শাকিলা ববি

০৭ মার্চ, ২০২০ ২৩:৪৮

স্বামীর অবহেলা, সৌদির নির্যাতন- কিছুই দমাতে পারেনি লাকিকে

অপ্রতিরোধ্য নারী

‘মাত্র দেড়শ টাকা পুঞ্জি নিয়া এই ব্রিজের তলায় চায়ের দোকান লইয়া দাঁড়াইছলাম। এক বেটি ব্রিজের তলাত চা বেচে। ইটা দেখার লাইগা কত মানুষ যে আইতো। কত মানুষের কত কথা শুনছি, কত ইশরা দেখছি। তখন খালি আমারে দেখার লাইগা ইখানো চা খাইতে আইতো বেটাইন্তে। কতজনে খারাপ উদ্দেশ্যে কইতো ই বেটির বডি যে ভালা। কিচ্ছু কইতাম না কারণ আমার যে টেকা দরকার। আমি টেকা রুজি কইরা নিলে আমার পুয়াপুরির মুখো ভাত জুটবো।’

কথাগুলো বলছিলেন সিলেটের ক্বিনব্রিজের নিচের ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতা লাকি বেগম (৪০)। প্রায় চার বছর আগে স্বামী রাসেল মিয়া তাকে রেখে চলে যান। এরপর স্বামীর লাখ টাকা দেনা ও এক মেয়ে এবং এক ছেলেকে নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। কোনো উপায় না দেখে স্বামীর ভ্রাম্যমান চায়ের দোকান নিয়ে লাকি বসে পড়েন ক্বিনব্রিজের নিচে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত জীবন সংগ্রাম চলমান রয়েছে তার।

স্বামীর ধারদেনা পরিশোধ ও সংসারের সচ্ছলতা আনার জন্য গত বছর এপ্রিল মাসে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন লাকি। কিন্তু সেখানেও নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৮ দিনের মাথায় দেশে ফিরেন তিনি। এরপর সন্তানদের নিয়ে আবারও বিপাকে পড়েন লাকি। জীবিকার তাগিদে আবারও ভ্রাম্যমান চায়ের দোকান নিয়ে হাজির হন ক্বিনব্রিজের নিচে।

আজ রোববার (৮ মার্চ) বিশ্ব নারী দিবস। নারী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্রজন্ম হোক সমতার, সকল নারীর অধিকার।’

মূলত নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি কোনো বৈষম্য না করা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে সর্বস্তরে নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারী দিবসের সূচনা হয়েছিল।

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের পোশাক ও টেক্সটাইল কারখানার নারী শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমেছিলেন। পুলিশ সেই মিছিলে ছত্রভঙ্গের জন্য নিষ্ঠুরভাবে নারীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল। নারী অধিকার আদায়ের সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই প্রতিবছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ধর্ষণ, নির্যাতন যেখানে নিত্যদিনের সঙ্গী, সেখানে প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন লাকি। এই নারী দিবসে সংগ্রামী এই নারীর জীবন কাহিনী তুলে ধরা হল সিলেট টুডের পাঠকদের জন্য।

লাকির এই জীবন সংগ্রামের শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম লাকি বেগমের। লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি তার। কাজের সুবাদে বেশ কয়েক বছর আগে সিলেটে আসেন। তখন দক্ষিণ সুরমা উপজেলার খোজারখলা গ্রামে রাসেল মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। সেখান থেকেই রাসেল মিয়ার সাথে পরিচয় হয়ে বিয়ে হয় ২০০৪ সালে।

বিয়ের পর সিলেট শহরে চলে আসেন দুজন। লাকি বাসায় ছোট একটা মুদি দোকান চালাতেন আর স্বামী ক্বিনব্রিজের নিচে চা বিক্রি করতেন। খুব ভালই যাচ্ছিল সংসার। এক মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন লাকি।  এর মধ্যেই স্বামী রাসেল বিভিন্ন জায়গা ধারদেনা করতে থাকেন। ছেলে সন্তান নেই বলে একটি ছেলে দত্তক আনেন স্বামী। এর কিছুদিন পরই তাকে রেখে পালিয়ে যান রাসেল মিয়া। পরে সংসার চালাতে ক্বিনব্রিজের নিচে চা বিক্রি শুরু করেন তিনি।

লাকি বলেন, ‘আমার কষ্ট, আমার কান্না শোনার মত কেউ নাই। স্বামী ছাইড়া গেছে ইখানোই শেষ না। একদিকে আমি জীবিকার তাগিদে ঘর থেইক্কা বাইর হইছি অন্যদিকে আমার নাবালিকা মেয়েটারে ঘরে একলা পাইয়া খারাপ কাজ করছে আরেক জালিমে। আমি কিচ্ছু কইতে পারি না। হঠাৎ একদিন মেয়ে এসব কইছে। পরে কোনো উপায় না পাইয়া ওই জালিমের কাছেই আমার ১৪ বছরের মেয়েটারে বিয়া দিছি। মেয়েটারে অনেক জ¦ালায় তার স্বামীর বাড়ির লোকজন তাই মেয়েটা সন্তানসহ আমার কাছেই থাকে।’

স্বামীর দেনা, সংসার খরচ, দোকানের পুঁজি সংকটে এখন জর্জরিত লাকির জীবন। এদেশের প্রতি, এদেশের আইন কানুন, সমাজ ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা এসে গেছে তার।

লাকি বলেন, এই দেশে এই সমাজ কি দিছে আমারে। জীবিকা করার ক্ষমতা নাই আমার তারপরও জীবনযুদ্ধ চালাইতেছি। আমার কষ্ট আমার বুকে জমা। লেখাপড়া জানি না তাই স্বামী প্রতারণা কইরা আমারে দিয়াওই তালাক দেওয়াইছে। আমার টাকা নাই তাই আইনি লড়াইও করতে পারছি না। এই দেশে বাল্য বিয়া বেআইনি। তাইলে কোর্ট কিভাবে আমার বাচ্চা মেয়ের বিয়া দিয়া দিল। আমার বিশ্রাম নাই, শান্তি নাই। আমার সাথে হওয়া সব অন্যায় সহ্য করতাছি। আমার বোবা কান্না কেউ শুনে না। দেখি যুদ্ধ কইরা কতটুকু টিকে থাকতে পারি।

লাকি মনে করেন নারী মানেই সংগ্রাম।তিনি বলেন, ‘আমার দেশের সব নারীই সংগ্রাম করে। ছোটকালে মায়ের সংগ্রাম দেইক্কা বড় হইছি। এখন আমার ছেলে মেয়েরা আমার সংগ্রাম দেইক্কা বড় হইতাছে। তবে যাই হোক এই জীবন যুদ্ধে হার মানতাম না।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত