শাকিলা ববি

০৬ ফেব্রুয়ারি , ২০২০ ২২:৪২

সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তিতে সিলেটে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ!

সিলেট নগরীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে কাজ করতেন জেনি (ছদ্মনাম)। তার স্বামী সাজু (ছদ্মনাম) চাকুরি করেন প্রাইভেট ব্যাংকে। চার বছর আগে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। গর্ভধারণের পর চাকুরি ছেড়ে দেন জেনি। বর্তমানে ২ বছরের একটি সন্তান আছে তাদের। চাকুরির কারণে শুক্রবার ছাড়া একান্তে সময় কাটানোর খুব একটা সুযোগ হয় না তাদের।

জেনির অভিযোগ ঘরে এসেই সাজু মোবাইল ফোনে ফেসবুক, মেসেনজার, হোয়টসাপসহ ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। ফেসবুকে সন্তান ও স্ত্রীর ছবি পোস্ট করে না। মোবাইল পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করে রাখেন। অথচ জেনির ফেসবুকের পাসওয়ার্ড স্বামীর কাছে রাখে। জেনি কারো সাথে মেসেঞ্জারে কথা বললে তাকে ব্লক করে দেন সাজু। কথায় কথায় রেগে যান। এসব নিয়ে স্বামীর সাথে ঝগড়া করে প্রায় ৩ মাস বাবার বাড়ি ছিলেন জেনি। পরে  পারিবারিক সমোঝতায় আবারও স্বামীর কাছে আসেন। এরপর কয়েকদিন সব ঠিকঠাক চলে। কিন্তু মাস খানেক পর আবারও সাজু আগের মত ব্যবহার শুরু করেন। তাই জেনি বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন।

জেনি বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন কাজী অফিসে। সেই আবেদন পত্রের কপি পাঠানো হয় সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)-এর পারিবারিক ও সালিশ বোর্ড/ আদালতে। এই দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন পেয়ে তাদেরকে হাজিরার জন্য তলব করা হয় সিসিকের আইন শাখা থেকে। পরে পারিবারিক ও সালিশ বোর্ডের চেয়ারম্যান সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী কথা বলেন তাদের সাথে। মেয়র তাদের সাথে কয়েকদফা কথা বলে বুঝতে পারেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে শুধুমাত্র সন্দেহের বশীভূত হয়ে দুজন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে চাচ্ছেন।   

এই দম্পতির মতই সিলেট সিটি করপোরেশনে প্রতি মাসে গড়ে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন পড়ে ২০ থেকে ২৫টি। গত ২বছরে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন পড়েছে ৫৪৯টি। এর মধ্যে ৭টি বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হয়। এসব আবেদনের মধ্যে বেশিরভাগ কারণ ছিল স্বামী বা স্ত্রীর অতিমাত্রায় ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ।

এই আবেদনকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণীর দম্পতি। সিসিক সংশ্লিস্টরা জানিয়েছেন, বিচ্ছেদ আবেদনের সংখ্যা বাড়লেও বেশিরভাগক্ষেত্রেই সিসিকের সালিশ বোর্ড দুপক্ষের সাথে কথা বলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে।
 
সিলেট সিটি করপোরেশনের আইন শাখা সূত্রে জানা যায়,  ২০১৬ সালে সিসিকে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন জমা পড়ে ৩৪৪টি। ২০১৭ সালে আবেদন পড়ে ৯৪টি। সবকটি আবেদনের পরই উভয় পক্ষকে নোটিশ দিয়ে সমঝোতায় বসেছিলেন মেয়র। সমঝোতা না হওয়ায় ২০১৬ সালে ১০টি এবং ২০১৭ সালে ২৩টি বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয়েছিল। ২০১৮ সালে সিসিকে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন পরে ২৫৫টি। এর মধ্যে মাত্র ১টি বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হয়। ২০১৯ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন পরে ২৯৪টি। এর মধ্যে মাত্র ৬টি বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হয়।

সিসিক আইন শাখা সূত্রে আরও জানা যায়, আবেদনে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে পরকীয়া, মাদকাসক্তি, শারীরিক অক্ষমতা, স্বামী-স্ত্রীর অবহেলা লিখা হয়; তবে শুনানিতে এসে দেখা যায় অন্য কারণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর অতিরিক্ত আসক্তির কারণে দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এই দূরত্ব বাড়তে বাড়তে তাদের মধ্যে সন্দেহ দেখা দেয়। এমন সন্দেহ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন সিলেটের দম্পতিরা।

এছাড়াও স্বামী অফিস থেকে ঘরে আসার পর স্ত্রী চা, পানি দেন না, স্বামী ঘরে এসেই মোবাইলফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, স্ত্রী সবসময় টিভি দেখেন তাই বাচ্চাদের সময় দেন না, স্ত্রীকে মোবাইল ফোনের পাসওয়ার্ড দেন না স্বামী- এসব কারণও উল্লেখ করা হয়েছে সিসিকে জড়া পড়া বিচ্ছেদের আবেদনে।
সিসিকের সংশ্লিস্ট শাখার কর্মকর্তারা জানান, কর্মজীবী দম্পতিরা তাদের ব্যস্ততার কারণে একান্ত সময় বের করতে না পেরে তাদের মধ্যে দূরত্ব ও সন্দেহর সৃষ্টি হয়। এছাড়াও প্রেমের বিয়ে, কোর্টের বিয়ের পর যখন পরিবারে জানাজানি হয় তখন পরিবারের চাপে অনেকেই বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন।

বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম আগে সিসিকের প্রশাসনিক শাখায় করা হত। ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে এ সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম সিসিকের আইন শাখায় করা হয়। পারিবারিক ও সালিশ বোর্ড/ আদালতের চেয়ারম্যান সিসিক মেয়র। সালিশে বাদী, বিবাদী ও তাদের প্রতিনিধিগন, এলাকার বিশিষ্টজন, রাজনৈতিক নেতা ও সংশ্লিষ্ট শাখার প্রতিনিধিগন থাকেন।

সিলেট সিটি করপোরেশনের আইন সহকারী শ্যামল রঞ্জন দেব বলেন,  প্রতি মাসে অন্তত ৩টি শুনানি হয় সিলেট সিটি করপোরেশনের পারিবারিক ও সালিশ বোর্ড/ আদালতে। সিসিকে যে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন আসে এর বেশিরভাগই কার্যকর না করে মেয়র সাহেব দুপক্ষকে মিলিয়ে দেন। যাদের মিলিয়ে দিয়েছেন তার মধ্যে বেশিরভাগ আবেদনের কারণ ছিল স্বামী-স্ত্রীর স্বামী-স্ত্রীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরিক্ত আসক্তির অভিযোগ।

তিনি বলেন, কাজী অফিস থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনের কপি পাওয়ার পর আমরা দুপক্ষকে তিনটি নোটিশ পাঠাই হাজির হওয়ার জন্য। এরপর শুনানির জন্য আরেকটি নোটিশ পাঠানো হয়। এই নোটিশ প্রেরণের মেয়র শুনানি করেন।

তিনি বলেন, কিছু আবেদন আটকে থাকে দুপক্ষের ঠিকানা জটিলতা, বা স্বামী/ স্ত্রী বিদেশ থাকার কারণে। আর যে বিবাহ বিচ্ছেদগুলো কার্যকর হয় তা বেশিরভাগই বিদেশিদের ক্ষেত্রে হয়।

এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, তুচ্ছ কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন দম্পতিরা। আগে বিবাহ বিচ্ছেদর কারণ ছিল স্বামী কর্তৃক শারীরক নির্যাতন, শশুড়-শাশুড়ির, দেবরের সাথে ঝগড়া। আর এখন মোবইলের পাসওয়ার্ড না নিলে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করা হয়।

তিনি বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদ আমাদের সমাজের জন্য একটি ব্যাধি। তাই আমি চাই সিলেট নগরীতে যেন এই ব্যাধি না ছড়ায়। সেজন্য সিসিকের মাধ্যমে যারা বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চান তাদেরকে সিলেট সিটি করপোরেশনের পারিবারিক ও সালিশ বোর্ডের মাধ্যমে কথা বলে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। বিবাহ বিচ্ছেদ কমাতে আমরা অনেকটা সফল। কারণ গত ২ বছরে সিসিকে বিবাহ বিচ্ছেদের যে পরিমাণ আবেদন পড়েছে তার মধ্যে বেশিরভাগ দম্পতিকে আমরা কথা বলে বুঝিয়ে মিলিয়ে দিতে পেরেছি।

মেয়র বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদকারী দম্পতিদের সাথে আমরা কয়েক দফা শুনানি করি। এমনও দেখেছি আখত হওয়ার পর শশুড়বাড়িতে যাওয়ার আগেই বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চায় দুই পক্ষ। মোবাইলে কথা বলা, টিভি দেখার মত তুচ্ছ বিষয় নিয়েও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে চান অনেকেই। তাই বেশিরভাগ সময় দুপক্ষের সাথে কথা বললে, যুক্তি দেখালে তারা এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত