নিজস্ব প্রতিবেদক

০৬ মার্চ, ২০১৯ ১৭:৩৪

অপ্রয়োজনীয় দুইশ' প্রকল্পে ৩০ কোটি টাকার অপচয়

হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ

সুনামগঞ্জের ৩৭ হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে চলতি অর্থ বছরে প্রায় দুই শতাধিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের প্রায় ৩০ কোটি টাকার অপচয় হয়েছে বলে মনে করেন কৃষক নেতারা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফোরামে ফসলরক্ষা বাঁধের তদারকিতে নিয়োজিত জেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটিকে অবগত করা হলেও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করা হয়নি। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে তেমন কাজও হয়নি বলে মনে করেন তারা।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়নে হাওরের প্রায় ৪ শ কি.মি ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ৫৬৭টি প্রকল্প নেয় জেলা কাবিটা মনিটরিং ও বাস্তবায়ন কমিটি।

নির্মাণকাজে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৯৬ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা। ২০১৭ সালে প্রণীত নতুন নীতিমালায় কেবল কৃষক ও বাঁধ এলাকার জমির মালিককে প্রকল্পে স্থান দেওয়ার কথা। গত বছরের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে গণশুনানির মাধ্যমে তাদের নিয়ে পিআইসি গঠন করার কথা ছিল। কিন্তু হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাচাও আন্দোলনসহ স্থানীয় কৃষক ও সচেতন লোকজন জানিয়েছেন নতুন কাবিটা নীতিমালাও মানা হয়নি প্রকল্প গ্রহণে। ফলে পিআইসি গঠন থেকেই দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি শুরু হয়। রাজনৈতিক প্রভাবে জমির মালিক না থাকা সত্ত্বেও পিআইসি গঠনে স্বজনপ্রীতি করা হয়।

হাওর বাচাও সুনামগঞ্জ বাচাও আন্দোলনের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা সম্প্রতি ১১ উপজেলা পরিদর্শন করে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো দেখতে পান। তাদের মতে ১১ উপজেলায় বিস্তৃত বৃহত্তম ৩৭টি হাওরে প্রায় দুই শতাধিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পে প্রায় ৩০ কোটি টাকা সরকারের অপচয় হয়েছে বলে মনে করেন নেতৃবৃন্দ। এই বিপুল সংখ্যক অর্থ অপচয়ে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশও করেছেন।

সরেজমিন হাওরে বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ পরিদর্শন করে জানিয়েছেন গত বছর বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্তত দুই শতাধিক প্রকল্পের কাজ অক্ষত ছিল। এই বাধগুলোর সামান্য অংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু নতুন প্রকল্পে পুরো বাধেরই প্রকল্প করে অধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব বাধের প্রতিটিতে গড়ে ৮-২২ লাখ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্প গ্রহণ শেষে বাস্তবায়নের সময় প্রকল্প কমিটির লোকজন পানি উপজেলা কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিবদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বাঁধগুলো নতুন দেখাতে উপরের আবরণ সরিয়ে, মাটির নতুন প্রলেপ দিয়েছে। কোদাল দিয়ে উপরের আবরণ ঘসে কোথাও কোথাও একটু আধটু মাটি ফেলা হয়েছে।

‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’র সিনিয়র সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান সম্প্রতি দিরাই, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় অন্তত ৪০টি বাঁধ পরিদর্শন করেছেন। তার মতে এই ৪০টির মধ্যে ২০টি বাঁধের ৯০ ভাগই অক্ষত ছিল। কিন্তু প্রাক্কলন করা হয়েছে পুরো বাধের। তাহিরপুর-জামালগঞ্জ নিয়ে বিস্তৃত মাটিয়ান হাওরের সাতটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের চারটি বাধই অক্ষত ছিল। প্রতিটি বাধেই ১৫-২২ লাখ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখন এই বাঁধগুলো উপরের দূর্বা ঘাসের আবরণ সরিয়ে অল্প মাটিতে প্রলেপ দিয়ে নতুন দেখানোর চেষ্টা করছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির লোকজন।

সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নেতৃত্বে পরিদর্শনে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারি প্রকৌশলী মো, ইমরান হোসেনকে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বরাদ্দ কেন দেওয়া হলো জানতে চাইলে তিনি তাকে জানান, প্রাক্কলনের সময় পানি থাকায় যথাযথভাবে ইস্টিমেট করা সম্ভব হয়নি। পানি সরে যাওয়ার পর পুনরায় কেন প্রাক্কলন করা হলোনা জানতে চাইলে তিনি ওই কৃষক নেতাকে কোন সদুত্তর দেননি। আবু সুফিয়ান জানান, দিরাই উপজেলার রফিনগর ইউনিয়নের ৮টি, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পাথারিয়ায় দুটি, জামালগঞ্জের বেহেলি ইউনিয়নে দুটি, বিশ্বম্ভরপুর ও সদর উপজেলায় আরও চারটি বাঁধ অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। সরেজমিন দেখা এই বাঁধগুলো পুরনো আকৃতিতে থাকলেও এখন প্রলেপ দিয়ে নতুন দেখানো হচ্ছে। তাছাড়া ফসলরক্ষা কাজে নির্মিত অধিকাংশ বাধেই উচ্চতা, প্রস্ত ও দৈর্ঘ্য অনুযায়ী মাটি ফেলা হয়নি। লাগানো হয়নি ঘাস। করা হয়নি কমপেকশন। ঘাস ও কমপেকশনেও আলাদা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

শাল্লা উপজেলার ১৭নং পিআইসিকে ২২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ১৭৭০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এই বাঁধে গত অর্থ বছরেও কাজ করায় বাধটি এখনো অক্ষত। তাই এই বাধে এত বরাদ্দের প্রয়োজন ছিলনা বলে করেন স্থানীয় কৃষক কবিন্দ্র চন্দ্র দাস ও নেপাল চন্দ্র দাস। ১০ ও ১২ প্রকল্পটিতে গত বছর কাজ হওয়ায় এখনো ভালো রয়েছে বাধটি। কিন্তু এই দুটি প্রকল্পেও ২৫ লাখ টাকার মতো অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছ। ৪২ নং প্রকল্পটিও অক্ষত। তারপরও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। ৩৯ নং প্রকল্পে ২০ লাখ ৭২ হাজার টাকা দেওয়া হলেও এটি হাওরের ফসলক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বলে স্থানীয় কৃষকরা জানান। কালিকোটা হাওরের ৬৫ নং প্রকল্পে ২৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই বাধটিতেও অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ছায়ার হাওরের ৭৫ নং প্রকল্পের পশ্চিম দিকে মন্নানপুর গ্রাম সংলগ্ন ১৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন ছিলনা বলে স্থানীয়রা জানান। দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরের ১১ এর (ক) নং প্রকল্পে ২৩ লক্ষ টাকা, ৩৯ নং প্রকল্পে ৮ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা ও ১০১ নং প্রকল্পে ১৯ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই তিনটি বাঁধকে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বলছেন স্থানীয় কৃষকরা। ভাটিপাড়া ইউনিয়নের ৭০ নং প্রকল্পটিও স্থানীয়দের মতে অপ্রয়োজনীয়। বাঁধে কেবল মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। সদর উপজেলার রঙ্গারচর ইউনিয়নের কাংলার হাওর ৬নং প্রকল্পে ৮ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একই উপজেলার ৫ নং ৩ নং পিআইসিকে ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রয়োজন ছাড়াই।

এভাবে প্রতিটি উপজেলায়ই প্রয়োজন ছাড়া অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে সরকারের মোটা অংকের টাকা অপচয় করা হয়েছে বলে মনে করেন কৃষকরা।

গৌরারং ইউনিয়নের নল্লুয়া গ্রামের কৃষক গোলাম জিলানী বলেন, সরকার আমাদের হাওরের জন্য বিপুল বরাদ্দ দিয়েছে। এই বরাদ্দে ভালোভাবে কাজ করলে বাধগুলো টেকসই হতো। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি নক্সা অনুযায়ী কাজ করেনা। তাছাড়া প্রয়োজন ছাড়াও প্রকল্প দেওয়ায় সরকারের মোটা অংকের টাকা অপচয় করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের এলাকার ৫নং ও ৩নং পিআইসি অপ্রয়োজনীয়। ৩নং প্রকল্পে কেবল মাটির প্রলেপ দিয়ে বরাদ্দ লোপাটের প্রস্তুতি চলছে।

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রফেসর চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী কোথাও কাজ হয়নি। কারণ পিআইসি গঠনেই অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। তাছাড়া অনেক বাধে প্রয়োজন ছাড়া অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে সরকারের টাকা অপচয় করা হয়েছে।

হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, আমি ৫টি উপজেলায় অন্তত ৪০টি প্রকল্প ঘুরেছি। এর মধ্যে ২০টিকেই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। এসব বাধে অধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের হিসেবে ৫৬৭ প্রকল্পের মধ্যে দুশটিই অপ্রয়োজনীয়। এসব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে ৩০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। এ বিষয়ে আমরা মানববন্ধন, স্মারকলিপিসহ নানা কর্মসূচি দিয়েছিলাম।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও জেলা কাবিটা মনিটরিং ও বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যসচিব মো. আবু বক্কর সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন স্থানীয় জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করেছে। উপজেলা থেকেই প্রাক্কলন করে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বাঁধের ব্যাপারে তিনি বলেন, কিছু বাঁধের ব্যাপারে অভিযোগ এসেছে। আমরা এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত