নিজস্ব প্রতিবেদক

০৫ মার্চ, ২০১৮ ০১:৪৯

জঙ্গিদের টার্গেট করেই এগােচ্ছে তদন্ত

জাফর ইকবালের উপর হামলা

অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপর হামলাকারী ফয়জুর রহমানকে হাতে নাতে আটক করেছে শিক্ষার্থীরা। তুলে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে। তবে এখন পর্যন্ত এই হামলার পেছনে ফয়জুর একা না আরো কেউ জড়িত তা খুঁজে বের করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে এ হামলার ব্যাপারে এখনো অন্ধকারে রয়েছে প্রশাসন। ফয়জুর সুস্থ হওয়ায় অপেক্ষায় সবাই। রোববার সন্ধ্যায় এ ঘটনা তদন্তে একটি তদন্ত কমিটি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এদিকে, এ হামলার ঘটনা তদন্তে নেমেছে পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিট। তাদের একটি টিম রোববার সিলেটে এসেছে বলে জানা গেছে।

হামলার ঘটনায় পুলিশ ও র‌্যাব মিলে ফয়জুরসহ এ পর্যন্ত ৭ জনকে আটক করেছে। রোববার রাতে ফয়জুরের বাবা-মাকে আটক করে পুলিশ। ফয়জুরকে আসামী করে মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এদিকে, শনিবার ঘটনার পর থেকেই ঘরে তালা দিয়ে পালিয়ে ফয়জুরের পরিবার।

এখনো হামলার নেপথ্য কারণ উদঘাটন করতে না পারলেও জঙ্গিদের টার্গেট করেই  এগোচ্ছে তদন্ত কার্যক্রম। শনিবার মধ্যরাতে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক লে. কর্ণেল আলী হায়দার আজাদ বলেন, ফয়জুরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে। নিজের নামও একেক সময় একেকটি বলছে। তিনি বলেন জিজ্ঞাসাবাদে ফয়জুর বলেছে, ‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু তাই তার উপর হামলা করা হয়েছে।’

রোববার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৯ প্রধান বলেন, ফয়জুর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে- জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী হয়েই সে এ হামলা চালিয়েছে। তবে ফয়জুর কোনো জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত কী না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়াও বলেছেন,  শনিবারের হামলা উগ্রবাদী গোষ্ঠির কাজ কী না তা খতিয়ে দেখা গেছে।

হামলার ধরণ দেখে এমন আশঙ্কা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। তবে অতীতে এধরণের বিভিন্ন হামলার পর বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠি অনলাইনে দায় স্বীকার করার খবর প্রকাশ পেলেও জাফর ইকবালের উপর হামলার দায় এখন পর্যন্ত কোনো সংগঠন স্বীকার করেনি।  

মামলা দায়ের: ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় রোববার হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করা হয়েছে। রোববার  দুপুরে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে হামলার সময় আটক ফয়জুর রহমান (২৪)সহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামী করে জালালাবাদ থানায় এ মামলাটি দায়ের করেন। শনিবার রাতেই হামলার ঘটনায় জালালাবাদ থানায় এ অভিযোগ দায়ের করেন শাবি রেজিস্ট্রার।

সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, মামলার প্রধান অভিযুক্তকে আগেই আটক করা হয়েছে। তার সাথে আর কেউ জড়িত কী না তা তদন্ত করে দেখা হবে।

প্রতিবাদে উত্তাল শাবি: মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদে রোববার উত্তাল ছিলো শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সকাল থেকে মূহুর্মূহ মিছিল-মানববন্ধন-সমাবেশের মাধ্যমে বিক্ষোভ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। হামলার প্রতিবাদে সকালেই ক্লাস বর্জন করে শিক্ষার্থীরা। ফলে রোববার বিশ^বদ্যিালয়ে কোনো পাঠদান হয়নি। সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে মানববন্ধন করে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। পরে গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ছাত্রলীগ, ছাত্র ফ্রন্ট, কর্মচারী ইউনিয়ন, ইইই বিভাগ পৃথক ভাবে মিছিল, মাননবন্ধন ও সমাবেশ করে। ‘জাফর ইকবালের ওপর হামলা কেন?’, ‘বিচার চাই, বিচার চাই’ এমন শ্লোগানে দিনভর উত্তাল ছিলো ক্যাম্পাস। দুপুরে হামলার প্রতিবাদে গণসাক্ষর কর্মসূচীর আয়োজন কওে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

এ সময় বিক্ষোভকারীরা জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীর বিচার এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে নেপথ্যের ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার দাবি জানান। এছাড়া ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা জোরদারেরও দাবি জানান।

শিক্ষক সমিতির বিক্ষোভ সমাবেশে শাবি প্রক্টর জহির আহমেদ বলেন, এ ক্যাম্পাসে জঙ্গি হামলা হবে এটা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। তিনি যারা মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বিরোধী তারা এ জঙ্গি হামলা করেছে বলে মন্তব্য করেন।

এদিকে সমাবেশের পর বৈঠকে বসে শাবি শিক্ষক সমিতি। বৈঠক শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল গনি বলেন, হামলাকারীদের বিচার ও ক্যাম্পাসে নিরপত্তা বিধানের দাবিতে সোমবার সকাল ১১ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত প্রতীকী কর্মবিরতি পালন করবেন সকল শিক্ষকরা।

এ হামলার প্রতিবাদে বিকেলে নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে বিক্ষোভ করে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও শাবির সাবেক শিক্ষার্থীরা।

অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় হামলাকারী ফয়জুরের বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান ও মা মিনারা বেগম রোববার রাত ১১টায় জালালাবাদ থানায় আত্মসমর্পণ করলে পুলিশ তাদের আটক করে। এছাড়া মামা ফজলু মিয়া ও চাচা আবুল কাহার লুলইকে (৫৫) আটক করা হয়েছে। শনিবার রাতে সিলেটের কুমারগাওয়ের শেখপাড়া থেকে ফজলু মিয়াকে পুলিশ ও রোববার ভোরে ফয়জুরের গ্রামের বাড়ি দিরাই উপজেলার কলিয়ারকাপন থেকে লুলইকে আটক করে।

এছাড়া ফয়জুরের কর্মস্থল নগরীর রাজা ম্যানশনের মাহমুদ কম্পিউটারে অভিযান চালিয়ে ওই দোকানের সত্ত্বাধিকারীসহ আরো দু’জনকে আটক র‌্যাব। রোববার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে ফয়জুরসহ ৪ জনকে আটকের কথা জানান র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক লে. কর্ণেল আলী হায়দার আজাদ।

সংবাদ সম্মেলনের পর হামলাকারী ফয়জুর রহমানকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হলে পুলিশ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। আজ তাকে আদালতে তোলা হতে পারে বলে জানা গেছে।

হামলাকারীর ঘরে তালা: শনিবার বিকেলে হামলার পর রাতেই হামলাকারী ফয়জুর রহমানের পরিচয় নিশ্চিত হয় পুলিশ। তিনি শাবি ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়া গ্রামের শেখ হাফিজুর রহমানের ছেলে। হাফিজুর রহমান স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়ান। আর ফয়জুল কুমারগাও এলাকার মাদ্রাস দাখিল পর্যন্ত পড়েছেন বলে জানায় র‌্যাব।

শনিবার রাতে ও রোববার সকালে ফয়জুরের শেখপাড়ার বাড়িতে দফায় দফায় অভিযান চালায় র‌্যাব ও পুলিশ। তবে এসময় বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি। পুরো বাড়িটিই তালাবদ্ধ করে পালিয়েছে সবাই। রাতে র‌্যাব বাড়ির তালা ভেঙ্গে ঘরের ভেতর তল্লাশী চালায়।

ক্যাম্পাসের নিরপত্তা নিশ্চিতের আশ্বাস উপাচার্যের: ক্যাম্পাসের ভেতরেই প্রকাশ্যে একজন শিক্ষকের উপর হামলার পর প্রশ্ন উঠেছে শাবি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিয়ে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা শাবি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা জোরদার, সীমানা প্রাচলি নির্মান ও বহিরাগত প্রবেশে বিধিনিষেদেও দাবি জানান।

বিকেলে ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন করে শাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা জোরদাওে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়া বিশ^বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্মান করা হবে।
 
তদন্ত কমিটি গঠন: হামলার ঘটনায় রোববার সন্ধ্যায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জানান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল গণিকে প্রধান কওে কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শহিদুর রহমান।

উল্লেখ্য,শনিবার বিকেলে শাবির মুক্তমঞ্চে একটি ফেস্টিভাল চলাকালীন ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা করে ফয়জুর রহমান নামে এক যুবক। ফয়জুরকে হাতেনাতে আটক করে গনপিটুনি দেয় শিক্ষার্থীরা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত