নিজস্ব প্রতিবেদক

০৫ এপ্রিল, ২০১৭ ১৬:৪৫

নদীর তলদেশ ভরাট আর প্রথাগত বাঁধে ডুবছে হাওরের ফসল

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নলুয়ার হাওর। প্রতি বছর এই হাওরের ২১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার। তবু শেষ রক্ষা হয় না, প্রায় প্রতিবছরই তলিয়ে যায় ফসল। এবছরও গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে এই হাওরের পুরোটা তলিয়ে গেছে।

জগন্নাথপুর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তাদির আহমদ মুক্তা মনে করেন, প্রতিবছর প্রথাগতভাবে মাটি ও বাঁশ দিয়ে কেবল বাঁধ নির্মাণ করে হাওরের ফসল রক্ষা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, হাওরের পাশেই কামারখালী নদী, যা ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এটি দিয়ে পানি নিঃসরণ হয় না, অল্প বৃষ্টিতেই নদীর পানি হাওরে ঢুকে পড়ে। অথচ এই নদীর ৭ কিলোমিটার এলাকা খনন করা গেলে বছর বছর ২১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করার প্রয়োজন হতো না।

সুনামগঞ্জের বাসিন্দা, কৃষক ও বিশেষজ্ঞরাও জানিয়েছেন এমন কথা। তাদের মতে, সুনামগঞ্জের হাওর, নদী ও খালের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় অল্প বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলেই নদীর পাড় মাড়িয়ে হাওরে ঢুকে পড়ে পানি। এতে তলিয়ে যায় ফসল। এই এলাকার নদী ও খাল খনন ছাড়া ফসল রক্ষা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তারা। একইসঙ্গে ভাঙনপ্রবণ এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন বলেও অভিমত তাদের।

নদী খনন না হওয়া ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় প্রতিবছরই তলিয়ে যায় হাওরের ফসল। এবছর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যথাসময়ে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও নির্মাণ না হওয়া। এবছর সরকার থেকে ৫৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। ফলে চৈত্রের ঢলেই তলিয়ে গেছে হাওরের বোরো ফসল।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের হিসেব মতে, মঙ্গলবার পর্যন্ত সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের ৭৯ হাজার ৭৯০ হেক্টর ফসল তলিয়ে গেছে। যাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। তবে স্থানীয়দের দাবি, ইতোমধ্যে তলিয়ে প্রায় দুইশ’ হেক্টর জমির ফসল।

কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর ২ লাখ ২০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। গত নভেম্বর থেকে বোরো চাষের মৌসুম শুরু হয়। এপ্রিল মাসে ফসল উঠার কথা।

হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ার পেছনে দায়ীদের শাস্তির দাবিতে মঙ্গলবার বিকেলে নগরীতে মানববন্ধন করে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা নামের একটি সংস্থা। এতে অংশ নিয়ে সিলেটের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, হাওরের ফসল রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদী ও বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা দরকার। এতে বিশেষজ্ঞদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। বছর বছর বাঁধ নির্মাণের জন্য কোটি টাকা বরাদ্দ না দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করতে হবে। নদী খনন করতে হবে এবং যেখানে সম্ভব সেখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।

দেশের অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চল সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চল। বছরের আট মাসই জলমগ্ন থাকে হাওর। ফলে বছরে এই একবারই ফসল ফলানোর সুযোগ পান হাওরপাড়ের কৃষকরা। বৈশাখের দিকে ঝড় ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওর এলাকায় দেখা দেয় বন্যা। যা এই এলাকায় অকাল বন্যা নামে পরিচিত। এবছর চৈত্রেই দেখা দিয়েছে অকাল বন্যা।

অকাল বন্যার হাত থেকে হাওরের ফসল রক্ষার জন্য ষাটের দশকে নির্মাণ করা হয় বেড়িবাঁধ। এই বেড়িবাঁধগুলো নদীর পানি হাওরে ঢুকতে দেয় না। ফলে রক্ষা পায় বোরো ফসল।

বর্ষায় এসব মাটির বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে প্রতিবছরই গ্রীষ্মে বাঁধগুলো পুনর্নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রতিবছরই বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তারউপর নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার এখন অল্প বৃষ্টিতেই নদী উপচে তলিয়ে যায় হাওরের ফসল।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হ্যাপ’র হিসাব মতে, চলতি বছরের আগে ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই হাওরাঞ্চলে সাতবার কৃষকরা তাদের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি।

এই সংস্থাটির যুগ্ম আহবায়ক মো. শরিফুজ্জামান শরিফ বলেন, হাওরের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো সঠিক সময়ে টেকসই ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ এবং মেরামত না করা।

হাওর নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা মনে করেন, নদী খনন ছাড়া হাওরের ফসল রক্ষা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, সুনামগঞ্জের প্রধান নদী সুরমাসহ সবগুলো শাখা নদী ভরাট হয়ে গেছে। ফলে দু’একদিনের বৃষ্টি ও ঢলেই নদী উপচে হাওরে পানি ঢুকে পড়ে। ফলে নদীগুলো জরুরী ভিত্তিতে খনন করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, পুরো হাওরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ সম্ভব নয়। কারণ হাওর মানেই হলো মুক্ত জলাশয়। স্থায়ী বাঁধ হলে হাওরের নিজস্বতা হারিয়ে যাবে। তবে অধিক-ভাঙন প্রবণ এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা যেতে পারে।

নদী খনন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলামও। তিনি বলেন, নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাওয়া একটি বড় সমস্যা। এজন্য সুনামগঞ্জের ৬৮ কিলোমিটার নদী খননের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব আমরা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। আশা করছি, এটি দ্রুত অনুমোদন পাবে।

জেলা প্রশাসক বলেন, এছাড়াও হাওরের ফসল কিভাবে রক্ষা করা যায় তার জন্য বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গবেষণা করে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য আমরা সরকারের সর্বোচ্চ মহলে লিখেছি। যাতে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি না হয় তাও খেয়াল রাখতে হবে।

হাওরের দুর্ভোগে পরিদর্শনে বুধবার সুনামগঞ্জ গেছেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মোছাম্মৎ নাজমানারা খানম। তিনি বলেন, আগাম বন্যায় ফসল রক্ষার ক্ষতি ঠেকাতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। আগামী বছরগুলোতে যাতে ফেব্রুয়ারির মধ্য বাঁধের কাজ শেষ হয় সেদিকে নজর রাখা হবে। এছাড়া নদী খনন ও রাবার ড্যাম নির্মাণসহ দীর্ঘমেয়াদী আরো কিছু কাজ করতে হবে।

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর মো. আফসর উদ্দিনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলার ১১টি উপজেলার ৪২টি হাওরে এ বছর ২৩০ কিলোমিটার ফসলরক্ষা বাঁধের কাজের জন্য এবার প্রায় ৫৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো।

তবে, সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার কৃষকরা জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারিতে বেশিরভাগ হাওরের বাঁধ নির্মাণের কাজই শুরু হয়নি।

সুনামগঞ্জের স্থানীয় সাংবাদিক শামস শামীম বলেন, বাঁধের জন্য এবার সর্বোচ্চ অংকের টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলো সরকার। এই কাজটা ঠিকঠাক মতো হলেও এতো ক্ষতি হতো না।

তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা মিলে কাজ না করে টাকা লুটপাট করেছে। এই ঠিকাদাররা আবার স্থানীয় সরকার দলের আশীর্বাদপুষ্ট প্রভাবশালী।

শামীম জানান, মঙ্গলবার পর্যন্ত তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর ছাড়া প্রায় সব হাওরই তলিয়ে গেছে। এতে জেলার ১১ উপজেলার ৩ লাখ ৩৩ হাজার কৃষি পরিবার এখন পথে বসার উপক্রম।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাহেদুল হক বলেন, আমরা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ কার চেষ্টা করছি। এই অবস্থা অপরিবর্তিত না হলে সব হাওরেরই ফসল তলিয়ে যাবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত