নিজস্ব প্রতিবেদক

০৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:১০

সৌদি থেকে শূন্য হাতে ফিরলেন সিলেটের ৮জন

সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর এলাকার মো. এরশাদ আলী (৩১)। ১১ সদস্যের পরিবারে ভাইদের মধ্যে তিনি বড়। তাই পরিবারের হাল ধরার জন্য ১৬ মাস আগে ৪ লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরবে যান। পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় সৌদি যেতে অনেক ধার কর্জ করতে হয়েছে তাকে। সেই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে রোববার (৫ জানুয়ারি) খালি হাতে দেশে ফিরেছেন এরশাদ। আকামা থাকা সত্ত্বেও তাকে দেশে পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এরশাদ।

নতুন বছরের শুরুতেও সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশিদের ফেরা অব্যাহত রয়েছে। রোববার (৫ জানুয়ারি) রাতে সৌদি থেকে ফিরেছেন আরও ১৩৭ বাংলাদেশি। এর মধ্যে সিলেটের আছেন ৬ পুরুষ ও ২ নারী কর্মী রয়েছেন। রাত ১১ টা ২০ মিনিটে ও রাত দেড়টায় সৌদি এয়ারলাইন্সের এসভি ৮০৪ ও এসভি ৮০২ দুটি বিমানযোগে দেশে ফিরেন ১৩৭ জন।

এ নিয়ে গত পাঁচ দিনে ৪৫৪ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে সৌদি আরব থেকে ২৪ হাজার ২৮১ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানান ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান। বরাবরের মতো ফেরত আসাদের মাঝে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম থেকে খাবার, পানিসহ নিরাপদে বাড়ী পৌঁছানোর জন্য জরুরী সহায়তা প্রদান করা হয়।

সৌদি ফেরত বিশ্বম্ভরপুর এলাকার মো. এরশাদ আলী বলেন, আমি আমার ডিউটি শেষ করে মার্কেটে সবজি কিনতে গিয়েছি। এসময় আচমকা অভিযান চালিয়ে আমিসহ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশীকে ধরে নিয়ে যায় সৌদি পুলিশ। আমি তাদেরকে আকামা দেখানোর পরও আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেয় তারা। আমার কোম্পানির মালিকও অনেক চেষ্টা করেছে আমাকে ছাড়ানোর জন্য। কিন্তু তারা কিছু না শুনে আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।

তিনি বলেন, অনেক টাকা ঋণ করে সৌদি গিয়েছিলাম। এখন খালি হাতে ফিরেছি। ঋণের টাকাও পরিশোধ করতে পারিনি। আমি ধ্বংস হয়েছি সাথে আমার পরিবারও ধ্বংস হয়েছে। আমাদের সরকারের উচিত সৌদি সরকারের সাথে ভালোভাবে চুক্তি করা। এবং আমার মত যারা নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছে তাদের সহযোগিতা করা।

এরশাদের মত দেশে ফেরা বেশিরভাগ যুবকের অভিযোগ, আকামা থাকার পরও তাদেরেকে জোর করে দেশে পাঠাচ্ছে সৌদি সরকার। আকামা তৈরির জন্য কফিলকে (নিয়োগকর্তা) টাকা প্রদান করলেও কফিল আকামা তৈরি করে দিচ্ছেন না। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর কফিলের সাথে যোগাযোগ করা হলে গ্রেপ্তারকৃত কর্মীর দায়-দায়িত্ব নিচ্ছেন না। বরং কফিল প্রশাসনকে বলেন ক্রুশ (ভিসা বাতিল) দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিতে।

রোববার অন্যদের সাথে দেশে ফিরেন সুনামগঞ্জের আবুল কালাম। তিনি জানান, দুই বছর আগে প্রিন্টিং এর কাজ নিয়ে ৫ লাখ চাকা খরচ করে সৌদি আরবে যান তিনি। কিন্তু ভাগ্যের ঘুরনোর আগেই দেশে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে।

একই পরিস্থিতির শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন সিলেটের ফুরকান, মো. শাহ আলম, রফিকসহ ৬ পুরুষ কর্মী।

এদিকে পুরুষদেরকে সৌদি সরকার ফেরত পাঠালেও নারী কর্মীরা নির্যাতন, বিক্রি ও বেতন না দেওয়ার কারণে ফিরছেন স্বেচ্ছায়। রোববার দেশে ফিরেছেন সিলেটর ২ নারী কর্মী।

সাত মাস আগে সুনামগঞ্জ জেলার নরুত্তমপুর গ্রামের সুরাইয়া (৩০) (ছদ্মনাম) গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে নিয়োগকর্তা কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনে শিকার হয়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হন সুরাইয়া। তিনি বলেন, সৌদি যাবার পর থেকে আমাকে প্রায় ১৮/২০ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। কাজ শেষে ঘুমাতে গেলে মালিক বিরক্ত করতো। কাজ করলেও বেতন দিতেন না। বেতন চাইলে বলতেন আমাকে বিক্রি করা হয়েছে তাই তারা বেতন দিবে না।

দেশে ফেরা আরেক নারী গৃহকর্মী হবিগঞ্জের মিরপুর এলাকার মর্জিনা (২৭) (ছদ্মনাম)। আট মাস পূর্বে সৌদি গিয়েছিলেন তিনি। তার গল্পও প্রায় সুরাইয়ার মত। কিন্তু মর্জিনার উপর নির্যাতনের মাত্রা বেশি হয়েছিল। তাই তিনি বিমানবন্দরে দাঁড়াতেই পারছিলেন না। হাসিনা বলেন, ‘মালিক ভালা না, খালি মারে আর খারাপ খারাপ কথা কয়। তাদের কথা না শুনলে অনেক মারে।’

এ ব্যাপারে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, গতবছর ২০১৯ সালে সৌদি আরব থেকে ২৪ হাজার ২৮১ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। নতুন বছরের শুরুর পাঁচ দিনে ফিরলেন ৪৫৪ জন। এইভাবে ব্যর্থ হয়ে যারা ফিরছেন তাদের পাশে সবার দাঁড়ানো উচিত। পাশাপাশি এভাবে যেন কাউকে প্রতারিত না হতে হয়, যে কাজে গিয়েছেন সেই কাজই যেন পান এবং খরচের টাকাটা তুলে ভাগ্য ফেরাতে পারেন সেটা নিশ্চিত তরতে হবে রাষ্ট্র ও দূতাবাসকে। এক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিকেই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। আর সরকারের নেয়া সাম্প্রতিক ১২ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে নারী কর্মীদের নিপীড়ন কমে আসবে বলে আমরা মনে করি।

তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছি নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা এই মানুষদের সাহায্য করতে। ফেরত আসাদের বিমানবন্দরে খাবার, পানিসহ নিরাপদে বাড়ী পৌঁছানোর জন্য জরুরী সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও বিদেশ থেকে ফেরা মানুষদের কাউন্সিলিং ও আর্থিকভাবে সহায়তার কর্মসূচি নিয়েছে ব্র্যাক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত