেওয়া হলো।’

এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এত বড় অন্যায়ের শাস্তি কোনোভাবেই শুধু বেতন বৃদ্ধি স্থগিত হতে পারে না। সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী তাঁর চাকরি চলে যাওয়া উচিত। তিনি তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের চেক জমা রেখেছেন, এর চেয়ে বেশি তথ্য আর দরকার হয় না। এটা নিঃসন্দেহে ঘুষের পর্যায়ে পড়ে।

এখন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ইউএনও পদে আছেন কোম্পানীগঞ্জের তৎকালীন ইউএনও এ এইচ এম আসিফ বিন ইকরাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যা করেছি, তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে করেছি। সরল বিশ্বাসে আমি ৩০ লাখ টাকা আমার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে জমা রেখেছি। ওই ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন, ডিসি সাহেব রাজি আছেন, আপনি টাকাটা রাখুন। ডিসি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।’

তবে তৎকালীন ডিসি ও বর্তমান যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে অভিযোগ তদন্তকালে বিষয়টি তাঁর নজরে আসে। তাঁর বিরুদ্ধে যা বলা হচ্ছে, সব মিথ্যা। তথ্যপ্রমাণই বলে দেয়, কে টাকা নিয়েছেন।

এদিকে ওই চেক প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স শাহ আনোয়ার আলী স্টোন ক্রাশার’-এর তখনকার প্রধান আবদুল আলী পরবর্তীকালে আততায়ীর হাতে নিহত হন। তাঁর ভাই আবদুল হক বলেন, তাঁরা ওই টাকা আর ফেরত পাননি। ইউএনও মিথ্যা বলেছেন।

অর্থ দিয়েছিলেন কেন জানতে চাইলে আবদুল হক বলেন, ‘ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। তবে ইউএনকে ঘুষ দিয়েও কাজ হয়নি বলেই টাকা ফেরত চাওয়া হয়েছিল।’ তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘুষের অভিযোগ ওঠার পর ইউএনও আসিফ ওই অর্থ ফেরত দিয়েছেন।
সূত্র : প্রথম আলো

আপনার মন্তব্য

আলোচিত