নিজস্ব প্রতিবেদক

৩১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:৪০

কেন সিলেটকেই নিরাপদ মনে করছে জঙ্গিরা?

সিলেটে ফের জঙ্গি আস্তানার সন্ধান

২০০৬ সালের পর ২০১৭! এগারো বছরের ব্যবধানে দেশজুড়ে আলোচনায় উঠে এসেছিলো সিলেটের দুটি বাড়ি। এর একটির নাম ‘সূর্যদিঘল বাড়ি’ অপরটির নাম ‘আতিয়া মহল’। ২০০৬ সালের ২ মার্চ সূর্যদিঘল বাড়ি থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করে জেএমবি’র শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমানকে। আর ২০১৭ সাল থেকে ২৩ মার্চ থেকে পাঁচদিনের অভিযানে আতিয়া মহলে অভিযানে নিহত হয় চার জঙ্গি। যাদের মধ্যে নব্য জেএমবির প্রধান মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা ছিলো বলে জানায় পুলিশ।

আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের প্রায় তিন বছর পর আবার সিলেটে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। বুধবার রাতে সিলেট নগরীর আরামবাগে অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘আল্লাহর দল’-এর ৯ সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতরা নাশকতা ঘটানোর জন্য সিলেটের ওই বাসায় জড়ো হয়ে গোপন বৈঠক করছিলো বলে দাবি পুলিশের।

বুধবার রাতে ৯জন গ্রেপ্তারের পর ফের আলোচনায় ওঠে এসেছে সিলেটে জঙ্গিদের নিরাপদ আস্তানার বিষয়টি।

জঙ্গি আস্তানা হিসেবে সিলেট প্রথম আলোচনায় আসে ২০০৬ সালে। ওই বছরের ১ মার্চ মধ্যরাতে সিলেটের উত্তরপ্রান্ত শাপলাবাগ এলাকার ‘সূর্যদিঘল বাড়ি’ নামের একটি একতলা বাড়িতে জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি’র) শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান রয়েছেন সংবাদে বাড়িটি ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেনাবাহিনীর একটি দলও অংশ নেয় এই অভিযানে। বাড়ির গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ভিতরে ছোড়া হয় গ্যাস। ২ মার্চ সকালে বাড়িটি থেকে বেরিয়ে আসেন শায়খ রহমানের স্ত্রী-সন্তানরা। এরপর আত্মসমর্পণ করেন আবদুর রহমান। তাকে আটকের পর সূর্য দীঘল বাড়ি থেকে ছোট আকারের একটি বোমা, দুই কেজি অ্যালুমিনিয়াম, কয়েকটি বই, ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও পারিবারিক ছবি উদ্ধার করা হয়। ২০০৭ সালে ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় ফাঁসি হয় আবদুর রহমানের।

সেই ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র কথা এগারো বছর পর আবার মনে করিয়ে দেয় নগরীর দক্ষিণ পাড়ের শিববাড়ি এলাকার ‘আতিয়া মহল’ নামের আরেকটি ভবন। জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ মধ্যরাত থেকে পাঁচতলা এই বাড়িটি ঘিরে রাখে পুলিশ। পরদিন পুলিশের সাথে যোগ দেয় সোয়াট। আর ওই রাতে আসে সেনাবাহিনী। ২৫ মার্চ সকাল থেকে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামের অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। ওই বাসায় অভিযান শেষে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে চার জঙ্গির নিহতের খবর জানায় সেনাবাহিনী। আর অভিযান চলাকালে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ভবনের বাইরে দুটি বোমা বিস্ফোরণে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত হন ছয় জন।

সূর্যদীঘল বাড়িতে অভিযানের ৩১ ঘণ্টার মধ্যেই শীর্ষ জঙ্গি শায়খ আবদুর রহমানকে দুই সহযোগীসহ আত্মসমর্পণ করাতে সমর্থ হয়েছিলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে আতিয়া মহলের ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো সত্ত্বেও ভেতরের জঙ্গিরা তাতে সাড়া দেয়নি। সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলের ১১১ ঘণ্টার টানা অভিযান শেষে জানানো হয় চার জঙ্গির নিহতের খবর।

তবে এবার আর কোনো ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পারেনি জঙ্গিরা। কোনো প্রাণহানিও ঘটেনি। গত বুধবার রাতে আরামবাগের একটি বাসায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালায় সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষায়িত টিম এন্টি টেরোরিজম ইউনিট। এই অভিযানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আটক করা হয় ১১ জনকে।

আটককৃতরা হলেন- বগুড়ার আব্দুল মান্নান আখন্দের ছেলে মানিক আখন্দ (৩২), নোয়াখালীর আবুল কালামের ছেলে জহির উদ্দিন বাবর (২০), সিলেটের জকিগঞ্জের মখদ্দস আলীর পুত্র রাসেল আহম্মদ (২৪), একই এলাকার মুক্তাদির মিয়ার পুত্র কামাল আহমদ (২৫), কুমিল্লার আব্দুল আলীর পুত্র আবুল কালাম আজাদ (২০), সুনামগঞ্জের আব্দুল আজিজের পুত্র তমি উদ্দিন সুমন (৩০), রাজশাহীর কায়েম উদ্দিনের পুত্র আশরাফুল ইসলাম, সিলেটের টুকেরবাজারের আব্দুস সালামের পুত্র জুয়েল আহম্মেদ (২৪) ও সিলেটের গোলাপগঞ্জের আলাউদ্দিনের পুত্র স্বপন আহম্মেদ (২১)।

আটককৃতদের কাছে থেকে মোবাইল ফোন ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার কাগজপত্র উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।

এদিকে, সিলেটে বারবার জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়ায় প্রশ্ন ওঠেছে কেন জঙ্গিদের নিরাপদ আস্তানা সিলেট?

২০০৪ সালে ১২ জানুয়ারি সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.) মাজারে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত হন ৭ জন, একই বছরের ২১ মে একই মাজারে তৎকালিন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়, ওই বছরের ৭ আগস্ট সিলেটে গুলশান হোটেলে মহানগর আওয়ামী লীগের কর্মীসভায় আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও সিলেটে বেশ কয়েকদফা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তদন্তে এসব বিস্ফোরণের সাথে জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলে। সিলেটে শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনাও ফাঁস হয়।

কেনো জঙ্গিদের নিরাপদ আস্তানা হয়ে ওঠছে সিলেট, এমন প্রশ্নের জবাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক কমিটি (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহুমদ চৌধুরী বলেন, সিলেট সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়া ও বাসা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ না করার ফলে এমনটি ঘটতে পারে। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে তাদের আশ্রয়দাতা এবং রাজনৈতিক যোগসাজশও থাকতে পারে বলে ধারণা তাদের।

তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেট নগরী গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। এখানে সড়ক ও বাসাবাড়িগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়ে তোলা হয়নি। ফলে পুলিশ চাইলে সব সড়ক ও সব বাসা নজরদারি করতে পারে না। এছাড়া বড় বড় বেশিরভাগ বাসার মালিক প্রবাসী। বাসা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেন না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত